পুজোর একাল: আড়ম্বরের অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছে উৎসবের আনন্দ?

Festival: মাত্র বছর দশেক আগেও যে ব্যাপারগুলো অতি সহজলভ্য ছিল না এবং যার জন্যে মানুষ পুজোর দিনগুলোর বা ছুটির অপেক্ষা করত গোটা বছরজুড়ে, তার অনেকটাই আজ জীবন-যাত্রার স্বাভাবিক অঙ্গ হয়ে উঠেছে।

চার দিনের উৎসবের পালা এবারের মতো শেষ! অতএব আবারও এক বছরের অপেক্ষা ও রুটিন মাফিক জীবনে ফিরে যাওয়ার অবসন্নতা হাত ধরাধরি করে তৈরি প্রতিবারের মতো। তবে, কোভিড পরবর্তী সময়ে অনেকেই অভিযোগ জানান যে, দুর্গা পুজোর উদ্দীপনা অনেকটাই ম্লান হয়ে আসছে। এই অভিযোগ কতটা যুক্তিযুক্ত তার সাক্ষ্য পেতে হলে যদিও জনসমীক্ষা ও তার ভিত্তিতে বিস্তৃত অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কিন্ত খুব সাধারণ ভাবে যদি লক্ষ্য করা যায়— তবে পুজোর আবেগে কিছুটা ভাঁটা যে একেবারেই পড়েনি তা জোর দিয়ে দাবি করতে হলে হয়তো অনেকেই দু'বার ভাববেন। এই আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে বলে রাখা ভালো যে সবার কাছেই পুজো বিশেষ ভাবে, নির্দিষ্ট আবেগ অনুভূতি নিয়ে হাজির হবে এমনটা ভাবা একেবারেই উচিৎ নয়। তবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের যে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠছে, তার প্রেক্ষিতে যদি কারোর মনে হয় যে, বাঙালির সবথেকে বড় উৎসব তার আবেদন কিছুটা হলেও হারিয়েছে বা হারাতে বসেছে, তবে সে ভাবনার যথেষ্ট কারণ রয়েছে কিনা তার আলোচনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে বলেই মনে হয়। এবং এর সাথে এও বলে রাখা উচিৎ যে সীমিত পরিসরে এই আলোচনা কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়েই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। উল্লিখিত দিক বা বিষয়ের বাইরেও যে একটি বিস্তৃত আলোচনার পরিসয় রয়ে যায় তা বলাই বাহুল্য।

পুজোর ঠিক আগেই কলকাতা শহর দেখেছে ভারী বৃষ্টিপাত ও বন্যার ভয়ানক বিপর্যয়। কলেজস্ট্রিট চত্বরে বোধনের আগেই দেখা গেছে বিসর্জনের মন খারাপ। লক্ষাধিক টাকার বই ভেসে যেতে দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। পুজো ও নতুন বইয়ের যে এক অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ, সেই যোগাযোগের সেতু অনেকটাই এখনও বিধ্বস্ত। বাংলাজুড়ে ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডব চলছে। উজান অসমের অনেকগুলো জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনও বন্যার কবল থেকে মুক্ত হয়নি। উত্তরাখণ্ড এবং পঞ্জাবের ভয়াবহ ফ্ল্যাশ ফ্লাড এবং তার ফলে নেমে আসা মৃত্যু মিছিল ও অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতির চিত্র এখনও ভেসে উঠছে মোবাইল, টিভির পর্দায়। এমনকি পুজোর দিনগুলোতেও বৃষ্টি ব্যাঘাত ঘটিয়েছে আমাদের পুজোর আনন্দে। স্নিগ্ধ, কুয়াশা ঘেরা, শিউলি মাখা যে শরতের ছবি আমরা বরাবর ভেবে এসেছি এবং দেখে বড় হয়েছি, সেই শরতের ছবি আজ প্রকৃতির রোষানলে অনেকটাই ম্লান। আমাদের প্রতিটি উৎসবের সাথে প্রকৃতি যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। প্রতিটি ঋতু নিশ্চুপে কিন্তু অপরিহার্য ভাবে আমাদের উৎসবের পটভূমি রচনা করে দেয়। তাই দুর্গা পুজোয় বৃষ্টি যেমন নিতান্ত অনাহুত আগন্তুক, ঠিক তেমনই সরস্বতী পুজোর ভোরে জমিয়ে ঠাণ্ডা না পরাও আমাদের কাছে মন খারাপের কারণ। তাই পুজো চলে আসা মানে গ্রীষ্ম-বর্ষার অনিশ্চিত চোখ রাঙানি পেরিয়ে যে স্থিতিশীল আবহাওয়ার নিশ্চয়তা, সেই ধারণা আজ পাল্টে গেছে। তার দায়ভারও যদিও আমাদেরই। প্রতিনিয়ত চোখের সামনে ভেসে ওঠা এত এত প্রাকৃতিক বিপর্যয়, ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানির খতিয়ান কোথাও কি আমাদের উদযাপনের সুরে আঘাত হানছে না? প্রত্যক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও, অবচেতন মনের কোথাও কি এত এত ধ্বংসের চিহ্ন মোটেই দাগ ফেলছে না? ভেবে দেখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলেই মনে হয়। 

