ভোট 'চোখের ধুলো', মহিলা প্রার্থীর নেপথ্যে পঞ্চায়েতে রাজ সেই পুরুষদেরই
'Sarpanch Pati' System: স্থানীয় গ্রামে 'ডলি সরপঞ্চ' নামেই বেশি পরিচিত গয়ার শাদিপুর গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান ডলি শর্মা। এই বেনিয়মের মিছিলে, এই পুরুষপ্রধান পঞ্চায়েতের ভিড়ে তিনি যেন ব্যতিক্রম।
কিছুদিন আগে একটি ওয়েবসিরিজ কার্যত মুগ্ধ করেছিল আমাদের। সহজ সরল গল্পের মোড়কে উঠে এসেছিল গ্রাম, গ্রাম পঞ্চায়েতের রাজনীতি, সমস্যার কথা। হ্যাঁ, কথা বলছি, 'পঞ্চায়েত' ওয়েবসিরিজটি নিয়েই। গল্পের প্রোটাগনিস্ট অভিষেক ত্রিপাঠী সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তেমন কোনও বড় কর্পোরেট চাকরি বড়শিতে বিঁধতে পারেননি। একরাশ অনিচ্ছা আর বিরক্তি নিয়েই এসে পড়েছেন উত্তরপ্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম ফুলেরায়। পঞ্চায়েত সচিবের সামান্য টাকার চাকরি। শহুরে হাওয়ায় বেড়ে ওঠা সচিবজিকে প্রতিপদে এসে বেঁধে শস্যশ্যামলা ফুলেরা। পদে পদে অস্বস্তি, অনভ্যাসের ফোঁটা চড়চড় করে ওঠে শরীরে। নিয়ম বেঁধে, বেনিয়মও বেঁধে। ফুলেরায় এসে প্রথম যে বেনিয়মের ধাক্কা হজম করতে দেরি হয়েছিল সচিবজির, তা হল পঞ্চায়েত প্রধানের পরিচয়। কাগজে-কলমে পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে যে নাম দেখে, জেনে ফুলেরায় এসেছিলেন তিনি, গ্রামে এসে দেখলেন তাতে বিস্তর গড়মিল। খাতায় কলমে পঞ্চায়েত প্রধানের নাম মঞ্জুদেবী হলেও, গ্রামের সর্বময় কর্তা আদতে তাঁর স্বামী ব্রিজভূষণ দুবে। মঞ্জুদেবী ঘর সংসার সামলান, পঞ্চায়েত অফিসের দায়িত্ব তাই ব্রিজভূষণের কাঁধেই। ছবির পর্দায় এই দৃশ্য দেখে দর্শক হয়তো অবাক হয়েছেন, চিত্রনাট্যের প্রয়োজন ভেবে উড়িয়েও দিয়েছেন কেউ কেউ! কিন্তু ভারতবর্ষের একটি বড় অংশ জুড়ে এ ছবি রূঢ় বাস্তব।
আরও পড়ুন: মহিলা হিসেবে প্রথম হেকানি জাখালু, নতুন কোন ইতিহাস রচনা করল নাগাল্যান্ড
মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ থাকায় মেয়েরা পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়ান বটে, জেতেনও। কিন্তু রাজকার্য চালান বাড়ির পুরুষ সদস্যটি। এ প্রথা কোনও একটি দুটি গ্রামে নয়, দেশের বহু গ্রামাঞ্চলেই বড় চেনা ছবি। গালভরা নামও রয়েছে এই পদের। না, অবশ্যই সরকারি খাতায় এমন পদের উল্লেখ নেই কোথাও। তবে লোকমুখে আছে। 'সরপঞ্চ পতি' নামেই তাঁরা পরিচিত গ্রামে। তাঁদের অঙ্গুলিহেলনেই গ্রাম চলে, রাজনীতির পাতা পাল্টায়। কেবল ভাঙা ভাঙা অক্ষরে সই কিংবা টিপছাপ থাকে ভোটে জিতে পঞ্চায়েত প্রধানের পদে শপথ নেওয়া মহিলাটির। বাকি সমস্ত ক্ষমতাই থাকে বাড়ির সেই পুরুষসদস্যটি। তেমনটাই দস্তুর। সকলেই সবটা জানেন। গ্রামবাসী, পুলিশ-প্রশাসন এমনকী উপরমহলের সকলেও। কিন্তু সকলেই না-জানার ভান করেন। এমন ভাব করেন যেন কিছুই হয়নি। কী বলবেন একে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আধিপত্য না অন্য কিছু!
