নাম ঢাকার, ঘর কলকাতায়; কলকাতার 'ঢাকা কালীবাড়ি' রহস্য

Dhaka Kalibari: নিজের শিকড়ের শহর ‘ঢাকা’র নামটিকে প্রাণের শহর 'কলকাতা'র নতুন আশ্রয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন এই চক্রবর্তীমশাই। তাই এই মন্দিরের নাম দেন 'ঢাকা কালীবাড়ি'।

দক্ষিণ কলকাতার প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের দক্ষিণা কালীর 'ঢাকা কালীবাড়ি' মন্দির। যার প্রকৃত নাম 'শ্রী শ্রী রক্ষাকালীমাতার মন্দির'। ঢাকা কালীবাড়ি স্রেফ এক মন্দির নয়, ওপার বাংলার আবেগ, ইতিহাস আর স্মৃতিবহনকারী এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই মন্দির কলকাতাতেই অবস্থিত, অথচ এর নামে রয়েছে 'ঢাকা' শহরের নাম। শব্দটি সরাসরি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু কেন এই নামকরণ?

এই নামকরণের পিছনে রয়েছে দেশভাগ, অভিবাসন, ভক্তি ও স্নেহের স্মৃতি। ১৯৫০-এর দশকে দেশভাগের সময় ওপার বাংলা (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান)-র বহু হিন্দু পরিবার ঠাঁই খোঁজে এপার বাংলায়। তার মধ্যেই একটি পরিবার হলো চক্রবর্তী পরিবার। ননীগোপাল চক্রবর্তীর পরিবার। বরিশাল থেকে কলকাতায় আসেন তাঁরা। এসে দেখেন বাড়ির আশেপাশে কোনো হিন্দু মন্দির নেই। আনোয়ার শাহ রোডে যাদবপুর থানা থেকে টালিগঞ্জ মোড় পর্যন্ত এলাকাবাসী মাথা ঠোকেন এক বেদীতে। যে বেদীতে দেবী রক্ষাকালীর পুজো হয়। সেই বেদীর পিছনেই তাঁর বাড়ি।

একদিন বৃষ্টির পর ননীগোপাল চক্রবর্তী দেখেন, বেদীতে দেবী ভিজছেন। সেই দৃশ্য দেখে তিনি খুবই মর্মাহত হলেন। সেদিন থেকে তিনি পাকা মন্দির করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন। ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী কালীর ভাবে আবেশিত হয়ে কলকাতার কয়েকজন মানুষ প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের উপর একটি চালাঘরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেবীকে (১৯৫৬-৫৯)। প্রায় সত্তর বছর পার হয়ে গেলেও, আজও এই কালীবাড়ির জাগ্রত বিগ্রহ এলাকার ও দূর-দূরান্তের বহু মানুষের আশা ভরসার স্থান।

আরও পড়ুন-তন্ত্র ও ভক্তির সেতুবন্ধন: শান্তিপুরের কালী আরাধনার ইতিহাস

নিজের শিকড়ের শহর ‘ঢাকা’র নামটিকে প্রাণের শহর 'কলকাতা'র নতুন আশ্রয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন এই চক্রবর্তীমশাই। তাই এই মন্দিরের নাম দেন 'ঢাকা কালীবাড়ি'। এই মন্দির শুধু একটি পূজার কেন্দ্র নয়, অনেক অভিবাসী মানুষের কাছে এখানে রয়েছে শিকড়ের যাবতীয় গল্প— মানবিক টান, পুরনো দেশ ও সংস্কৃতির স্মৃতিমেদুরতা।

এছাড়াও বলা হয়, একসময় এই অঞ্চলে ‘ঢাকা ঔষধালয়’ নামে একটি বিখ্যাত ওষুধের দোকান ছিল। সেই দোকানের নাম থেকেই, এলাকার মোড়ের নাম হয় 'ঢাকার মোড়'। সেই সূত্রেই এলাকার এই কালীমন্দিরও পরিচিত হয় 'ঢাকা কালীবাড়ি' নামে।

প্রথম দিকে যজমানির সামান্য টাকায় মন্দির চলতো। প্রতিবছর কালীপুজোয় মাটির প্রতিমা এনে তা একবছর রেখে দেওয়া হতো। ১৯৭৯ সালে দেবীই ফেরালেন হাল। মাটির প্রতিমা বিসর্জিত হল। তৈরি হল কষ্ঠিপাথরের মূর্তি। বর্তমানে কষ্ঠিপাথরের অপূর্ব মুর্তিতে পূজিতা হন আদ্যাশক্তি।

প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে দক্ষিণা কালীর পুজো হয় মন্দিরে। যেহেতু, আগে এই স্থানে রক্ষাকালীর পুজো হতো। তাই, প্রতিষ্ঠার পরও রক্ষাকালী ও নিত্য পুজো দুই-ই হয়। মূলত বৈদিক নিয়মে পুজো হয় এই কালীবাড়িতে। তাই বলিপ্রথার প্রচলন নেই। বিশেষ তিথিতে বিশেষ পুজো হয়। এছাড়াও, বৈশাখ মাসের শেষ শনিবার প্রতিষ্ঠা দিবসের পুজো হয় মন্দিরে। কালীপুজোর দিন ষোড়শ উপাচারে দেবীর আরাধনা করা হয়। ঢাকা কালীবাড়িতে দেবীর ভোগ হিসেবে অন্নভোগের পাশাপাশি দেওয়া হয় নিরামিষ তরকারি, পাঁচ রকমের ভাজা, পায়েস, চাটনি এবং দু-রকমের মাছের পদ। পরের দিন খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, ইলিশ মাছ, রুই মাছ, চাটনি, পায়েসের অন্নকূটে সামিল হন প্রায় হাজার তিনেক মানুষ। তবে শুধু একটা দিন নয়। এখানে বারো মাসই একইরকম ভক্তিভরে পুজো পান দেবী।

More Articles