মেঘনাদ: বিজ্ঞান, রাজনীতি আর প্রতিবাদের কাহিনি
Meghnad Play Review: নাটকটির আর একটি জোরের জায়গা হল রাজনীতিক মেঘনাদ সাহাকে সামনে নিয়ে আসা। একসময় মেঘনাদ সাহা ছিলেন আরএসপি-র সক্রিয় কর্মী।
একদিকে যখন দেশ উদ্যাপন করছে ন্যাশনাল স্পেস ডে, মঙ্গল গ্রহে রকেট পাঠাচ্ছে, ভারতীয় মহাকাশচারীদের আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে পাঠাচ্ছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষী গগনযান মিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই অন্যদিকে শাসক দলের প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষকতায় ‘প্রাচীন ঐতিহ্য’-র নামে একের পর এক মধ্যযুগীয় ধারণা শিক্ষাক্ষেত্রে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল প্রাচীন ভারতীয় গণিত বিষয়ে ইউজিসি-র প্রকাশিত নতুন খসড়া পাঠক্রম। এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সূত্রনির্ভর অঙ্ক ও বীজগণিত, বৈদিক শুল্বসূত্র-এর জ্যামিতি, সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রের গতিবিধির মাধ্যমে সময় গণনা, এমনকি পঞ্জিকা দেখে শুভ মুহূর্ত নির্ধারণের কৌশলও। এই পাঠক্রমে শিক্ষার্থীরা সময়চক্র সম্পর্কেও জানবে, পাঠ করবে যুগ, কল্প, ব্রহ্মবর্ষ, এমনকি ‘বিষ্ণুবর্ষ’ বা ‘শিববর্ষ’-এর মতো পৌরাণিক-ধর্মীয় ধারণাও। এর মধ্যেই এই পাঠক্রমের বিরোধিতা করেছেন দেশের এক বিরাট বড় সংখ্যক বিজ্ঞানী এবং অধ্যাপক। শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বর হাবিব সতর্ক করেছেন এই বলে যে, এই কোর্সগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা হয়ত পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত ভারতীয় গণিত সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করবে, কিন্তু আধুনিক গণিত সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানবে না। তাদের জ্ঞান সীমায়িত থাকবে কেবল বিশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত। এর ফলে খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে গবেষণা করার ক্ষেত্রে এইসব ছাত্রছাত্রীরা প্রভূত সমস্যার সম্মুখীন হবে।
বিজ্ঞানের সঙ্গে যখন পুরাণকে মিশিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে দেশে, ঠিক তখনই কলকাতা শহরে উপস্থাপিত হল অশোকনগর নাট্যআননের নতুন নাটক “মেঘনাদ”। নাটকটি লিখেছেন আমেরিকা-নিবাসী নাটককার সুদীপ্ত ভৌমিক। কুশলী হাতে রচিত এই নাটকটি তাঁর কেরিয়ারের একটি মাইল স্টোন হয়ে থেকে যাবে। নাটকটির নির্দেশনা ও নাম ভূমিকায় আছেন চন্দন সেন। নির্দেশক এবং অভিনেতা হিসেবে চন্দন সেনেরও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হয়ে থেকে যাবে এই নাট্য। এই সময়ে দাঁড়িয়ে মঞ্চায়নের জন্য এইরকম একটি নাটক নির্বাচন করার জন্যও তাঁকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। জটিলতাহীন কম্পোজিশন, আলোকসম্পাত এবং নিপুণ অভিনয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার ফলে নাটকটির অন্তর্বস্তু খুব সহজেই দর্শকদের কাছে পৌঁছে যায়।
আরও পড়ুন- সত্যজিতের চিত্রনাট্য সত্যিই কি চুরি করেছিলেন স্পিলবার্গ?
