রাইরাজা সাজে রাধা, শান্তিপুর থেকে মণিপুর, রাসের রূপমাহাত্ম্য

Rash Purnima 2025: ভক্তের সঙ্গে ভগবানের একান্ত মিলন এই রাস। বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে, দ্বাপরে কৃষ্ণের সমস্ত লীলার মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট লীলা হলো রাস। শান্তিপুর এবং নবদ্বীপ ছাড়া মণিপুরেও পালিত হয় এই উৎসব।

'রস্যতে অনেন ইতি রাস্যঃ' অর্থাৎ যার দ্বারা রস জন্মায় তাই-ই রাস। এই রস হল সার নির্যাস, আনন্দ, আহ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম। নবরসের মধ্যে মূলত 'মধুর' রসেরই প্রাধান্য থাকে রাসে। যা দেখবার জন্য দেবদেবীরা সকলেই নাকি খুব উৎসুক থাকতেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কোনও পুরুষের প্রবেশ ছিল সেখানে। পরম বিষ্ণুভক্ত শিব একবার কৌতূহল দমন না করতে পেরে গোপিনীর ছদ্মবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন বৃন্দাবনে। সেদিন ছিল কার্তিক পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় থই থই করছিল নিধুবন (মতান্তরে নিধিবন)। যমুনার পারে রাধা-সহ গোপিনীরা তখন এক অলৌকিক নৃত্যে রত তাদের প্রিয় কৃষ্ণের সঙ্গে। হঠাৎ তাল ভঙ্গ হলো। শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পারলেন, তিনি ছাড়াও আরও একজন পুরুষ উপস্থিত হয়েছেন সেখানে। জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের যে দৃশ্য কারও দেখবার কথা নয়, সেখানে এমন অনভিপ্রেত ঘটনা দেখে রাস ভেঙে চলে গেলেন শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু রাজা বিনা রাজ্য কীভাবে চলবে? তখন সব গোপিনীরা মিলে সেদিন রাধাকে পরালেন রাজবেশ, সাজিয়ে তুললেন কৃষ্ণের সাজে। সেই একদিন কৃষ্ণের বদলে রাই রাজা হয়েছিল।

Rai Raja

রাইরাজা নগর পরিভ্রমণে, ছবি তুলেছেন রথীন দে

সেই থেকে আজও রাস উৎসবে প্রায় প্রতিটি গোস্বামী বাড়ির বিগ্রহের সঙ্গে চলেন রাইরাজা, নগর পরিভ্রমণে। শান্তিপুরের ভাঙা রাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য রাধার এই 'রাইরাজা' রূপ। ব্রাহ্মণ পরিবারের কোনও সুন্দরী মেয়েকে বিশেষত বালিকা বা সদ্য কিশোরীকে নব-বধূবেশে সাজিয়ে অন্যান্য গয়নার সঙ্গে ফুলের গয়না পরিয়ে সাজিয়ে গোটা শহর ঘোরানো হয় আজও। বেলোয়ারি কাচের ঝাড়লন্ঠন আর ফুল দিয়ে সাজানো হাওদায় প্রথমে থাকে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি, তার পেছনে থাকে রাইরাজা। তার পেছনে দুটি কিশোর-কিশোরী রাধা-কৃষ্ণ সাজে এবং এর পেছনে থাকে ময়ূরপঙ্খী, ময়ূরের আকৃতির একটি চতুর্দোলায় দুজন পুরুষ বোষ্টম বোষ্টমী সেজে নাচতে নাচতে গান গায়। ময়ূরপঙ্খীর এই গান উনিশ শতকের লোকসংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এরপরে আসে সঙ বা অন্যান্য মূর্তি। শান্তিপুরের সঙ খুবই বিখ্যাত। জীবিত মানুষ কোনও পৌরাণিক চরিত্র সেজে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। খুব ভালো ভাবে খেয়াল না করলে তা মাটির মূর্তি নাকি সত্যিকারের মানুষ তা বোঝা কঠিন। এর সঙ্গে থাকে ঢাক এবং অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র আর হরেক কিসিমের আলোর বাহার। 