আরও পড়ুন- পুজো ছিল, পুজো নেই : সুমন চট্টোপাধ্যায়

প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও বেশ কিছু সামাজিক কারণও কিন্তু আমাদের সামগ্রিক উৎসব উদযাপনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করছে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে শ্রেণী বিশেষে আমাদের চারপাশে যে একটা বিরাট বৈষম্য গড়ে উঠেছে তা‌ অস্বীকার করার উপায় বোধ হয় নেই। একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষের কাছে যখন বেঁচে থাকার উপাদানের লভ্যতা ও তার উপযুক্ত ব্যবহারের সুযোগ ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে, তখন মধ্যবিত্ত শ্রেণী তার সীমিত সুযোগ ও সুবিধার ব্যবহারের মাধম্যে ক্রমাগত নিজেদের শ্রেণীগত অবস্থানকে এক ধাপ ওপরে প্রতিষ্ঠা করতে সদা ব্যস্ত। এর ফলশ্রুতিতে একটি সর্বব্যাপী ভোগবাদী সংস্কৃতির সৃষ্টি এবং বিস্তার ঘটে চলেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সবাই আজ নিজেদের সোশ্যাল স্ট্যাটাস আপগ্রেড করতে এতটাই মরিয়া যে নিজেদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা বা নৈতিক আদর্শের গণ্ডি পেরিয়ে যেতেও অনেকে তৈরি! এই ভোগবাদী বা কন্সুমারিসট অর্থনীতির দাপটে ও বিলাসবহুল সংস্কৃতির প্রভাবে একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ খুব সহজেই সাধারণভাবে অনেক কিছুই করতে পারছে যা একটা সময় শুধুমাত্র উৎসবের দিনগুলোতেই করা যায় বলে ভাবা হতো। অনলাইন শপিং-এর জনপ্রিয়তার ফলে আজ গোটা বছর ধরেই জামা-কাপড় থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনাকাটা করার সুবিধে রয়েছে। তাই পুজো এলে কাপড়ের দোকানে ভিড় করে নতুন পোশাক কেনার ব্যাপার কিংবা অন্যান্য বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করার তাগিদ আজ অনেকটাই মিটে গেছে বললেও ভুল বলা হবে না। এছাড়াও পুজোর দিনগুলোতে আড্ডা জমানোর যে আলাদা একটা উৎসাহ‌, সেটিও কি আগের মতো একই ভাবে বর্তমান? বড়, ছোট শহরে আজকাল প্রতি উইকেন্ড কিংবা ছুটকো ছুটি-ছাটা‌ মানেই অনেকের কাছে রেস্টুরেন্ট,পাব বা ডিসকো ঠেকে আড্ডা জমানোর সুযোগ।

