তন্ত্র ও ভক্তির সেতুবন্ধন: শান্তিপুরের কালী আরাধনার ইতিহাস

Kali Puja in Santipur: দুই ভিন্ন ধারা— শাক্ত এবং বৈষ্ণবের মিলনক্ষেত্র এই প্রাচীন নগরী। ইতিহাস, লোকাচার, ঐতিহ্য, আবেগ মিলেমিশে এখানে এ'সময় তৈরি হয় এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ।

নগরের দক্ষিণে গঙ্গা। গঙ্গার প্রবাহ দক্ষিণমুখী। তার সন্নিকটে যে শ্মশান, তা মহাশ্মশান। দিবারাত্র দাহ হয়ে চলেছে শব। যে শক্তি বিনা শিব শব, তাঁর আরাধনার ইতিহাস এখানে বহু প্রাচীন। কখন‌ও শ্যামা রূপে কখন‌ও বামা রূপে। অথচ রাসপূর্ণিমার তিথিতে রাধাকৃষ্ণের লীলা দেখবার জন্যও ভক্তিরসে ডুবুডুবু হয় সে নগর। দুই ভিন্ন ধারা শাক্ত এবং বৈষ্ণবের মিলনক্ষেত্র এই প্রাচীন নগরী। ইতিহাস, লোকাচার, ঐতিহ্য, আবেগ মিলেমিশে এখানে এ'সময় তৈরি হয় এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ।

অদ্বৈত আচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামী তাঁর মেয়ের হাতটি তুলে দিয়েছিলেন বৃহৎ তন্ত্রসারের রচয়িতা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র সার্বভৌম আগমবাগীশের হাতে। উদ্দেশ্য ছিল শাক্ত এবং বৈষ্ণব ধারার সহাবস্থান। তাঁর দূরদর্শিতার ফল আজকের শান্তিপুর। মথুরেশ গোস্বামীর অনুরোধে ও সহায়তায় সার্বভৌম নবদ্বীপ ছেড়ে এসে সাধনা শুরু করেছিলেন শান্তিপুরে। গোস্বামীদের বাটি থেকে কিছু দূরে স্থাপন করেছিলেন পঞ্চমুন্ডির আসন। নরকপাল ছাড়াও এই আসনে আরও চারটি প্রাণীর কপালের প্রয়োজন হয়। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করার পর স্বপ্নাদেশ পেয়ে শুরু করেছিলেন এই পুজো। তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সর্বপ্রথম আদি দক্ষিণাকালীর রূপটি দেখেছিলেন স্বপ্নে। যে মূর্তি গৃহস্থ সাধারণের পূজ্য সেই সৌম্য রূপটি। সার্বভৌম এখানে প্রতিষ্ঠিত করেন দক্ষিণাকালীর সেই মূর্তি, যাঁকে একবার চোখের দেখা দেখবেন বলে ভিড় জমান অগণিত মানুষ। কালীর ধ্যানমন্ত্রে কানের দু-পাশে যে শব-শিশু থাকবার কথা, অন্যান্য স্থানে তা সবসময় দেখা না গেলেও এই মূর্তিতে তা দৃশ্যমান। আগমের ঈশ্বরী তিনি, তাই মানুষ তাঁকে আগমেশ্বরী নামেই চেনে। বর্তমানে মথুরেশ গোস্বামীর বংশধররাই এই পুজোর ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছেন।

তিনি যখন বিসর্জনের পথে র‌ওনা হন, সে দৃশ্য অকল্পনীয়। মিশকালো অন্ধকারে ডুবে যায় চারপাশ। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ সংযোগ। বাতাস‌ও যেন স্তব্ধ। কিছুক্ষণ পরে দূরে দেখা যায় এক আলোর বিন্দু। ক্রমে দৃশ্যমান হয় মশালের আগুন। অন্ধকারের বুক চিরে শোনা যায় ঢাকের এক অদ্ভুত শব্দ। ঢাকের চিরাচরিত চেনা শব্দের চেয়ে এ একেবারেই আলাদা। উলুধ্বনি জানান দেয় তাঁর বহু প্রতীক্ষিত আগমনবার্তা। তিনি চলেছেন বিসর্জনের পথে। আগুনের রঙ তখন তাঁর সর্বাঙ্গে। জগতে কোথাও আর কিছুই যেন থাকে না, অন্ধকারের মধ্যে আলো হয়ে থাকেন তিনি এবং সামনে তাঁর ভক্ত।

