নিস্তারিণী থেকে ডাকাত কালী, ঐতিহ্যে মোড়া কালীতীর্থ হুগলি

Hooghly Kali Mandir: মায়ের হাতে খড়গ নেই। রয়েছে তরবারি। শেওড়াফুলির আদি নাম সাড়াফুলি। রাজা হরিশচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। কষ্টিপাথর দিয়ে মূর্তি নির্মাণ করা হয়।

বাংলার ঐতিহ্যশালী জেলা হুগলি। রাজা রামমোহন রায়, রাসবিহারী বসু ঋষি অরবিন্দর স্মৃতি বিজড়িত এই হুগলিতেই রয়েছে একাধিক ঐতিহ্যশালী কালী মন্দির। তার মধ্যে বহুল চর্চিত বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী কালী মন্দির। এর পাশাপাশি এমন কালী তীর্থ এই জেলায় রয়েছে যা বাংলার আধ্যাত্বিক চেতনাকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু প্রচারের আলো থেকে তা দূরেই থেকে গিয়েছে।

রামপাড়ার নন্দীদের কালী মন্দির:

মন্দিরের শরীরে ইউরোপীয় শৈলীর ছোঁয়া। আর মন্দিরের ভেতরে বাংলার খিলান বিশিষ্ট চালচিত্রের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সিদ্ধেশ্বরী কালী। নিম কাঠের তৈরি এই বিগ্রহ ঐতিহ্যের সাক্ষী বহন করে চলেছে। কালী পুজোর রাতে মাকে নৈবেদ্যতে দেওয়া হয় ফল, সন্দেশ, নাড়ু, আতপ চাল, উত্তর প্রদেশের বেনারস থেকে আনা হালকা হলুদ রঙের চিনি। পাঁঠার পাশাপাশি চাল কুমড়ো, আখও বলিপ্রদত্ত। হুগলি জেলার ফুরফুরা থানার অন্তর্গত রামপাড়ার ঐতিহ্যবাহী নন্দী বাড়িতে প্রায় ২০০ বছর ধরে এভাবেই কালী সাধনা হয়ে আসছে।

Hooghly Kalipuja

নন্দী বাড়ির সিদ্ধেশ্বরী কালী

পরিবারের বর্তমান বংশধর পলাশ নন্দীর কথায়, তাদের পরিবারে কালী সাধনা শুরু করেন ফকির নন্দী। প্রথমে বেড়া ও খড়ের ছাউনি দিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে তার রূপান্তর ঘটে ইউরোপীয় শৈলীতে গড়ে ওঠা মন্দিরে। কালী পুজো ছাড়াও প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যা নিত্য পুজো হয়ে থাকে। প্রতিমাসে অমাবস্যার দিন বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। কালীপুজোর যাবতীয় আয়োজন পরিবারের মহিলারা করে থাকেন। এখানে শাক্ত মতে পূজিতা হন মা কালী। ২০১৬ সালে শেষবার প্রতিমাকে অঙ্গরাগ করানো হয়। নিকষ কালো কালীর মূর্তির শরীরে নকশা করা লাল শাড়ি। প্রতিমার হাতের গঠন ঋজু। প্রসারিত লাল টকটকে জিহ্বা আর শান্ত ত্রিনয়নের মধ্যে দেবী প্রতিমার অভিব্যক্তির এক অদ্ভুত বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। প্রতিমার কানের দিক থেকে একজোড়া হলুদ গাত্রবর্ণ পুরুষ মূর্তি বেরিয়ে রয়েছে। এই দুটি মূর্তি করজোড়ে মাকে প্রণাম জানাচ্ছে।

Nandibari Kali

ইউরোপীয় শৈলীতে গড়ে ওঠা রামপাড়ার নন্দীদের কালী মন্দির

নন্দী পরিবারের এক বর্ষীয়ান সদস্য জানালেন যে এটি আদতে শুম্ভ নিশুম্ভ। অন্যদিকে চালচিত্রের মধ্যে বিরাজ করছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, শ্রীকৃষ্ণ রামচন্দ্র-সহ অন্যান্য দেবতা। মন্দির গাত্রে ধুমাবতী, গজলক্ষ্মী কালী, বগলাদের মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। এর পাশাপাশি ইউরোপীয় শৈলীর ডানাওয়ালা পরী হাতে মালা নিয়ে মন্দির গাত্রে উড়ে বেড়াচ্ছে। মন্দির গাত্রের অন্যান্য অলংকরণের মধ্যেও ইউরোপীয় ফ্রেস্কো শৈলী লক্ষণীয়। মন্দির চত্বরের মধ্যে আরও একটি ছোট মন্দির রয়েছে। সেখানেই বিরাজ করছেন জগন্নাথ সুভদ্রা বলভদ্র। নন্দীবাড়ির ঐতিহ্যের রথযাত্রা হুগলি জেলার গর্ব।

আরও পড়ুন- নাম ঢাকার, ঘর কলকাতায়; কলকাতার ‘ঢাকা কালীবাড়ি’ রহস্য

শেওড়াফুলি নিস্তারিণী কালী মন্দির:

