স্বদেশি আর স্বাধীনতার মন্ত্রে বাঙালিকে একজোট করেছিলেন দেবী দুর্গাই

Durga Puja: সে সময় ব্রিটিশ বিরোধিতাই ছিল বহু পুজোর 'থিম'। কোথাও কোথাও আবার মহিষাসুরের মুখ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের আদলযুক্ত করা হতো।

অন্যায়, অনাচার ঠেকাতে, পদদলিতকে রক্ষা করতে মর্ত্যে আসেন দেবী দুর্গা। কারও কাছে সেই আবির্ভাব ঘরের মেয়ের ঘরে ফেরা, আর কেউ এখান থেকেই খুঁজে নেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বীজমন্ত্র। ঠিক যেমনটা হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলিতে। ব্রিটিশ বিরোধী দামাল ছেলেদের দশহাতে আশীর্বাদ করে, সমরসাজে সাজিয়ে রণাঙ্গণে পাঠিয়েছিলেন দেবী দুর্গা। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলন জোরদার করতে, দেশবাসীকে একত্রিত করতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করতেন বাংলার বিপ্লবীরা। দুর্গাই হয়ে উঠেছিলেন দেশমাতৃকা। সর্বজনীন দুর্গাপুজোর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। আর বিজয়া দশমী হয়ে উঠেছিল ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের অঙ্গীকার।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পরেই সম্ভবত দুর্গাপুজোয় গুরুত্বপূর্ণ বদল আসে। স্বদেশী আন্দোলনের ব্যপ্তি বাড়াতে এই উৎসবই বিপ্লবীদের কাছে হয়ে ওঠে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার। প্রায় প্রতিটা পুজোর বিজ্ঞাপনেই নজরে আসে ‘নাথিং বিদেশি, এভরিথিং স্বদেশী’ জাতীয় পাঞ্চলাইন। সকলের জন্য এবং সকলকে নিয়ে সর্বজনীন দুর্গাপুজোর ধারণাটিও শুরু হয় এই সময় থেকেই। বলা হয়, উত্তর কলকাতার মানিকতলাতেই প্রথম স্বদেশী ভাবনায় সর্বজনীন দুর্গাপুজোর শুরু, সেই সময় যার ডাকনাম ছিল ‘কংগ্রেস পুজো'।

আরও পড়ুন- বাঙালিয়ানার টইটম্বুর দুই রাজধানী, স্বাধীনতার আগে থেকেই পালিত হয় দিল্লির বাঙালিদের দুর্গাপুজো

সে সময় ব্রিটিশ বিরোধিতাই ছিল বহু পুজোর 'থিম'। কোথাও কোথাও আবার মহিষাসুরের মুখ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের আদলযুক্ত করা হতো। এতে ব্রিটিশ সরকার এতটাই আতঙ্কিত হয়েছিল যে, কিছু বারোয়ারি পুজোকে বেআইনি ঘোষণা করেছিল। 

দুর্গাপুজোর মধ্যে দিয়েই স্বনির্ভরতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে আয়োজন করা হতো ‘স্বদেশী মেলা’। বিদেশি পণ্য বর্জন করে দেশীয় দ্রব্য বিক্রি শুরু করা হয় এখান থেকেই। ১৯২৯ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ‘বাগবাজার সর্বজনীন’ পুজোয় আয়োজন করা হয় স্বদেশী মেলা।

ইতিহাসবিদের মতে, দুর্গার চরিত্র বদলের পিছনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘আনন্দমঠে'র (১৮৮২ সালে লেখা) ভূমিকা অসামান্য। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসেই দুর্গাকে বা বলা ভালো শক্তির বিভিন্ন মৃণ্ময়ীরূপকে আন্দোলনকারীরা কীভাবে দেশের সঙ্গে একই স্থানে রাখছেন তা স্পষ্ট। উপন্যাসে ব্যবহৃত ‘বন্দেমাতরম' গান বিপ্লবীদের লড়াইয়ের অন্যতম মন্ত্র। বাঙালি-চালিত প্রেসগুলিতে দুর্গা প্রতিমার ছবির উপর বহু দেশাত্মবোধক গান ছাপা হয়।

আরও পড়ুন- বাগবাজারের পুজোয় ৫০০ টাকা চাঁদা দেন নেতাজি, লাঠিখেলার যে ইতিহাস অনেকেরই অজানা

এছাড়া আয়োজিত হতো ‘বীরাষ্টমী উৎসব’। যেখানে লাঠি, তরোয়াল নিয়ে ক্রীড়া প্রদর্শনী হতো। আসলে তরুণ বিপ্লবীদের সংগ্রামের জন্য গোপনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। সেই শিক্ষার বার্ষিক পরীক্ষাও বলা যেতে পারে এটিকে। অনেক সর্বজনীন পুজো (দক্ষিণ কলকাতার আদি লেকপল্লীর পুজো, মধ্য কলকাতার ৪৭ পল্লীর পুজো, উত্তর কলকাতার বাগবাজার, কুমোরটুলি, সিমলা ব্যায়াম সমিতি)-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নেতাজী। যেগুলি ছিল বিপ্লবীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়।

এমনকি সেসময় থিয়েটারের মঞ্চেও ধ্বনিত হতো স্বাধীনতার চেতনা। ১৯৩৯ সাল (৯ কার্তিক, ১৩৪৬), ষষ্ঠীর দিন মিনার্ভা মঞ্চে অভিনীত হয় মহেন্দ্র গুপ্তের ‘দেবী দুর্গা’ নাটক। যেখানে কাজী নজরুল ইসলামের গানে দেবী বন্দনার পাশাপাশি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে হুঙ্কার বেজে ওঠে। মনে রাখতে হবে, কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ বিরোধী দুর্গাস্তব আনন্দময়ীর আগমনে লিখেই কারাবরণ করেন।

প্রতিবাদের ঢেউ পৌঁছয় সুদূর আন্দামানেও। আন্দামান সেলুলার জেলেও দুর্গাপুজোর আয়োজনে মেতে ওঠেন বিপ্লবীরা। দীর্ঘদিনের আন্দোলন, অনশন, ধর্মঘট করে ১৯৩৩ সালে সেলুলার জেলে দুর্গাপুজোর সুযোগ পেয়েছিল বন্দিরা। ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশরা কারাগারে পুজো পালন বিধিনিষেধ আরোপ করে, কিন্তু তারপরও দুর্গাপুজো বন্ধ করা যায়নি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে দুর্গোৎসব ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক অঙ্গন।

বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে, মিষ্টিমুখ করে আজ আরেকবার, স্বদেশি পণ্যকে বেছে নেওয়ার, স্বদেশী উদ্যোগকে উৎসাহিত করার ডাক দেওয়া হোক, আমরা দেবী দুর্গার স্নেহচ্ছায়ায় আত্মনির্ভর আর স্বাধীন হয়ে উঠি।

ভারতের প্রথম বাণিজ্য সমন্বয় প্ল্যাটফর্ম (Business collaboration platform)  কোল্যাব (Colab)। আসুন কোল্যাব ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে আমরা স্বদেশীমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে উঠি।

বিস্তারিত জানতে (https://www.nexaei.com/) ওয়েবসাইটটি দেখুন।

More Articles