Rasmancha

রাসমঞ্চ, ছবি তুলেছেন রথীন দে

শান্তিপুরের রাস মূলত তিনদিনের। তিনদিনে তাঁর তিনরকম বেশ। রাজবেশ, রাখালবেশ এবং ফুলবেশ। তৃতীয়দিনে অর্থাৎ ভাঙারাসে ফুলবেশে সেজে শ্রীমতি রাধারানীর সঙ্গে তিনি দেবালয় ছেড়ে পথে নামেন। দ্বাপরে যে রাস স্বয়ং দেবাদিদেবও দেখার অনুমতি পাননি, কলিতে সেই উৎসব সকলকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন শ্রীঅদ্বৈতাচার্য, তাঁকে শিবের অবতার বলা হতো। দ্বাপরের সেই ভেঙে যাওয়া রাস পূর্ণ হলো কলিতে এসে। অদ্বৈতাচার্যের বংশজরাই পরবর্তীকালে ছড়িয়ে পড়েছেন শান্তিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে, প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজ নিজ কুলবিগ্রহ, প্রতিটি বাড়ির কৃষ্ণের নাম ভিন্ন। যেমন, বড় গোস্বামী বাড়িতে তিনি রাধারমণ জীউ। কোথাও তিনি মদনগোপাল, আবার কোথাও তাঁর নাম গোকুলচাঁদ।

Gokulchand

গোকুল চাঁদ জীউ, ছবি তুলেছেন রথীন দে

বড় গোস্বামী বাড়ির এই রাধারমণের মূর্তিটির ঐতিহাসিক মূল্যও বড়ো কম নয়। শোনা যায়, পুরীর রাজা ইন্দ্রদুম্ন্যের প্রাসাদে দোলগোবিন্দ নামে পুজো হতো কষ্টি পাথরের এই কৃষ্ণমূর্তির। তারপর বারো ভুঁইয়ার অন্যতম বসন্ত রায় মূর্তিটি এনে নিজের বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ বারো ভুঁইয়াদের শায়েস্তা করার জন্য বাংলা আক্রমণ করলে সেই মূর্তির ক্ষতির আশঙ্কায় যশোরাধিপতি বসন্ত রায় ওই বিগ্রহকে তুলে দেন গুরুদেব মথুরেশ গোস্বামীর হাতে। এই মথুরেশ গোস্বামী ছিলেন অদ্বৈতাচার্যের পৌত্র। মথুরেশ গোস্বামী সেই দোলগোবিন্দকে শান্তিপুরে এনে নিজের বাড়িতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন রাধারমণ রূপে।

Kunjabhanga

কুঞ্জভঙ্গ, ছবি তুলেছেন রথীন দে

ভাঙা রাসের পরের দিন সকালে প্রতিটি গোস্বামী বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় 'কুঞ্জভঙ্গ', অর্থাৎ, কুঞ্জবনে যে রাসলীলা শুরু হয়েছিল নৃত্যের মাধ্যমে, নাট-মন্দির থেকে মূল মন্দিরে ফেরবার আগে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতির যুগল-নৃত্যে তার পরিসমাপ্তি হয়। বিগ্রহকে কোলে নিয়ে ভক্তদের মাঝে নাচানো হয়, এসময় যেকোনও ভক্ত চাইলে ভগবানকে ছুঁয়ে প্রণাম করতে পারে।

নবদ্বীপ থেকে মণিপুর
নবদ্বীপের রাস অবশ্য বৈষ্ণবীয় রাস নয়। এখানে রাসে নানা শাক্ত দেবদেবীর পুজো হয়। দেড়শোর বেশি বিরাট আকারের শাক্ত দেবদেবীদের মূর্তিপুজোর পেছনে ছিলেন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। নিজে শাক্ত ছিলেন বলেই হয়তো চাইতেন তাঁর রাজত্বে শক্তি-আরাধনা বাড়ুক। বিশাল আকারের এসব মাটির মূর্তি যারা তৈরি করতেন, তাদের শিল্পকলার বিচার করে তিনি পরে বিভিন্ন পুরষ্কার দিতেন। প্রতি বছর এক বিশাল সংখ্যক পূণ্যার্থীদের দল নবদ্বীপে
'বসা রাস' দেখে মাঝের রাস থেকে আসতে শুরু করেন শান্তিপুরে। তারপর ভাঙারাসের শোভাযাত্রা দেখে ফিরে যান কেউ কেউ। কেউ আবার রকমারি পসরা সাজিয়ে বসেন পরবর্তী একমাসব্যাপী রাসের মেলায়।

