কন্ঠে উত্তম থেকে লতা-আশা! ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ তবু অদ্বিতীয়

Mahishasuramardini: মহালয়ার এই বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠানে বদল আনা অবশ্য নতুন কোনো ঘটনা ছিল না। ভারত স্বাধীন হবার আগে কয়েকবছর পঙ্কজবাবু এই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে বিরত থাকেন।

১৯৭৬ সালে মহালয়ার তিথি পড়েছিল ২৩ সেপ্টেম্বর। জরুরি অবস্থায় ভারত তখন এক কঠিন সময় অতিক্রম করছিল, সেই সময় এই দিনটি আকাশবাণীর কাছেও হয়ে উঠেছিল একপ্রকার অ্যাসিড টেস্টের মতো। কারণ চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে পিতৃপক্ষের অবসান এবং দেবীপক্ষের সূচনালগ্নে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর প্রারম্ভের চিরাচরিত ঘোষণা যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আকাশবাণী দিয়ে আসছে, তাতে বদল আসতে চলেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে মহালয়ার ভোরে বাণীকুমার রচিত, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গীত-সর্জন এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গ্রন্থনায় পরিবেশিত ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র পরিবর্তে সম্প্রচারিত হবে সম্পূর্ণ নতুন একটি অনুষ্ঠান– ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’।

ঐতিহ্যবাহী প্রভাতী অনুষ্ঠানের রীতির খোলনলচে বদলানো ড. ধ্যানেশ নারায়ণ চক্রবর্তী রচিত এই আলেখ্যটি তৈরিতে কোন কার্পণ্য করা হয়নি। শ্রোতাদের জন্য হাজির করা হয় চমকের পর চমক। যিনি এককালে পূর্বতন ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে যেমন সঙ্গীত-পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় তেমনই কন্ঠসংগীতের জন্য বাংলার প্রথম সারির শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলের নামও। শুধু তাই নয়, অনুষ্ঠানটির চাকচিক্য ও আকর্ষণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সবথেকে বড় চমকটি রাখা হয়েছিল অনুষ্ঠানটির বাংলা ভাষ্যপাঠে। বসন্ত চৌধুরী, পার্থ ঘোষ, ছন্দা সেনের সঙ্গে নির্বাচন করা হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের একমেবাদ্বিতীয়ম ব্যক্তিত্ব-মহানায়ক উত্তমকুমারের কন্ঠস্বরকে। আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে নতুন অনুষ্ঠানটিকে ‘ব্লকবাস্টার’ করতে কর্তৃপক্ষ যে আদাজল খেয়ে নেমেছিল তা বোঝাই যায়। আর তাই আয়োজনও ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় সবদিক থেকেই অধিক। আগে যেখানে বাংলায় গ্রন্থনার পাশাপাশি সংস্কৃত স্তোত্র একাই পাঠ করতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, সেখানে এই নতুন অনুষ্ঠানে শুধু সংস্কৃত স্তোত্রপাঠই করানো হয়েছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় ও মাধুরী মুখোপাধ্যায় অর্থাৎ মোট চারজনকে দিয়ে।

আরও পড়ুন- এসেছেন বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথও! মানকরের কবিরাজ বাড়ির দুর্গাপুজোর ৩০০ বছর

তবে এত চমক, বিজ্ঞাপন সত্ত্বেও অনুষ্ঠানটি শেষ হতে না হতেই শ্রোতাদের উৎসাহ ও কৌতূহল এক লহমায় বদলে গেল হতাশা, অভিযোগ ও সর্বোপরি ‘পুরনো মহিষাসুরমর্দ্দিনী’কে ফিরিয়ে আনার অনুরোধে।

সংবাদপত্রের দফতরগুলিতে আছড়ে পড়তে লাগলো শ্রোতাদের একের পর এক অভিযোগের চিঠি। প্রশ্ন উঠবে, অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে এত চমক, বিজ্ঞাপনের পরেও কেন তা শ্রোতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারল না? এর উত্তর মিলবে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক কৃষ্ণ ধরের এক বাংলা দৈনিকে লেখা চিঠিতে। তাঁর বয়ানে এই অনুষ্ঠানটি আদতে যেন সোনার প্রতিমার ন্যায়– যা চোখ ঝলসে দিলেও, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে গেলে উপলব্ধি করা যায় যে রূপ আছে, প্রাণ নেই।

মহালয়ার এই বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠানে বদল আনা অবশ্য নতুন কোনো ঘটনা ছিল না। ভারত স্বাধীন হবার আগে কয়েকবছর পঙ্কজবাবু এই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে বিরত থাকেন। আরেকবার সম্পূর্ণ অন্য নামে একটি ভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। পঙ্কজ কুমার মল্লিকের অনুপস্থিতিতে মহালয়ার ভোরে একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং একবার বিজনবালা ঘোষ দস্তিদার ও শচীন দাশ (মতিলাল) সঙ্গীত পরিচালনা করেন। সেটিও শ্রোতারা ভালোভাবে নেননি।