গত ফেব্রুয়ারি মাসে পঞ্চায়েত রাজ মন্ত্রী কপিল পাতিল রাজ্যসভায় জানিয়েছিলেন মেয়েদের জন্য পঞ্চায়েত ও শহরাঞ্চলের ভোটে মহিলা সংরক্ষণের কথা। অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম, বিহার, ছত্তীসগঢ়, গুজরাত, হরিয়ানা, হিমাচলপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, কর্ণাটক, কেরল, মধ্যপ্রদেশে, পঞ্জাব, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, সিকিম, তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানা, ত্রিপুরা, উত্তরাখণ্ড পশ্চিমবঙ্গ-সহ মোট ২১টি রাজ্য ও দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মেয়েদের জন্য মোট ৫০ শতাংশ করে সংরক্ষণ রাখা হয়েছে। কেন এই সংরক্ষণ? অনুন্নত এলাকার মেয়েদের তুলে আনার জন্যই এই প্রচেষ্টা। মহিলাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া, তাঁদের শুধুমাত্র ঘরকন্যার কাজের বাইরে এনে প্রথমসারিতে নিয়ে আসার জন্যই এই উদ্যোগ। কিন্তু দুঃখের কথা, সেই উদ্যোগে অহরহ জল ঢালছে এইসব গ্রামাঞ্চলগুলি। বরং ক্ষমতা থেকে যাচ্ছে সংসারের পুরুষ সদস্যটির হাতেই কুক্ষিগত। নিজেদের যোগ্য়তায় উঠে আসতে পারছেন না মেয়েরা। এভাবে যে শুধু মহিলা প্রার্থীরাই ঠকছেন তা নয়, ঠকছেন তাঁরাও যাঁরা গ্রামের মহিলা প্রার্থীটিকে ভোট দিয়ে সমাজ বদলের প্রত্যাশা করছেন। প্রত্যাশা করছেন, নতুন পঞ্চায়েত প্রধান নারীকল্যাণের উপর জোর দেবেন আরেকটু বেশি। কিন্তু তিমির থেকে যাচ্ছে সেই তিমিরেই।
এমনকী এই নিয়ে কোনও লুকোছাপারও বিষয় নেই বহু জায়গাতেই। ভোটের পোস্টারে দেখা যাচ্ছে মহিলা প্রার্থীর পিছনে স্পষ্ট সেই সরপঞ্চ পতিটির ছবি, যিনি ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণ করতে চলেছেন গ্রাম, প্রশাসন এবং অতি অবশ্যই ভোটে জিতে আসা মহিলা প্রার্থীটিকে। কিন্তু কতদিন! কবে শেষ হবে এই নিয়ম হয়ে দাঁড়ানো বেনিয়মের। আর তার বিরুদ্ধেই সরব হয়েছেন এবার বিহারের এক পঞ্চায়েত প্রধান। এই অনৈতিক অভ্যাসের বিরুদ্ধে রীতিমতো ফেসবুকে প্রচার চালাচ্ছেন তিনি।
এই নিয়ে দ্বিতীয়বার পঞ্চায়েত প্রধানের পদে অভিষিক্ত হয়েছেন ডলি। আশপাশের প্রায় সমস্ত পঞ্চায়েতে 'সরপঞ্চ পতি'-দের একই রকম আধিপত্য দেখছেন তিনি। দেখছেন নির্লজ্জ ভাবে ভোটের দেওয়াল লিখন থেকে পোস্টারে প্রার্থীর সঙ্গে সরপঞ্চ পতি-দের ছবি। কেউ আপত্তি করা তো দূরের, প্রশ্ন পর্যন্ত করেন না। এই ভাবেই প্রতিমুহুর্তে ভারতীয় সংবিধান, গণতন্ত্রের প্রহসন হয়ে চলেছে গোটা দেশ জুড়ে। আসলে ঠিক যে কারণে এই সংরক্ষণের ব্যবস্থা, সেই উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। ডলি মনে করেন, সত্যিই যদি মহিলারা এই পদ সামলাতেন, তাহলে অনেক বেশি উন্নয়ন সম্ভব হত।
২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখে শোনা গিয়েছিল এই সরপঞ্চ পতি প্রথার বিরোধিতার কথা। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। চলতি বছরের এপ্রিলে গ্রামান্নোয়ন ও পঞ্চায়েত রাজের উপর গঠন করা হয় ৩১ সদস্যের একটি পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটি। যার নেতৃত্বে ছিলেন ডিএমকে নেত্রী কানিমোঝি করুণানিধি। তিনি কড়া ভাষায় জানিয়েছিলেন, সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মেয়েদের দমিয়ে রাখার এই অভ্যেস বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: শিক্ষায় এগিয়ে মেয়েরা, তাও কেন এই রাজ্যে কোনও মহিলাই ভোট পান না নির্বাচনে?
ডলিও মনে করেন, এই জায়গাটা বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন প্রয়োজন, প্রশাসনের তৎপরতা প্রয়োজন। তবে তার আগে প্রয়োজন মানসিকতার প্রয়োজন। মেয়েরা যে একা দেশ, রাজ্য, পঞ্চায়েত সমস্তটাই চালাতে পারে, তাঁদের প্রতি এই ভরসাটুকু প্রয়োজন। আমাদের সমাজ এখনও মেয়েদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাকে ঠিকমতো হজম করতে পারে না। তাঁকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে কোনও না কোনও ভাবে। আর এই দৃশ্য কেবল পঞ্চায়েতের অন্দরেই নয়। প্রায় সর্বক্ষেত্রে একই রকম ভাবে কার্যকর। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন শিক্ষার। মেয়েদের আরও শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এমনকী গ্রামাঞ্চলেও। একদিন পরিস্থিতি বদলাবেই, মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করেন ডলি। আর সেই বিশ্বাসে ভর করেই মশালটা কিছুতেই নিভতে দেননি তিনি। নারীপ্রগতির এই ব্যাটন তিনি তুলে দিতে চান আরও আরও অনেকের হাতে।