Mahishkhagi

মহিষখাগী, ছবি তুলেছেন রথীন দে

আরেকজন নবমুন্ডের (অন্যমতে পঞ্চমুন্ড) উপর অধিষ্ঠাত্রী। এক তান্ত্রিককে স্বপ্নাদেশে বলেছিলেন, মহিষের রক্ত দিয়ে তাঁর পুজো করতে হবে। সেই থেকে তাঁর পুজোর শুরু। একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে ১০৮টি মহিষ বলি দেওয়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষ করতে সময় প্রায় ভোর হয়ে যায়। ফলত পুজো ভাগ করতে হয় দুভাগে। পুজোর দিন ভোরবেলায় মায়ের দধিমঙ্গল হয়, তারপরে শুরু হয় প্রথমভাগের যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় ভাগ হয় পরের দিন, সেদিন মাকে ভোগ দেওয়া হয় পান্তা ভাত এবং খয়রা মাছ দিয়ে। বিকেলবেলায় ভক্তদের কাঁধে চেপে তিনি চলেন নিরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। পথে থামার নিয়ম নেই, বিরাটাকার মাতৃমূর্তি নিয়ে বেহারারা দৌড়ে চলে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে চলেন ভক্তরা। আগমেশ্বরী এবং মহিষখাগীর নিরঞ্জনের সময় এবং পথ কিছু ভিন্ন। শোনা যায়, এঁরা যতবার মুখোমুখি হয়েছেন, দূর্ঘটনা ঘটেছে।

Agmeswari

আগমেশ্বরী, ছবি তুলেছেন রথীন দে

বর্তমানে গঙ্গা সরে গেছে অনেকটাই কিন্তু একসময় ঘাটের পাশে যন্ত্রে পূজিত হতেন ঘাটচাঁদুনী। একচন্দ্রে উষাকালে ঘাটের পাশে পুজো হতো বলে মায়ের নাম ঘাটচাঁদুনী। লিখিত ইতিহাসে রয়েছে ৮৯২ বঙ্গাব্দের উল্লেখ। প্রথমে মা শ্মশানকালী রূপে পুজো পেলেও এখন নিজের মন্দিরে দক্ষিণাকালীর আদি রূপটিতেই মায়ের মূর্তি রয়েছে। বিখ্যাত অভিনেতা নীতিশ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজো এটি। মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ায় এখানে ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে।

Ghat Chaduni

ঘাটচাঁদুনী, ছবি তুলেছেন অর্ধেন্দু দে

তবে আর‌ও দুজন চাঁদুনী মা আছেন শান্তিপুরে। যাঁদের নামেই সেই বাড়ির নাম চাঁদুনী বাড়ি। নবদ্বীপের কাশীনাথ সার্বভৌম শান্তিপুরে এই পুজোর প্রচলন করেন। তাঁর স্ত্রী স্বপ্নাদেশ পান পূর্ণিমাতে মায়ের মূর্তি তৈরি করার। আজও বাড়ির বড় বৌ সর্বপ্রথম মাটি দেন মায়ের মূর্তিতে। এবাড়ির বাইরে এবং ভেতরে যথাক্রমে বার-চাঁদুনী এবং ঘর-চাঁদুনীর পুজো হয়। এই পুজোর কিছু অভিনবত্ব রয়েছে। বাড়ির মেয়ের বিয়ের রীতিতে মাকে পুজো করা হয়। আগের দিন থেকে বসে নহবৎ। ভোগের সাজসজ্জাও দেখবার মতো। যতরকম ফল পাওয়া সম্ভব তা তো থরে থরে সাজানো থাকেই কিন্তু আবহাওয়ার কারণে যেসব ফল পাওয়া অসম্ভব, তাও থাকে। সন্দেশ দিয়ে বানানো সেসব ফল এবং আর‌ও নানারকম সামগ্রী সাজিয়ে মাকে ভোগ দেওয়া হয়। ঠিক যেমন ভাবে বিয়ের তত্ত্ব সাজানো হয়, তেমনি ভাবেই ভোগ সাজানোর নিয়ম এখানে। এখন‌ও পাঁঠাবলির রীতি রয়েছে, যদিও তার সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছে। পাটে ওঠানোর সময় এবং নিরঞ্জনের সময় বার বার থামিয়ে নিবেদন করা হয় বিভিন্ন রকমের ভোগ। যাত্রাপথে চামর দিয়ে বাতাস করা হয়, মায়ের যাতে কোনও কষ্ট না হয়। বাড়ির পুজোগুলি প্রায় প্রত্যেকটির ইতিহাস কমবেশি ৪০০-৫০০ বছরের।