বর্তমানে একটি শ্রেণীর যদি সামাজিক কাঠামোতে অবস্থান একদম তলায় গিয়ে ঠেকছে বলে ধরে নেওয়া হয়, তবে এও সত্যি যে আরেকটি শ্রেণীর কাছে ভোগ-বিলাসের মাধ্যমের অনেক সুবিধে পৌঁছে গেছে। অতএব, মাত্র বছর দশেক আগেও যে ব্যাপারগুলো অতি সহজলভ্য ছিল না এবং যার জন্যে মানুষ পুজোর দিনগুলোর বা ছুটির অপেক্ষা করত গোটা বছরজুড়ে, তার অনেকটাই আজ জীবন-যাত্রার স্বাভাবিক অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এবং এই পুরো প্যারাডাইম শিফটের পিছনে সোশ্যাল মিডিয়ার যে একটা বিশাল ভূমিকা রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। কিছুকাল আগেও কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন করে পরিচিত মানুষদের একসাথে করে দিত এবং উৎসবের জমায়েত স্বাভাবিক ভাবেই হয়ে উঠত একে অন্যের ভালো মন্দের খবর নেওয়া কিংবা মত বিনিময়ের মাধ্যম, আজকাল সেই ব্যাপারগুলোর আকর্ষণ কিন্তু অনেকটাই কমে গেছে। বিভিন্ন ম্যাসেজিং অ্যাপ এবং ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদির কারণে আজকাল সবাই সবার ব্যাপারে অবগত। এখন অনেক কথাই আঙুলের চাপে একটি রিয়াকশন বা ইমোজির মাধম্যে সেরে ফেলা যায়। পুজোর ছুটিতে এসে রাঙা পিসিমার হাতের নাড়ু, ছোটো মাসির বাড়ির লক্ষ্মীপুজোর স্পেশাল প্রসাদ এসব আজ কুরিয়ার সার্ভিসের দৌলতে এক-দু' দিনেই পৌঁছে যাচ্ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ছোটবেলার বা স্কুলের বন্ধুদের বছরে একবার পাড়ার প্যান্ডেলের জমায়েতের আগ্রহ আজ ভিডিও কল অনেকটাই কি মিটিয়ে দিচ্ছে! যোগাযোগ মাধম্যের অভূতপূর্ব উন্নতি মানুষকে আরও কাছে নিয়ে এসেছে নাকি অনেকটাই দূরে ঠেলে দিয়ে আন্তরিকতা্র ঘাটতি ডেকে এনেছে— এ এক নতুন বিতর্কের বিষয় তো বটেই!    