১২৩৪ বঙ্গাব্দে বর্ধমানের পাটুলি রাজবংশের রাজা হরিশচন্দ্র রায় হুগলি জেলার গঙ্গা তীরবর্তী শেওড়াফুলিতে নিস্তারিণী কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে এই মন্দিরে এসে পুজো দিয়েছিলেন রানী রাসমণি। নিস্তারিণী কালী মন্দিরের কালী প্রতিমার আদলে তিনি পরবর্তীকালে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কালীপুজোর দিন লুচি, পাঁচ রকমের ভাজা, তরকারি, পোলাও, খিচুড়ি মাকে ভোগে নিবেদন করা হয়। প্রথা মেনে ছাগবলিও দেওয়া হয়। কালী পুজোর দিন হুগলি জেলা ও উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ এসে মাকে পুজো দেন। মায়ের হাতে খড়গ নেইরয়েছে তরবারিশেওড়াফুলির আদি নাম সাড়াফুলিরাজা হরিশচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেনকষ্টিপাথর দিয়ে মূর্তি নির্মাণ করা হয়রানী রাসমণি যখন গঙ্গায় নৌকো করে মন্দিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেনতখন তিনি এই মন্দির দেখতে পেয়ে এখানে পুজো দেনদক্ষিণেশ্বরের মন্দির নির্মাণশৈলীগঠনে নিস্তারিণী কালীবাড়ি মন্দিরে প্রভাব রয়েছে

Sheorafuli Nistarini Kali

শেওড়াফুলি নিস্তারিণী কালী মন্দির

ত্রিবেণী বাসুদেবপুর ডাকাত কালীমন্দির:

শেষ সপ্তক কাব্যগ্রন্থের ৩২ নম্বর কবিতায় রঘু ডাকাতের মানবিক রূপ তুলে ধরেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর্তের হয়ে লড়াই করেছিলেন রঘু ডাকাত। সেই রঘু ডাকাতেরই স্মৃতি বিজড়িত কালী মন্দির হচ্ছে, হুগলি জেলার ত্রিবেনীর বাসুদেবপুর কালীতলার ডাকাত কালীমন্দির। কথিত আছে বিধু ভূষণ ঘোষ ওরফে বিধু ডাকাতের সঙ্গে সখ্যতা ছিল রঘুর। জমিদার ও সমাজের প্রভাবশালীদের প্রাসাদ ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে এখানেই মা কালীর পুজো করতেন রঘু ও বিধু। তারপর ডাকাতির অর্থ গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।

Tribeni Basudev Kali Mandi

ত্রিবেনীর বাসুদেবপুরের ডাকাত কালী

আনুমানিক প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো ত্রিবেনীর এই কালী তীর্থ। জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশের মধ্যে মায়ের পুজো হতো। সেই সময় দুপুর হলে এই তল্লাটে কেউ আসতেন না। কথিত রয়েছে ভুলবশত ডাকাতরা রামপ্রসাদকে বন্দী করে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। এই মন্দির প্রাঙ্গণে থাকা বট গাছের নিচে সাধনা করতেন সাধুমা নামে এক সাধিকা। মা এখানে দক্ষিণা কালী রূপে পূজিতা। খড়গের বদলে তলোয়ার রয়েছে তাঁর হাতে। প্রতিদিন এখানে নিত্য পুজো হয়। মন্দিরের প্রবেশের পথেই রয়েছে রঘু ও বিধু ডাকাতের মূর্তি। এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে পুকুর। কালীপুজোর দিন এখানেই মানুষ স্নান করে দণ্ডী কাটে।

Raghu Dakat Kali Mandir

ত্রিবেণী বাসুদেবপুর ডাকাত কালীমন্দির

সিঙ্গুর পুরুষোত্তমপুর ডাকাত কালীমন্দির:

এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গগন ডাকাতের নাম। বর্তমানে মন্দিরটি যেখানে অবস্থিত সেখানে আগে মা কালীর ঘট পুজো হতো। মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে চালতেপাতির মোড়ল মন্দির তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বর্ধমানের মহারাজ। আটচালা ও তিন খেলানবিশিষ্ট এই মন্দিরে বিরাজ করেন বামা সিদ্ধেশ্বরী মা কালী।

Singur Purushottompur Kali Mandir

সিঙ্গুর পুরুষোত্তমপুর ডাকাত কালীমন্দির

মন্দির চত্বরের মধ্যেই একটি ছোট মন্দিরে শিবের উপাসনা করা হয়। বর্তমান মন্দির কর্তৃপক্ষের মতে প্রায় ৫০০ বছর ধরে এখানে মাতৃকা সাধনা হয়ে আসছে। মায়ের প্রতিমা মাটি দিয়ে তৈরি। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অঙ্গরাগ করা হয়ে থাকে। কালের নিয়মে মন্দির গাত্র থেকে পোড়ামাটির কারুকার্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মন্দিরের আধ্যাত্মিক মহিমা আজও সমানভাবে স্থানীয়দের মধ্যে জনপ্রিয়।

More Articles