নারদ চরিত্রে যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন নজরুল

Kazi Nazrul Islam: নজরুল জন্মের ১২৫ বছর পর নজরুলের এই কীর্তির দিকে তাকিয়ে মনে হয় সত্যিই তিনি ছিলেন সর্বগুণের অধীশ্বর। অথচ তাঁকে নির্দিষ্ট মাপের বাক্সবন্দি করেই তুলে ধরা হলো।

মাথায় চুড়ো করে বাধা চুল। জটায় সাদা ফুলের মালা। কপালে তিলক। গোঁফ দাড়ি কামানো। সুন্দর মুখশ্রী। বাম হাতে তাম্বুরা। ডান হাতে রুদ্রাক্ষ। গলায় মালা। পরণে শিল্কের লম্বা কুর্তা। ধুতি। সুদর্শন যুবক। সুরেলা কন্ঠ। ভক্ত-প্রাণ ধ্রুবর সামনে ধীরে ধীরে প্রবেশ ঘটছে নারদের। এই দৃশ্য দেখে বোঝাই যাবে না এই নারদ আসলে কাজী নজরুল ইসলাম। কবি নজরুলের নাম শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিদ্রোহী কবিসত্তা। এক দুর্বার আবেগ। এক দুর্নিবার অনুভূতি। এক বাঁধন হারা উত্তাল নদীর ঢেউ। কিন্তু কবি সত্যিই সব্যসাচী। একাধারে কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, অন্য দিকে অভিনয়। কিন্তু অভিনয়ের দিকটি চিরকাল আড়ালেই। তার উপর, তাঁর কম বয়সের ছবিও জনপরিসরে খুব বেশি নেই। কিন্তু যে কোনো পাঠক তাঁর নাটকগুলি পড়লেই নতুন নজরুলকে আবিষ্কার করতে পারবেন। বুঝতে পারবেন অভিনয় সম্পর্কে তাঁর ধারণা কত গভীর ছিল।

আরও পড়ুন- বিশ্বের কাছে এখনও অধরাই থেকে গিয়েছেন নজরুল

এই গভীরতার হাতেকলম প্রমাণ নজরুল অভিনীত সিনেমা ভক্ত ধ্রুব। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি। পায়োনিয়ার ফিল্ম কোম্পানি ছবিটি প্রযোজনা করেছিলেন। গিরিশ ঘোষের লেখা ‘ধ্রুব চরিত’ অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমার চিত্রনাট্য। মূল কাহিনি পৌরাণিক। কবি-অভিনেতা নজরুল এই ছবির জন্য গান লেখেন, সেই সঙ্গে ছবির সংগীত পরিচালনাও করেন। ছবিটির ১৮টি গানের মধ্যে ১৭ টি-ই তাঁর লেখা। দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল নজরুল অভিনীত এই সিনেমা। সিনেমাটির মধ্যে যে দৃশ্যে নজরুলের প্রবেশ ঘটছে, সেখানে দেখা যায়, বালক ধ্রুব শ্রীবিষ্ণুর উদ্দেশ্যে কাতরস্বরে বলছে , “দেখা দাও দেখা দাও”। সেই সময় নারদবেশে নজরুলের প্রবেশ ঘটছে। শুভ্র বসন। ধীরে ধীরে তিনি বালকের সামনে এলে। দেখলেন। তারপর সংলাপ। তাঁর প্রবেশ, হাঁটা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি অভিনয়ে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। কবির সংলাপ, “নিঝুম কান্তারে কে হরি গান গায়…”