তবে কি দুর্গাপুজো নিয়ে এখন একেবারেই মাতামাতি হচ্ছে না? মানুষ প্যান্ডেলে ভিড় জমাচ্ছেন না? রিল্‌স শেয়ার হচ্ছে না? মানুষ কি কেনাকাটা বাদ দিয়েছেন? আড্ডা, জমায়েত কোনো কিছুই চলছে না? এর সহজ উত্তর— হ্যাঁ, সব কিছুই চলছে। কিন্তু কোথাও কি এই সবকিছুর মধ্যেও উদ্দীপনা বা আবেগের পারদ সামান্য হলেও নিম্নগামী? প্রবন্ধটি লিখতে বসার আগে ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত পঁচিশ থেকে চল্লিশ বছরের প্রায় জনা পনেরো পুরুষ, মহিলাকে একই প্রশ্ন করেছিলাম। আশ্চর্যজনক ভাবে প্রায় প্রত্যেকেই জানিয়েছেন যে পুজো নিয়ে তাদের আবেগ ও উচ্ছ্বাস আগের চাইতে অনেকটা‌ কম। কিন্তু ওদের অনেকেই পুজো এলে সাধারণত আমরা যা যা করতে অভ্যস্ত তার‌ সবকিছুই করে চলেছেন এবং পুজোর চারটে দিনও তার ব্যতিক্রম হবে না। এবং ঠিক এখানেই এই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে বলে মনে করা যায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কি বলা যায় যে এক বিশাল সংখ্যক মানুষের উৎসব উদযাপনের ধরন অজান্তেই নিতান্ত অন্তঃসারশূন্য "পারফরমেটিভ ডিসপ্লে" বা প্রদর্শনমূলক অনুশীলনে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে? একক ভাবে দেখলে মানুষভেদে এর নেপথ্যে অনেকগুলো ব্যক্তিগত কারণ উঠে আসবে নিশ্চয়ই, কিন্তু যদি সামগ্রিক পরিসরে এই পুরো ব্যাপারটিকে ভাবা যায় তবে কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা একটি বিশেষ সামাজিক কাঠামো সামনে চলে আসে যার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উপরে উল্লিখিত রয়েছে। এবার অনেকে বলতে পারেন যে বয়স বাড়ার সাথে এমনটা অনেকেই অনুভব করে থাকেন। কিন্ত শুধু বয়সের কথা টেনে এই সামগ্রিক অ্যাপ্যাথি বা ঔদাসীন্যকে কতটুকু ঢেকে দেওয়া যায় তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। যদি বয়সের দুর্বল অজুহাত পাশে রেখে ভেবে দেখা যায়, তবে এই সামগ্রিক ঔদাসীন্যের প্রবণতা ভাবতে বাধ্য করায় যে আমাদের উৎসব বা বিশেষ উদযাপনের সুযোগ বা অবসরটুকু হয়তো খুব ধীর কিন্তু স্থির গতিতে একটি নিতান্ত রুটিন মাফিক অভ্যেসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, যেখানে আড়ম্বর বা উচ্ছ্বাস নেহাতই বাহ্যিক প্রদর্শন মাত্র! সামাজিক বা অর্থনৈতিক প্রভাব বাদ দিয়ে ভাবলেও, যেকোনো উৎসব মানুষকে মনস্তাত্ত্বিক ভাবেও অনেকটা প্রভাবিত করে। এবং দুর্গাপুজোর মতো বিশাল উৎসব যে মাত্র চারটে দিনেই আমাদের গোটা বছরের শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি দূর করে দিয়ে আবারও এক বছরের জন্য অপেক্ষায় রেখে যায় এই ভাবনাটিও আমাদের অজানা নয় মোটেই। কিন্তু আজকের এই রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলা অনেকটাই যান্ত্রিক সভ্যতার প্রেক্ষাপটে আমাদের উৎসব, আমাদের উদযাপনের প্রস্তুতি কি সঠিক অর্থেই আমাদের ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছে নাকি যন্ত্র সভ্যতার বাহক আমরা পরিকল্পিত ভাবে প্রস্তুত সফটওয়ারের মতো শুধুমাত্র অন্তঃসারশূন্য আনন্দ-উল্লাসের অভিনয়ে মেতে উঠছি!   

আরও পড়ুন- যেখানে উৎসবের জৌলুস নেই

এ'প্রসঙ্গে ফরাসি তাত্ত্বিক, দার্শনিক তথা চলচ্চিত্র নির্মাতা গি ডেবর্ড (Guy Debord)-এর "দ্য সোসাইটি অব দ্য স্পেক্ট্যাকল" বইটিতে উল্লেখ করা ধারনাগুলি বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। বিংশ শতকের মধ্যবর্তী ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের পটভূমিকায় লেখা বইটিতে মূলত উত্তর-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফলে গড়ে ওঠা ভোগবাদী সংস্কৃতির ধারণাকে বিশ্লেষণ করতে বসে ডেবর্ড লিখছেন কী ভাবে একটি ‘কনজ্যুমার‌ কালচার’-এর গড়ে ওঠা এবং তার প্রসার শুধুমাত্র পণ্যের ব্যাপক উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি বা তার ব্যবহারের গন্ডিতে আটকে না থেকে সেই ব্যবহারের ব্যাকরণকে মানুষের সামগ্রিক চাহিদা এবং জীবনযাত্রার সাথে এমন ভাবে মিলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে যাতে সেই পণ্যের বা পরিষেবার সঠিক এবং কার্যকরী ব্যবহারের চাইতে মানুষের কাছে সেই পণ্য বা পরিষেবার প্রদর্শনই মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে।‌ ডেবর্ডের উল্লিখিত ‘স্পেক্ট্যাকল’-এর ধারণা মূলত এই বিষয়টির ওপরেই আলোকপাত করে যে আধুনিক পুঁজিবাদী সামাজিক ব্যবস্থায় বাহ্যিক প্রদর্শন বা উপস্থাপন মানুষের সত্যিকার অর্থে অনুভূত অনুভব বা অভিজ্ঞতার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পূর্ববর্তী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যেখানে মূলত সম্পদের ব্যাপক উৎপাদন এবং তার আহরণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, পরবর্তী ভোগবাদ সর্বস্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সেখানে আহরণের চেয়েও সেই সম্পদের সামাজিক ভাবে প্রদর্শন বা উপস্থাপন করার এবং তার থেকে প্রাপ্ত মর্যাদার ভাবনার উপর গুরুত্ব দেয়। এই ‘স্পেক্ট্যাকল’ তাই স্বাভাবিক এবং প্রকৃত জীবনের ঠিক বিপরীতে থাকা একটি বিকল্প বা কৃত্রিম জীবনের অনেকগুলো প্রতিচ্ছবির সূচক। “পারফর্মেটিভ ডিসপ্লে”-এর ধারণা ডেবরের "স্পেক্ট্যাকল"-এর ধারণার সাথে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থা— যার অনেকটাই পুঁজিবাদের দ্বারা বিশাল ভাবে চালিত— কোনো বিশেষ সুবিধা বা পরিষেবা‌ পাওয়া বা তার অধিকারী হওয়া তখনই সামাজিক বৈধতা বা মান্যতা অর্জনে সক্ষম, যখন তার বাহ্যিক প্রকাশ বা প্রদর্শন মূল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। ডেবরের মতে, এর ফলে কৃত্রিম জীবনের প্রতিচ্ছবি গুলোই বাস্তব হয়ে উঠে জীবনের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে যায়। এই কৃত্রিমতার আবেশ এবং প্রদর্শনের আচ্ছন্নতাকে‌ তিনি "হিপনোটিক বিহেভিয়ার" হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।  

