১৯৪৬: হিংসা থেকে সম্প্রীতির পথে, ইতিহাসের পাঠ সমাজসেবীর পুজোয়
Durga Puja 2025: নেতাজির সহকর্মী লীলা রায় চেষ্টা করেছিলেন সহমনা মানুষদের সঙ্গে নিয়ে দাঙ্গাবিধ্বস্ত মানুষকে সাহায্য করতে। সেই সময় থেকেই সমাজসেবী সঙ্ঘের যাত্রা শুরু হয়।
দক্ষিণ কলকাতার পরিচিত রাস্তাগুলির একটি লীলা রায় সরণী, শরৎ বোস রোড। সাদার্ন অ্যাভিনিউকে কেটে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের সঙ্গে মেশা যে সব রাস্তাগুলি, তার পাশেই ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজসেবী সঙ্ঘ। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লীলা রায়, যিনি একসময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গী হিসেবে কাজ করেছিলেন। অনেকের মনে হতে পারে, এবারের পুজোর থিম শুধু সমাজসেবী সঙ্ঘকে ঘিরেই। কিন্তু বিষয়টি আসলে তার থেকেও অনেক বড়— ১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গার পর লীলা রায়, মেঘনাদ সাহা-সহ বহু মানুষ যেভাবে দাঙ্গাপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ইতিহাসকে স্মরণ করেই এই ভাবনার নাম রাখা হয়েছে ‘পথের পাঁচালি’।
একদিকে যখন এক অবাঙালি পরিচালক দাঙ্গার ইতিহাস বিকৃত করে সংখ্যাগুরুদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করছেন, তখন শিল্পী প্রদীপ দাস তুলে ধরেছেন— কীভাবে এই শহরেরই এক কোণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হয়ে উঠেছিল। শিল্পী এর আগে কলকাতার আরও কয়েকটি পুজোয় কাজ করেছেন, কিন্তু এই সময়টিকে বেছে নেওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট— বাঙালির ইতিহাস আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস, যার সাক্ষ্য মেলে বিভিন্ন সময়ে নানা ছাপাখানার মুদ্রণে। তাই মণ্ডপের প্রবেশপথে রাখা হয়েছে এক ছাপা যন্ত্র এবং বইয়ের মলাট, যেখানে লেখা আছে— ‘সেকুলার বাঙালির ইস্তেহার’। যেন মনে করিয়ে দেয়, যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, বাংলার মাটি বিভেদের বিরুদ্ধে অটল।

প্রতিটি রাস্তাই একেকটি ইতিহাস বয়ে বেড়ায়। সমাজসেবী সঙ্ঘের আশেপাশের রাস্তা ও বাড়িগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়। খড়খড়ি দেওয়া জানলা, পুরনো বারান্দা, বড় আয়না— সবই বহন করছে সেই সময়ের স্মৃতি। ১৯৪৬ সালের অগাস্টে যখন কলকাতা ভাতৃঘাতী দাঙ্গায় জ্বলছিল, তখন এখানকার মানুষ তাঁদের দরজা খুলে দিয়েছিলেন সম্প্রীতির স্বার্থে। সেই পথ চলার ইতিহাস আজও মানুষ মনে রেখেছেন। নেতাজির সহকর্মী লীলা রায় চেষ্টা করেছিলেন সহমনা মানুষদের সঙ্গে নিয়ে দাঙ্গাবিধ্বস্ত মানুষকে সাহায্য করতে। সেই সময় থেকেই সমাজসেবী সঙ্ঘের যাত্রা শুরু হয় এবং একই বছরে পুজোও শুরু হয়। তবে এই পুজো কোনোদিনই কেবল সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় উৎসব হয়ে থাকেনি, বরং প্রথম দিন থেকেই এটি হয়ে উঠেছে সামাজিক সংহতি, সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক। তাই আজও পুজোর মণ্ডপে প্রবেশ করলে শোনা যায় আজানের সুর— সেই ইতিহাসেরই স্মারক হিসেবে।
আরও পড়ুন- সিনেমায় বিকৃত ১৯৪৬, ইতিহাসের নামে চলছে যে রাজনীতির খেলা
আজ যখন ‘বেঙ্গল ফাইলস’– এর মতো ছবি অর্ধসত্য তথ্য পরিবেশন করে, তখন ইতিহাসের আসল প্রতিরোধের কাহিনি সামনে আনা জরুরি। শিল্পী তাই দেখিয়েছেন— শুধু দাঙ্গা উস্কে দেওয়ার চেষ্টা হয়নি, দাঙ্গা থামানো ও সম্প্রীতি রক্ষার জন্যও বহু মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন। শকুনের নজরদারি, উড়োজাহাজ, অস্ত্রে বোঝাই ট্রাক, সাইরেন, বোমার শব্দ— সবই ছিল সেই সময়ের বাস্তবতা লীলা রায়, মেঘনাদ সাহা, শরৎ বসু, যদুনাথ সরকার, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী— সকলেই এগিয়ে এসেছিলেন সম্প্রীতি রক্ষায়।