আরও পড়ুন- নজরুলের পত্রিকায় সেদিন লেখেননি রবীন্দ্রনাথ

একের পর এক কথোপকথন। নিখুঁত টাইমিং। মাপা ডায়লগ ডেলিভারি। মনেই হবে না এটি তাঁর প্রথম অভিনীত সিনেমা। সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে বাম হাতের আঙুল সঞ্চালনা।‌ চোখ প্রশান্ত। মুখ সর্বদায় হাস্যময়। অভিনয় মানে যে শুধু ডায়লগ ডেলিভারি নয়,প্রবেশ, প্রস্থান, দাঁড়ানো,শরীরের ভাষা সবই যে অভিনয়ের অঙ্গ তা তাঁর অভিনয় দেখলে বোঝা যায়। সেই সঙ্গে তিনি যখন ভগবান বিষ্ণুর কথা বলছেন তখন তাঁর চোখের অভিব্যক্তি অন্যরকম, অর্থাৎ নীরবতার ভাষাও রপ্ত করেছিলেন তিনি। আবার শিশু ধ্রুবর সঙ্গে কথা বলার সময় হাসির সঙ্গে ঝড়ে পড়ছে স্নেহমাখা সংলাপ। নারদ চরিত্রে নজরুলের সাজসজ্জা নিয়ে পত্রিকায় নানা সমালোচনা হয়। তাঁর জবাবে তিনি বলেন, “আমি চিরতরুণ ও চিরসুন্দর প্রিয় নারদের রূপই দেবার চেষ্টা করেছি।” বলাই বাহুল্য, পৌরাণিক চরিত্রটির প্রতি নজরুলের এক ধরনের ভাললাগা ছিল। ফলে ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদকীয়তেও নজরুল নারদের উদাহরণ তুলে ধরেন বারবার।

আরও পড়ুন- এই বিভক্ত ভারতে নজরুলের দর্শন চর্চার খুব প্রয়োজন

বলতেই হয়, গানের সুর ভক্ত ধ্রুব সিনেমাকে আলাদা মাত্রা দেয়। সেই সময়ে দেখা গিয়েছে অনেক সিনেমা শুধুমাত্র গানের জোরেই হিট করেছে। সেসব সিনেমার বহু গানের সুর তিনি দিয়েছেন। সেই সঙ্গে দিয়েছেন কণ্ঠ। শিশু অভিনেতা প্রবোধের সাথে একটি একক, একটি যুগলবন্দিতে তাঁকে দেখা যায়। গানের ক্ষেত্রে নজরুলের অভিব্যক্তি ছিল স্বতন্ত্র। গানের এক একটি শব্দকে তিনি সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ভক্ত ধ্রুব চলচ্চিত্রের জন্য নজরুলের সুর দেওয়া গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য

"হৃদিপদ্মে চরণ রাখো", "ফিরে আয় ওরে ফেরে আয়", "নাচো বোনমালি", "জয় পিতাম্বর শ্যাম সুন্দর" এবং "কাদি না" "জাগো ব্যাথার ঠাকুর", "অবিরতা বাদল বরষিছে", "চমকে চপলা মেঘে মগন গগন", "ধুলার ঠাকুর", "হরিনার সুধা" ইত্যাদি।

পরবর্তীকালে পাতালপুরী, গোরা, গৃহদাহ, চৌরঙ্গীর মতো কালজয়ী সিনেমায় সঙ্গীতপরিচালক নজরুল ইসলামের সঙ্গে বারবার পরিচয় ঘটে সাধারণ মানুষের। আবার ধূপছায়ার ছবিতে ধরা দিয়েছেন অভিনেতা নজরুল।

আজ নজরুল জন্মের ১২৫ বছর পর নজরুলের এই কীর্তির দিকে তাকিয়ে মনে হয় সত্যিই তিনি ছিলেন সর্বগুণের অধীশ্বর। অথচ তাঁকে নির্দিষ্ট মাপের বাক্সবন্দি করেই তুলে ধরা হলো। অনেক কিছুই জানা বাকি রয়ে গেল। সাহিত্য বা সংগীতের জগতে পাশাপাশি চলচ্চিত্রে জগতের যে নজরুল, তাঁকে আরেকবার জানার চেষ্টা করা যেতে পারে।

সূত্রনির্দেশ 

১. ‘নজরুল-কাব্যে পুরাণ-ঐতিহ্যের প্রাসঙ্গিকতা’: ড. শ্যামলকান্তি দত্ত (লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, সিইউএফ)

২. ‘নজরুল ও জীবনানন্দের কবিতায় পুরাণ ও চিত্রকল্প’: মাওলা প্রিন্স

৩. Introduction to the Puranas: Encyclopedic Literature From Ancient India (500-1500 CE)

৪. ‘পদচিহ্ন সাহিত্য পত্রিকা’: লাভপুর : তারাশঙ্কর সাহিত্যসভার মুখপত্র

More Articles