ডেবরের “স্পেক্ট্যাকল”-এর ধারণা একুশ শতকের তৃতীয় দশকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয় যেখানে জীবনের প্রতিটি মুহুর্তকে ইনস্টাগ্রাম-উপযুক্ত করে তোলার উদগ্র বাসনা বিভিন্ন বয়সের মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত বা অনুষ্ঠানকে উপলব্ধি করার চেয়েও তাদের মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দি করার প্রবল আগ্রহ চারিদিকে দৃশ্যমান। এভাবেই বেঁচে থাকার প্রতিটি বিশেষ মুহূর্ত ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক মাধম্যে এবং লক্ষ কোটি মানুষের ফোনের পর্দায়। এর ফলে ব্যক্তিগত পরিসর এবং সামাজিক পরিসরের সীমানা ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে প্রায় অদৃশ্য হওয়ার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে! সমাজতাত্ত্বিক এরভিং গফম্যানের "পারফরম্যান্স"-এর ধারণাটিও এক্ষেত্রে বেশ প্রাসঙ্গিক। তাঁর "দ্য প্রেজেন্টেশন অফ সেলফ ইন এভরিডে লাইফ" বইয়ে গফম্যান সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিককে নাটক এবং নাট্যমঞ্চের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে লিখছেন— নাটকের ফ্রন্ট স্টেজ এবং ব্যাক স্টেজের মতোই মানুষের ব্যবহারও সময় ও ক্ষেত্র বিশেষে বদলে বদলে যায়। মঞ্চের উপরে যা করা হয় সেটি যেমন একটি পারফরম্যান্স, ঠিক তেমনই সামাজিক পরিসরে মানুষের ভাষা, ব্যবহার ইত্যাদিও একটি পারফরম্যান্সের সমতুল্য। অন্যদিকে, তার ব্যক্তিগত পরিসর বা ব্যাক স্টেজে মানুষটি কোনো পারফরম্যান্স নয়, বরং তার স্বাভাবিক, নিজস্ব সত্তায় প্রতীয়মান থাকেন। কিন্তু প্রায়শই মানুষ তার বাহ্যিক ব্যবহার— "ফ্রন্ট স্টেজ বিহেভিয়ার”-এ এতটাই অভস্ত্য হয়ে পরে যে তার ব্যক্তিগত ক্ষেত্রটিও সেই ব্যবহারের দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করে যার ফলে “অফ স্টেজ বিহেভিয়ার” বা তার ব্যক্তিগত আচরণও পারফরম্যান্সে পরিণত হয়!   