Majher Ras

মাঝের রাস, ছবি তুলেছেন রথীন দে

ভক্তের সঙ্গে ভগবানের একান্ত মিলন এই রাস। বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে, দ্বাপরে কৃষ্ণের সমস্ত লীলার মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট লীলা হলো রাস। শান্তিপুর এবং নবদ্বীপ ছাড়া মণিপুরেও পালিত হয় এই উৎসব। মণিপুরী নৃত্যের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে নানা ধরনের উপাখ্যান জড়িয়ে আছে। এই উপাখ্যানগুলোও মণিপুরী নাচের মতোই চিরায়ত কাহিনীতে পরিণত হয়েছে। মণিপুরীদের নৃত্যগীতের প্রাচীন নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয় ‘লাউহারাউবা’ নৃত্যকে। ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পামহৈবা মণিপুরের রাজত্ব লাভের পর সেখানে বৈষ্ণবদের আধিপত্য প্রবলতর হয়রামানন্দীর ভাবাদর্শে বিশ্বাসী বৈষ্ণব-সাধক শান্তি দাস অধিকারীর অনুপ্রেরণায় রাজা পামহৈবা বৈষ্ণব মত গ্রহণ করেনএরপর তিনি তাঁর মতকে একরকম জোর করেই মণিপুরে প্রতিষ্ঠা করেনফলে এই অঞ্চলে শৈবমতাদর্শ একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়েরাজা পামহৈবা অন্য মতের গ্রন্থনিদর্শনও ধ্বংস করে দেন বলে জানা যায়মণিপুরের বৈষ্ণবরা শিবের পুজোও করতেনফলে শিব-পার্বতীর লীলাভিত্তিক নৃত্যগীত বিলুপ্ত হয়ে গেল না বটে, কিন্তু বৈষ্ণবভক্তির প্রাবল্যে অন্যান্য দেবদেবীরা গৌণ হয়ে গেলেন

Manipuri Rash Leela

মণিপুরী রাসনৃত্য

নর্তনরাস

১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা চিঙ্‌থাঙ খম্বা বা ভাগ্যচন্দ্র সিংহের শাসনামলে মণিপুরের নৃত্যগীত শিল্প চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছয়তাঁর চেষ্টায় মণিপুরে রাসনৃত্যের প্রবর্তন হয়কথিত আছে, রাজা স্বপ্নে রাসলীলা করার আদেশ পেয়েছিলেনশ্রীকৃষ্ণ নাকি স্বপ্নে তাঁকে জানান, রাজকন্যা বিম্ববতীমঞ্জরীকে রাধা সাজিয়ে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিমণ্ডলীর ভিতরে রেখে নৃত্যলীলা করতে হবেরাজা তাঁর কন্যাকে রাস-নৃত্য শিখিয়ে, স্বপ্নের আদেশ পালন করেনকালক্রমে এই নৃত্য রাসনৃত্য নামে মণিপুরে ছড়িয়ে পড়েতবে এই কাহিনির কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। 

আরও পড়ুন- তন্ত্র ও ভক্তির সেতুবন্ধন: শান্তিপুরের কালী আরাধনার ইতিহাস

শৈবযুগে রাসনৃত্য পৃথক নৃত্যশৈলী হিসেবে বিকশিত না হলেও, তালরাস, দণ্ডরাস এবং মণ্ডলরাসের প্রচলন ছিল। ভাগ্যচন্দ্র সিংহ রাসনৃত্যকে নাট্যাঙ্গিকে সাজানতিনি এই বিষয়ে রচনা করেন 'গোবিন্দ সঙ্গীত লীলাবিলাস'। এই গ্রন্থে নাট্যকে রূপক (প্রাচীন নাট্য) ও রাসক (নৃত্যনাট্য) পর্যায়ে বর্ণনা করেছেনআগে রাসলীলায় গান, নাচ এবং অভিনয় ছিলকিন্তু সুসমন্বয়ে তা গ্রথিত ছিল নাতিনি এই গ্রন্থের রাসক অধ্যায়ে রাসনৃত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকপদ্ধতি লিপিবদ্ধ করেনএই গ্রন্থানুসারে রাস নৃত্যকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করেনএই ভাগগুলো হলো মহারাসক, মঞ্জুরাসক, নিত্যরাসক, নির্বেশরাসক ও গোপরাসক।

Bisuddha Panjika

বর্তমানে এই রাসকগুলো মহারাস, বসন্তরাস, নিত্যরাস, কুঞ্জরাস, গোপরাস বা গোষ্ঠরাস এবং উলুখল রাস নামে পরিচিত। রাজ ভাগ্যচন্দ্রের পৌত্র চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে বসেন ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর সময়ে রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। তিনি প্রথম নর্তনরাসের প্রবর্তন করেন এবং বিলুপ্তপ্রায় 'লাইহারাউবা' নৃত্যকেও ফিরিয়ে আনেন। কালক্রমে জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রমুখ বৈষ্ণব পদকর্তাদের প্রভাব পড়ে রাসলীলার বাণী অংশে। অন্যদিকে বাংলার কীর্তনের প্রভাব পড়ে এর সুরে।

রাস উৎসবকে ফিরে পাওয়া হয়নি বলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আক্ষেপ ছিল, "তেত্রিশ বছর কেটে গেলেও কেউ কথা রাখেনি।" তবে এই আক্ষেপ না রাখাই ভালো। কে কবে কথা রাখবে তার অপেক্ষায় না থেকে 'নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান'-এর এই ভারতকে চিনতে হলে একবার হলেও ধরতে হবে আস্তিক্যের এই পথটি। 

More Articles