বিটকয়েনের ব্যবহার কতটা নিরাপদ

ভারতের মুদ্রার নাম যেমন 'রুপি', মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রার নাম যেমন 'ডলার', ঠিক তেমনই একটি মুদ্রা 'বিটকয়েন'। তবে বিট কয়েনের কোনও দেশ নেই। পৃথিবীর যে কোনও দেশ থেকেই ব্যবহার করা সম্ভব এই ডিজিটাল মুদ্রা। এই ধরনের ডিজিটাল মুদ্রাকে বলা হয় ক্রিপ্টোকারেন্সি। শুধুমাত্র বিটকয়েন নয়, বাজারে রয়েছে ইথেরিয়াম ডজিকয়েনের মতো অসংখ্য ক্রিপ্টোকারেন্সি। এর মধ্যে বিটকয়েনের দাম সব থেকে বেশি হওয়ার কারণে এই ক্রিপ্টোকারেন্সি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছে।

ভারতের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। একইভাবে সব দেশেই মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক থাকে। তবে, বিটকয়েনের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকে না। তাই অনেকেই পরিচয় গোপন রেখে লেনদেন করার জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে থাকেন। আজকাল প্রায় সকলেই লগ্নির জন্যই ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনছেন। চলতি বছর অক্টোবরেই সর্বোচ্চ দামের নতুন রেকর্ড করেছে বিটকয়েন। গত বুধবার এক বিটকয়েনের দাম হয়েছিল ৬৬,৯৭৪ মার্কিন ডলার (প্রায় প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা)। বিটকয়েনের এই আকাশছোঁয়া দামের কারণেই এই ক্রিপ্টোকারেন্সিকে লগ্নির জন্য বেছে নিচ্ছেন অনেকেই।

ব্লকচেন কী?

কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা না থাকার জন্য যে কোনও কম্পিউটার থেকেই বিটকয়েন ট্রানজাকশনের অথেন্টিকেশনের জন্য একটি বিশেষ নেটওয়ার্ক রয়েছে। এই নেটওয়ার্কে যে কেউ যুক্ত হয়ে বিটকয়েন লেনদেনের অথেন্টিকেশন করতে পারবেন। বিটকয়েন লেনদেনের সময় যেখানে হিসাব রাখা হয়, সেই প্রযুক্তির নাম 'ব্লকচেন'। এই প্রযুক্তিতে প্রত্যেকটি ব্লক তার উপরে ও নিচের ব্লকগুলির সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাই ব্লকচেনে প্রবেশ করে সেখানে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে না হ্যাকাররা। কোনও কারণে কোনও ব্লকের সঙ্গে উপরের ব্লকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে নেটওয়ার্কের অন্যান্য কম্পিউটার তা বুঝে যাবে ও সেই লেনদেন বন্ধ করে দেবে। তাই ব্লকচেনে শুধুমাত্র নীচে নতুন ব্লক যুক্ত করার সম্ভব। একবার কোনও লেনদেন হয়ে গেলে, সেই ব্লকের উপরে কোনওরকম পরিবর্তন সম্ভব নয়।

বিটকয়েন ওয়ালেট কী?

টাকা রাখার জন্য যেমন মানিব্যাগ বা ওয়ালেট প্রয়োজন, ঠিক তেমনই বিটকয়েন ও অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সি রাখার জন্য প্রয়োজন একটি ডিজিটাল ওয়ালেট। ডিজিটাল ওয়ালেট ছাড়া বিটকয়েন সংরক্ষণ সম্ভব নয়। বিটকয়েন কেনার আগে অথবা মাইনিংয়ের আগে কম্পিউটার অথবা মোবাইলে ইনস্টল করতে হবে একটি ওয়ালেট অ্যাপ। সেই অ্যাপ ব্যবহার করে তৈরি করতে হবে একটি ওয়ালেট। প্রত্যেক ওয়ালেটের একটি আলাদা ওয়ালেট অ্যাড্রেস থাকে। এই ওয়ালেটের সঙ্গেই থাকবে একটি পাবলিক ও একটি প্রাইভেট কি। এই ওয়ালেটের মাধ্যমেই বিটকয়েন ব্লকচেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। তাই বিটকয়েন লেনদেন ও ব্যালেন্স দেখার জন্য প্রয়োজন একটি ক্রিপ্টো-ওয়ালেট। ক্রিপ্টো-ওয়ালেটের পাবলিক-কি ইউজারনেমের মতো কাজ করবে, অন্যদিকে প্রাইভেট-কি কাজ করবে পাসওয়ার্ডের মতো।

কীভাবে কাজ করে বিটকয়েন?