মণ্ডপের চারপাশে ট্রাকের ছবিতে ধরা পড়েছে সেই অন্ধকার দিনগুলির স্মৃতি— কখনও অস্ত্র বোঝাই হয়ে, কখনও বা আহত মানুষকে উদ্ধার করতে। ঐতিহাসিক সৌম্য বসুর লেখায় পাওয়া যায়— কীভাবে দাঙ্গা স্তিমিত হওয়ার পর সমাজসেবার জন্য একটি সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেখান থেকেই জন্ম নেয় সমাজসেবী সঙ্ঘ। ২০২৫ সালের এই পুজো তাই কেবল উৎসব নয়, ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক হাসপাতাল ছিল লেক ভিউ রোডে। সেই হাসপাতালের কর্মীরাও লীলা রায়ের সঙ্গে মিলে দাঙ্গাপীড়িত মানুষদের সাহায্যে নেমেছিলেন। নানা বইয়ে উল্লেখ আছে— কীভাবে হিন্দু প্রতিবেশীরা মুসলিম হায়দার আলিকে রক্ষা করেছিলেন, অথবা এক মুসলিম পরিবার কীভাবে হিন্দু টি এন ঘোষকে দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।
এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এখনও ছড়িয়ে আছে সেইসব গল্প। পুরনো সংবাদপত্রের কাটিং একত্রে করলে ভেসে ওঠে অন্য ছবি— যা ‘বেঙ্গল ফাইলস’-এর অর্ধসত্যের বিপরীতে দাঁড় করায় ঐক্য ও প্রতিরোধের ইতিহাস।
সমাজসেবীর এই পুজো আসলে স্মৃতির সমাহার। যেমন স্কুলে টিফিন ভাগ করে খাওয়ার সময় হিন্দু-মুসলমানের কোনো ভেদাভেদ ছিল না— সেই ছোট্ট স্মৃতিই আজ প্রতীক হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক সুস্নাত দাসের কথায়—
“১৯৪৫ এর পর ব্রিটিশরা ভয় পেত যে যদি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ সবাই এক পতাকার নিচে একত্রিত হয়, যেমন হয়েছিল নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজে, তবে তাঁদের শাসন আর টিকবে না।”
এই সময়ের নৌ বিদ্রোহ কিংবা শ্রমিক আন্দোলনের দিনগুলোতে শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষকরা যে ঐক্যের ছবি গড়ে তুলেছিলেন, তা ভাঙার জন্য সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। আর তাই সমাজসেবীর আজকের এই ‘পথের পাঁচালি’ এক অন্য বিকল্পের দিশা দেখায়। এই পুজো আমাদের মনে করিয়ে দেয়— বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস কতটা গভীর ও পুরনো। মেঘভাঙা বৃষ্টিতে অনেকেরই ক্ষতি হয়েছে ঠিকই, তবু যদি সুযোগ মেলে, দক্ষিণ কলকাতার সমাজসেবীর এই পুজো অন্তত একবার দেখে আসা উচিত।
দক্ষিণ কলকাতার পরিচিত রাস্তাগুলির একটি লীলা রায় সরণী, শরৎ বোস রোড। সাদার্ন অ্যাভিনিউকে কেটে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের সঙ্গে মেশা যে সব রাস্তাগুলি, তার পাশেই ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজসেবী সঙ্ঘ। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লীলা রায়, যিনি একসময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গী হিসেবে কাজ করেছিলেন। অনেকের মনে হতে পারে, এবারের পুজোর থিম শুধু সমাজসেবী সঙ্ঘকে ঘিরেই। কিন্তু বিষয়টি আসলে তার থেকেও অনেক বড়— ১৯৪৬ সালের কলকাতার দাঙ্গার পর লীলা রায়, মেঘনাদ সাহা-সহ বহু মানুষ যেভাবে দাঙ্গাপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ইতিহাসকে স্মরণ করেই এই ভাবনার নাম রাখা হয়েছে ‘পথের পাঁচালি’।
একদিকে যখন এক অবাঙালি পরিচালক দাঙ্গার ইতিহাস বিকৃত করে সংখ্যাগুরুদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর চেষ্টা করছেন, তখন শিল্পী প্রদীপ দাস তুলে ধরেছেন— কীভাবে এই শহরেরই এক কোণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হয়ে উঠেছিল। শিল্পী এর আগে কলকাতার আরও কয়েকটি পুজোয় কাজ করেছেন, কিন্তু এই সময়টিকে বেছে নেওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট— বাঙালির ইতিহাস আসলে ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস, যার সাক্ষ্য মেলে বিভিন্ন সময়ে নানা ছাপাখানার মুদ্রণে। তাই মণ্ডপের প্রবেশপথে রাখা হয়েছে এক ছাপা যন্ত্র এবং বইয়ের মলাট, যেখানে লেখা আছে— ‘সেকুলার বাঙালির ইস্তেহার’। যেন মনে করিয়ে দেয়, যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, বাংলার মাটি বিভেদের বিরুদ্ধে অটল।