আরও পড়ুন- উৎসব : একটি শব্দে যেভাবে সম্পর্কের জাগরণ এঁকেছিলেন ঋতুপর্ণ

তাই যে প্রশ্নটি আলোচনার দাবি রাখে তা হলো, দুর্গাপুজোর মতো উৎসব— ধর্মীয় রীতিনীতি বা আচার অনুষ্ঠানের বাইরেও সামাজিক পরিসরে যার একটি বিস্তৃত সাংস্কৃতিক পরিভাষাও রয়েছে— তার উদযাপনের ভাবনাও কি তবে আত্মিক যোগাযোগ বা অনুধাবনের সীমারেখা পেরিয়ে অনেকটাই "পারফরমেটিভ প্র্যাকটিস"-এ রূপান্তরিত হয়ে পরেছে? এবং তার ফলে কি উৎসবের মূল ধারণাটি আন্তরিকতা বা মানসিক প্রশান্তির উৎসের চেয়েও বেশি "স্পেক্ট্যাকল" অর্থাৎ বাহ্যিক প্রদর্শন কিংবা “পারফরম্যান্স”-এর গতানুগতিক এবং সর্বগ্রাসী ছাঁচে ঢালা 'ইভেন্ট' সর্বস্ব ধারণায় পর্যবসিত হওয়ার পথে, যাতে অংশ নেওয়া অনেকটাই নিতান্ত অভ্যেস মাত্র! সামাজিক মাধম্যের লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের সম্মোহনের জালে আটকে পরা কয়েকটি প্রজন্মের কাছে দুর্গাপুজোর প্রাসঙ্গিকতা ঠিক কতটা? কয়েক শতক ধরে প্রচলিত ধারণা বা মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত এবং শুধুমাত্র বাহ্যিক আড়ম্বর ও সামাজিক মাধ্যমে প্রদর্শনের উন্মুক্ত প্রান্তর, সেই আলোচনার সাথে খুব দ্রুত পাল্টাতে থাকা সামাজিক ব্যবস্থা এবং পালটে যাওয়া উৎসব উদযাপনের নিবিড় সংযোগ যে রয়েছে তা স্পষ্টত প্রতীয়মান।   

এই বদলে যাওয়া উৎসব ব্যাকরণের ভালো-মন্দ বিচার করার উদ্দেশ্য এই লেখাটির নয়। বরং এই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য এই নিয়ত এবং অনিয়ন্ত্রিত পরিবর্তনের উপর সামান্য আলোকপাত করার মাধ্যমে একটি আলোচনার এবং ভাবনার পরিসর খুলে দেওয়ার যেখানে বিভিন্ন মতামত মিলিত হয়ে বর্তমান সামাজিক অবস্থার একটি স্পষ্ট ছবি তুলে ধরতে পারে। তবে, মানব সভ্যতাকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের যে প্রদর্শনমূলক অনুশীলনের ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে ও বাহ্যিক আড়ম্বরের জাল ছিঁড়ে সত্যিকার অর্থে আনন্দে মেতে ওঠার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা বোধ করি অনেকেই মেনে নেবেন। এই আনন্দ মানুষের সাথে মানুষকে মিলিয়ে দেওয়ার আনন্দ তো বটেই, কিন্তু তার সঙ্গেই ক্রমাগত স্ক্রোল করে চলা ফোনের পর্দার বাইরে নিজের আবেগ ও অনুভুতির সাথে নতুন করে পরিচিত হওয়ার আনন্দ— যে আনন্দকে নিয়মিত উপযোগিতার মাপকাঠিতে মাপতে হয় না, যে আনন্দ অন্তরের গ্লানি মুছে দিতে পারে, আর যে আনন্দের পথ চেয়ে সত্যিই বসে থাকা যায় একটা গোটা বছর। 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

ডঃ কিংশুক চক্রবর্তী (সহকারী অধ্যাপক, জনতা কলেজ, অসম) 

প্রিয়াঙ্কা দে (গবেষক, ইংরেজি বিভাগ, অসম বিশ্ববিদ্যালয়, শিলচর) 

More Articles