ধরুন অমল সুমন্তকে পেমেন্ট করবেন। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পেমেন্ট করতে চাইলে সুমন্তকে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য অমলের কাছে পাঠাতে হবে। একইভাবে বিটকয়েনের মাধ্যমে পেমেন্ট করার জন্য সুমন্তকে নিজের ক্রিপ্টো অ্যাকাউন্টের আইডি অমলকে জানাতে হবে। সেই আইডি ব্যবহার করে অমল সুমন্তকে বিটকয়েন পাঠাবেন। লেনদেন শেষ হলে ব্লকচেনে থাকা সব অংশগ্রহণকারীকে তা জানিয়ে দেওয়া হবে। তাঁরা নিজের নিজের কম্পিউটারে সেই লেনদেনের বৈধতা যাচাই করে নেবেন। ব্লকচেনের সব অংশগ্রহণকারী লেনদেন যাচাই শেষ করলেই তবেই প্রাইভেট-কি ব্যবহার করে সুমন্ত তা আনলক করতে পারবেন।

বিটকয়েন মাইনিং কী?

বিটকয়েন লেনদেনের সময় একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয়। যে কম্পিউটার সবার আগে গাণিতিক সমস্যার সমাধান পারে, সেই কম্পিউটারের মালিকের ক্রিপ্টো-ওয়ালেটে সামান্য পরিমাণ বিটকয়েন পুরস্কার হিসাবে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়ার নাম 'বিটকয়েন মাইনিং'। ব্লকচেনে একবার লেনদেন শেষ হলে তা আর পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। লেনদেনের তথ্য একটি বিশাল পাবলিক লেজার বা ব্লকচেনে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ব্লক সিস্টেমে কেউ প্রবেশ করলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্লকচেনের সব ব্যবহারকারীকে সচেতন করা হবে। তাই একবার ব্লকচেন লেজারে কোন তথ্য সংরক্ষিত হয়ে গেলে তা বদল করা সম্ভব নয়।

বিগত কয়েক বছরে বিটকয়েনের দাম হু হু করে বাড়ার কারণে বাড়িতে কম্পিউটারের মাধ্যমে বিটকয়েন মাইনিং করে বিপুল পরিমাণ রোজগার করছেন অনেকেই। যেহেতু বিটকয়েন মাইনিংয়ের জন্য বড় গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয়, তাই এই কাজে প্রয়োজন হয় বেশি শক্তিশালী কম্পিউটারের। যার দাম কয়েক লক্ষ টাকা থেকে শুরু হয়। এছাড়াও, নেটওয়ার্কে হাজার হাজার কম্পিউটার সব সময় চলতে থাকার কারণে বিটকয়েন মাইন করার জন্য বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। তাই চিনে বিদ্যুতের দাম কম হওয়ার কারণে সেই দেশ বিটকয়েন মাইনের ব্যাপারে বিপুল জনপ্রিয়।

বিটকয়েনের ঝুঁকি

বিটকয়েন একটি ডিজিটাল মুদ্রা। এই মুদ্রার কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। এই কারণেই বিটকয়েনের দাম খুব দ্রুত বেড়ে অথবা কমে যেতে পারে। তাই শুধুমাত্র লগ্নির জন্য বিটকয়েন কেনার পরিকল্পনার করে থাকলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন। চলতি বছর এপ্রিলে বিটকয়েনের দাম ৬০ হাজার মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর, চিনে বিটকয়েন লেনদেন নিষিদ্ধ হওয়ার পরেই হঠাৎ বিটকয়েনে ধ্বস নামে। জুলাই মাসে বিটকয়েনের দাম ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের নিচে চলে যায়। অক্টোবরে তা ফের ছাড়িয়ে যায় ৬৬ হাজার মার্কিন ডলার। আর বিটকয়েনের এই অস্থিতিশীল বৈশিষ্ট্যের কারণেই নিজের মোট লগ্নির ২-৫ শতাংশ বিটকয়েন ও অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লগ্নির পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

তথ্যসূত্রঃ

https://www.news18.com/news/business/bitcoin-mining-what-is-cryptocurrency-mining-how-it-works-and-what-investors-get-4311518.html

https://time.com/nextadvisor/investing/cryptocurrency/how-much-your-portfolio-should-be-crypto/

https://www.ndtv.com/business/here-s-what-you-need-to-know-about-how-crypto-wallets-work-2565966

https://www.jamestownsun.com/news/7244645-What-is-cryptocurrency-and-blockchain

More Articles