বাস্তবিকই, এই বায়োপিকটি নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে আমাদের, একইসঙ্গে মুখোমুখি করে বেশ কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রের, প্রণোদিত করে তাঁদের ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে। এই নাট্যে চরিত্র হিসেবে যেমন রয়েছেন জহরলাল নেহেরু, সি ভি রমন বা হোমি ভাবা, তেমনই আছেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, যিনি ছিলেন মেঘনাথ সাহার ‘মেন্টর’। অবশ্য কেবল অতীতেই দাঁড়িয়ে থাকে না নাটকটি। মাঝে মাঝেই বেশ কয়েক কদম এগিয়ে ঢুকে পড়ে আজকের ভারতে। দেখায় যে, আজও বিজ্ঞানচর্চা কীভাবে অন্ধ বিশ্বাস, রাজনীতি, এবং বর্ণাশ্রমের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। সময়ের নিরিখে এই উলম্ফন মাঝে মাঝেই এই প্রশ্ন তুলে দেয় যে, স্বাধীনতা এবং ঠিক স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতবর্ষের থেকে এই ২০২৫-এর ভারতে আমরা এক কদমও আসলে এগোতে পেরেছি কি, বিশেষ করে বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারের ক্ষেত্রে?
নাটকটি দেখায় কীভাবে মেঘনাথ সাহা একজন নিম্ন বর্ণের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানচর্চায় একটি শীর্ষ নাম হয়ে ওঠেন। এ-নাটক, একদিক থেকে, এক ব্যক্তির নয়, নিম্নবর্ণের মানুষের সংগ্রামেরই নাটক। ‘ছোটোজাত’-এর মানুষ হওয়ার কারণেই সরস্বতী পুজোয় বালক মেঘনাদকে উচ্চবর্ণের মানুষদের সঙ্গে অঞ্জলি দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। সেই থেকে শুরু হয় তাঁর লড়াই। ক্রমশ তিনি বুঝতে পারেন যে, এদেশে অন্য পরিসরগুলির মতোই বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও বর্ণাশ্রম এক বড় বাধা। তাঁর গুরু প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেন, “আমাদের দেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সবচেয়ে বড় অন্তরায় কী জানো? আমাদের হিন্দু সমাজের এই জাতি বৈষম্য নীতি। অথচ একটা সময়ে কিন্তু জাতি বিভেদ এতটা কঠোর ছিল না। মনু পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্যবাদের জয়জয়কার শুরু হল! ব্রাহ্মণদেরই কেবল বেদ ও শাস্ত্রে অধিকার এবং তারাই শ্রেষ্ঠ। আর যারা নিজ হাতে কাজ করে, কায়িক শ্রম দিয়ে উৎপাদন করে – তারা সবাই নীচু জাত, ছোটোলোক – উচ্চশিক্ষায় তাদের কোনো অধিকার নেই। অর্থাৎ একদিকে চিন্তাশীল সমাজকে বস্তুজগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল, আবার অন্য দিকে কারিগর, শ্রমিকদের উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হল”। তাঁর গুরুর মতোই এই বিভাজনই যে ভারতের বিজ্ঞান চর্চার প্রভূত ক্ষতি করেছে– এই কথা বিশ্বাস করতেন মেঘনাদ সাহাও। নিজের বর্ণপরিচয়ের জন্য তিনি জীবনের নানা ক্ষেত্রে বারবার বঞ্চিত ও অপমানিত হয়েছেন। শিকার হয়েছেন হাত আর মাথার কর্মবিভাজনের। তাই তাঁর গবেষণাগারগুলিতে বারবার হাত আর মাথাকে মেলাতে চাইছেন তিনি– নাটকটি সামনে আনে এই সত্য।
নাটকের শুরুতেই সাইক্লোট্রন যন্ত্রের পাম্প খারাপ হয়ে যাওয়ায় সেই পাম্প সারাতে হাত লাগাতে চান মেঘনাদ নিজেই। তাঁকে দেখে এ কাজে শেষমেশ হাত লাগান তাঁর শিষ্যরাই। নাটকটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রাজনীতির সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন। আজও যেমন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয় যুক্তিবাদী মানুষকে, সেদিনও তেমন হয়েছিল। মেঘনাদ সাহাকে তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধের জন্য হুমকি দিয়ে যাচ্ছে উগ্র হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা– নাটকটি বড় গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করে এই দৃশ্য; করে অতীতকে স্থাপন করে আজকের ভারতে। একইভাবে নাটকটি দেখায় কীভাবে জ্ঞানচর্চার জগতেও রাজনীতির শিকার হন মেঘনাদ সাহা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি প্রথম নিউক্লিয়ার ফিজিক্স পড়াতে শুরু করেন, তাঁরই একক প্রচেষ্টায় স্থাপন করেন ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। কিন্তু, টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর প্রথম পরিচালক করা হয় তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হোমি জাহাঙ্গীর ভাবাকে, যিনি বারবার আটকে দিতে থাকেন মেঘনাথ সাহার প্রাপ্য গ্রান্ট। ব্যাহত হয় তাঁর গবেষণা। কলকাতা নয় ভারতে নিউক্লিয়ার গবেষণার মূল কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মুম্বাই। এই দৃশ্যও আজ খুব অচেনা কি? বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা কেন্দ্রগুলির অন্দরে একটু উঁকিঝুঁকি দিলেই জানা যাবে কীভাবে পশ্চিমবাংলার গবেষণা প্রতি মুহূর্তে দিল্লির বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।
আরও পড়ুন- নাটকের পথ তীক্ষ্ণ, মৃত্যুর পথ শান্ত, ফিরে দেখা নাট্যযোদ্ধা শাঁওলি মিত্রের যাত্রাপথ
নাটকটির আর একটি জোরের জায়গা হল রাজনীতিক মেঘনাদ সাহাকে সামনে নিয়ে আসা। একসময় মেঘনাদ সাহা ছিলেন আরএসপি-র সক্রিয় কর্মী। বাম মতাদর্শে বিশ্বাসী এই বিজ্ঞানী ১৯৫২ সালের নির্বাচনে জিতে কলকাতা উত্তর পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদও হন। তাঁর রাজনীতিতে যোগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল অনেক। মেঘনাদ সাহা নিজেই এর উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “বিজ্ঞানীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ করা হয় যে, তাঁরা রূপকথার জগতে থাকেন…আমি নিজেও আমার জীবনে বাল্যকালের একটি ঘটনা ব্যতীত ১৯৩০ সাল পর্যন্ত গজদন্ত মিনারেই বাস করেছি। বর্তমান সমাজে বিজ্ঞানও প্রযুক্তি আইন-শৃঙ্খলার মতোই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ফলে আমিও ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছি। তবে এর প্রধান কারণ আমি আমার সামান্য কাজের মাধ্যমে নিজেকে দেশমাতৃকার উন্নতি কর্মের অংশ করে নিতে চেয়েছি”। গান্ধীজীর মডেলে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। কেবল খাদি আর কৃষি যে ভারতের ভবিষ্যৎ হতে পারে না– এ কথা বারবার নাটকটিতে জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করেন মেঘনাদ। প্রকৃত অর্থেই তিনি ভারী শিল্পের পক্ষে ছিলেন, শিল্পায়ন ছাড়া যে নতুন ভারত গড়া অসম্ভব, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দ্রুত এই কথা অনুভব করেছিলেন তিনি। ছিলেন নদীগুলিকে বাঁধ দিয়ে সংস্কারের পক্ষেও। বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ভারতীয় বর্ষপঞ্জির সংস্কারও করেছিলেন মেঘনাদ সাহা।
বাল্যে একবার যে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কথা মেঘনাথ বলেছেন, তা এই নাট্যে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে নেহাতই কিশোর ছাত্র হিসেবে জড়িয়ে পড়েছিলেন মেঘনাদ সাহা। তখন তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। তাঁদের বিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্য তৎকালীন গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার আসলে মেঘনাথ সাহা ও তাঁর কয়েকজন সহপাঠী খালি পায়ে স্কুলে এসে গভর্নরকে অসম্মান করেন। ফলে তিনি হারান বৃত্তি, বিতাড়িত হন স্কুল থেকেও। আজকের ভারতে এটি বোধহয় এই নাট্যের দেওয়া সবচেয়ে বড় বার্তা। যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানমনস্ক যে কোনো ব্যক্তিকেই আজ দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশদ্রোহী হিসেবে। এই নাটক প্রমাণ করে যে, দেশকে নিবিড় ভাবে ভালোবেসেও যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানের চর্চা করা সম্ভব। সত্যি কথা বলতে কী দেশকে প্রকৃত অর্থে ভালবাসলে একজন মানুষ যুক্তিবাদী না হয়ে পারেন না— এই নাটক এই ভাবনাটিকেই সর্বাগ্রে স্থাপন করে।

Whatsapp