প্রতিটি রাস্তাই একেকটি ইতিহাস বয়ে বেড়ায়। সমাজসেবী সঙ্ঘের আশেপাশের রাস্তা ও বাড়িগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়। খড়খড়ি দেওয়া জানলা, পুরনো বারান্দা, বড় আয়না— সবই বহন করছে সেই সময়ের স্মৃতি। ১৯৪৬ সালের অগাস্টে যখন কলকাতা ভাতৃঘাতী দাঙ্গায় জ্বলছিল, তখন এখানকার মানুষ তাঁদের দরজা খুলে দিয়েছিলেন সম্প্রীতির স্বার্থে। সেই পথ চলার ইতিহাস আজও মানুষ মনে রেখেছেন। নেতাজির সহকর্মী লীলা রায় চেষ্টা করেছিলেন সহমনা মানুষদের সঙ্গে নিয়ে দাঙ্গাবিধ্বস্ত মানুষকে সাহায্য করতে। সেই সময় থেকেই সমাজসেবী সঙ্ঘের যাত্রা শুরু হয় এবং একই বছরে পুজোও শুরু হয়। তবে এই পুজো কোনোদিনই কেবল সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় উৎসব হয়ে থাকেনি, বরং প্রথম দিন থেকেই এটি হয়ে উঠেছে সামাজিক সংহতি, সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক। তাই আজও পুজোর মণ্ডপে প্রবেশ করলে শোনা যায় আজানের সুর— সেই ইতিহাসেরই স্মারক হিসেবে।
আজ যখন ‘বেঙ্গল ফাইলস’– এর মতো ছবি অর্ধসত্য তথ্য পরিবেশন করে, তখন ইতিহাসের আসল প্রতিরোধের কাহিনি সামনে আনা জরুরি। শিল্পী তাই দেখিয়েছেন— শুধু দাঙ্গা উস্কে দেওয়ার চেষ্টা হয়নি, দাঙ্গা থামানো ও সম্প্রীতি রক্ষার জন্যও বহু মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন। শকুনের নজরদারি, উড়োজাহাজ, অস্ত্রে বোঝাই ট্রাক, সাইরেন, বোমার শব্দ— সবই ছিল সেই সময়ের বাস্তবতা লীলা রায়, মেঘনাদ সাহা, শরৎ বসু, যদুনাথ সরকার, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী— সকলেই এগিয়ে এসেছিলেন সম্প্রীতি রক্ষায়।
আরও পড়ুন- গোপাল পাঁঠা ‘হিন্দু বীর’ বা ‘বিপ্লবী’ কোনোটাই ছিলেন না
মণ্ডপের চারপাশে ট্রাকের ছবিতে ধরা পড়েছে সেই অন্ধকার দিনগুলির স্মৃতি— কখনও অস্ত্র বোঝাই হয়ে, কখনও বা আহত মানুষকে উদ্ধার করতে। ঐতিহাসিক সৌম্য বসুর লেখায় পাওয়া যায়— কীভাবে দাঙ্গা স্তিমিত হওয়ার পর সমাজসেবার জন্য একটি সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেখান থেকেই জন্ম নেয় সমাজসেবী সঙ্ঘ। ২০২৫ সালের এই পুজো তাই কেবল উৎসব নয়, ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক হাসপাতাল ছিল লেক ভিউ রোডে। সেই হাসপাতালের কর্মীরাও লীলা রায়ের সঙ্গে মিলে দাঙ্গাপীড়িত মানুষদের সাহায্যে নেমেছিলেন। নানা বইয়ে উল্লেখ আছে— কীভাবে হিন্দু প্রতিবেশীরা মুসলিম হায়দার আলিকে রক্ষা করেছিলেন, অথবা এক মুসলিম পরিবার কীভাবে হিন্দু টি এন ঘোষকে দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।
এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এখনও ছড়িয়ে আছে সেইসব গল্প। পুরনো সংবাদপত্রের কাটিং একত্রে করলে ভেসে ওঠে অন্য ছবি— যা ‘বেঙ্গল ফাইলস’-এর অর্ধসত্যের বিপরীতে দাঁড় করায় ঐক্য ও প্রতিরোধের ইতিহাস।
এই সময়ের নৌ বিদ্রোহ কিংবা শ্রমিক আন্দোলনের দিনগুলোতে শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষকরা যে ঐক্যের ছবি গড়ে তুলেছিলেন, তা ভাঙার জন্য সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। আর তাই সমাজসেবীর আজকের এই ‘পথের পাঁচালি’ এক অন্য বিকল্পের দিশা দেখায়। এই পুজো আমাদের মনে করিয়ে দেয়— বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস কতটা গভীর ও পুরনো। মেঘভাঙা বৃষ্টিতে অনেকেরই ক্ষতি হয়েছে ঠিকই, তবু যদি সুযোগ মেলে, দক্ষিণ কলকাতার সমাজসেবীর এই পুজো অন্তত একবার দেখে আসা উচিত।

Whatsapp