Bar-Chaduni

বার-চাঁদুনী, ছবি তুলেছেন অর্ধেন্দু দে

দক্ষিণা কালী ছাড়াও এখানে ডাকাত কালী পুজোর যথেষ্ট রমরমা। মায়ের এই রূপে তাঁর বাঁ-পা প্রথমে থাকে শিবের উপর, তাই তিনি বামা। এবং শিব থাকেন আড়াআড়ি ভাবে। অর্থাৎ দক্ষিণাকালীর রূপের চেয়ে এই রূপ কিছুটা আলাদা। এই রূপের মিল রাখা হয়েছিল সিঙ্গুর রাজবাড়ির কালীমায়ের রূপের সঙ্গে। কিন্তু দক্ষিণাকালীর আরাধনার মধ্যে বামাকালীর এই আরাধনার ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে আছে বঙ্গভঙ্গের উত্তাল সময়। সে'সময় মানুষকে একত্রিত করার জন্য 'বোম্বেট মিলিটারি' বলে খ্যাত একদল তরুণ শুরু করে এই পুজো। দেশে তখন দাঙ্গা চলছে হিন্দু-মুসলমানের। একবার সেই পুজোর স্থান বদলায়, বাংলা স্কুল বলে একটি স্কুলের সামনে একবার সেই বোম্বেট কালীর পুজো হয়।

Bombet Kali

বোম্বেট কালী, ছবি তুলেছেন অর্ধেন্দু দে

তারপরের বছর আবার তিনি যথাস্থানে ফিরে গেলেও বন্ধ হয়নি ঐ পুজোটি। মহা সমারোহে বাংলা কালী নামে পুজো পান তিনি। তারপর থেকেই মায়ের ডাকাত কালী রূপের আরাধনা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। বর্তমানে শুধু এই রূপেই হয় অজস্র পুজো। যার মধ্যে অন্যতম হলেন চড়জিজিরা অঞ্চলের বামা কালী, নিরঞ্জনের পথে যাঁর নাচ এখন বহু মানুষের আবেগ।

Bama Kali

বিসর্জনের পথে বামা কালী, ছবি তুলেছেন অর্ধেন্দু দে

একটিমাত্র হ্যাচাকের আলোতেই পুজো হয় মায়ের। প্রত্যেকটি মূর্তিই কমবেশি ১৮ ফুটের মতো লম্বা হয়, এবং শান্তিপুরের অনন্য মৃৎশিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় যেন সকলেই জীবিত হয়ে ওঠেন। মায়ের অতি ভয়াল করালবদনী রূপকেও তাঁরা তুলির টানে ফুটিয়ে তোলেন অপূর্ব মাতৃ-রূপে।

Bangla Kali

বাংলা কালী, ছবি তুলেছেন অর্ধেন্দু দে

এছাড়াও রয়েছেন পক্কানেশ্বরী, যাঁর সবচেয়ে পছন্দের ভোগ হল পক্কান। আরও আছেন বুড়িমা, মা সিদ্ধেশ্বরী। এবং সাধনা কালী, মাধব কালী, পাতালকালী, গুলবাজ কালী, মুক্তকেশী নানা নামে নানারূপে পুজো পান মা। এক রাতে আরাধনা হয় প্রায় তিন সহস্রাধিক কালীমূর্তির। শুধু দ্বীপান্বিতা কালীপুজোতেই নয়, বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎসবের সঙ্গে এখানে কালী পুজো হয়। যেমন নৃত্যকালী, পটেশ্বরী প্রমুখ। বহুকালের পুরনো এক পটে আঁকা মায়ের মূর্তিই এখানে রাস-পূর্ণিমার সময় পুজো করা হয়।

Poteswari

পটেশ্বরী, ছবি তুলেছেন অর্ধেন্দু দে

দূর্গাপুজো শেষ হয়ে যখন হিম পড়া শুরু হয়, শান্তিপুরে খবর আসে, রাত জাগার দিন আসছে। আলোয় মালায় সাজানো শহর জেগে থাকবে দুদিন ধরে, মায়ের পুজো উপলক্ষ্যে। বৈষ্ণবদের ভূমি বলে পরিচিত অদ্বৈতাচার্যের শান্তিপুর ফিরে আসবে শক্তির আরাধনায়। কালীপুজো থেকে এ শহরটা একটু একটু করে বদলাতে থাকবে, প্রস্তুতি নেবে রাসের…

More Articles