আসলে শিল্পী চয়ন ও আয়োজনে খামতি না থাকলেও, ১৯৭৬ সালের নতুন এই অনুষ্ঠানটিতে ছিল আন্তরিক ও নিবেদিত প্রাণের অভাব। যেখানে কোনো শিল্পী অনুষ্ঠানের তিনমাস আগে থেকে মহলা দেওয়ার সময় বের করতে না পারলে পঙ্কজ কুমার মল্লিক তাঁকে অনুষ্ঠানে রাখতেন না সেখানে নতুন এই অনুষ্ঠানে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র মত করে মহলা তো দূরে থাক, রেকর্ডিংয়ের দিনও শিল্পীদের মধ্যে ছিল স্ক্রিপ্ট নিয়ে ধোঁয়াশা। তার সঙ্গে ছিল সমন্বয়ের ঘাটতি। আলেখ্যটিতে লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলের গানের অংশটুকু রেকর্ড করা হয় বোম্বে স্টুডিওয়। ফলে একটি পরিপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সমগ্র অনুষ্ঠানটিতে যে মেলবন্ধনের প্রয়োজন ছিল তা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। উপরন্ত দুর্গাপুজোর মধ্যে অন্য কোনো দিন চয়নের বদলে, মহালয়ার ভোর রাতটিকে নির্বাচন এবং কালজয়ী সঙ্গীত-বিথীর উপর কোপ পড়া অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল।

সে’জন্য একটা সময়ে ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’-এ প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং অনুষ্ঠানটিকে ঘষামজা করে পুনরায় সম্প্রচারের কথা ভাবা হলেও শেষ পর্যন্ত পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের মহালয়ার ভোরে ফিরে আসে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। আকাশবাণীর পুরোনো টেপ থেকে বিভিন্ন বছরের ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র অংশবিশেষের স্পুল নিয়ে একটি পূর্নাঙ্গ সম্পাদিত সংকলন তৈরি করেন আকাশবাণীর সুধীর মুখোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে এই সংকলনটির রেকর্ডই ১৯৭৮ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি বাণিজ্যিক ভাবে প্রকাশ করে এবং বহুল প্রচলিত এই সংকলনটিই সারা বছর ধরে সব জায়গায় শুনতে পাওয়া যায়।

‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র তিন মহারথীর একজন বাণীকুমার প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে। তিনি ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’কে বাতিল করা এবং পরবর্তীতে আবার ফিরিয়ে আনা দেখে যেতে পারেননি। ১৯৬২ সালের পর ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র সরাসরি সম্প্রচার চিরতরে বন্ধ হয়ে রেকর্ড করা টেপ সম্প্রচার করার প্রচলন হবার পরেও প্রতি বছর সম্প্রচারের সময় সজাগ হয়ে সম্প্রচারের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। খেয়াল রাখতেন প্রথম টেপের শেষ ও দ্বিতীয় টেপের শুরুর সময় ফেড-ইন ঠিকমত হচ্ছে কিনা সেদিকেও। কিন্তু এই ঘটনার পর ১৯৭৭ সাল থেকে আর কোনোদিন মহালয়ার আগের রাত থেকে আকাশবাণীতে পৌঁছে যেতে দেখা যায়নি তাঁকে। যদিও তিনি জানিয়েছিলেন নতুন এই অনুষ্ঠানের জন্য তাঁর কোনো খেদ নেই, কিন্তু অনুষ্ঠানের পর চিরাচরিত মহিষাসুরমর্দ্দিনীকে ফিরিয়ে আনার জন্য শ্রোতাদের বিপুল অনুরোধে তিনি মনে করেছিলেন তাঁর শ্রম স্বার্থক হয়েছে।

আরও পড়ুন- জঙ্গলেই প্রথম পুজো করেন রাজা সুরথ! কেমন ছিল প্রথম দুর্গাপুজো?

পঙ্কজকুমার মল্লিক এই নতুন অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলেছিলেন যে, “এই অনুষ্ঠান অমরলোকের সন্ধান দিতে পারেনি”। আগামী বছর আকাশবাণী পুনরায় ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ ফিরিয়ে এনে তাঁকে সঙ্গীত-পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করতে চাইলে, তিনি আর এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না বলেও ব্যক্ত করেন। ১৯৭৭ সালে কলকাতা কেন্দ্রের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানী তাঁকে সম্বোধন করে ঘোষণা করেন যে, সেই বছর থেকে পুনরায় ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ই সম্প্রচার করা হবে। সেই অনুষ্ঠানে দেখা গেল পঙ্কজবাবুর দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।

‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’-এ অংশগ্রহণকারী অন্যতম কণ্ঠশিল্পী বনশ্রী সেনগুপ্ত একবার আক্ষেপ করেছিলেন যে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে গানটি তোলার জন্য যে ক্যাসেট দিয়েছিলেন তা তিনি রেখে দিতে পারেননি। সত্যি কথা বলতে অনুষ্ঠানটি ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’কে ছুঁতে না পারলেও, হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়ার মতও নয়। শ্যামল গুপ্তের রচনায় জয় সিংহবাহিনী, সুধা তরঙ্গিনী ‘হে দশভুজা’ শীর্ষক গানগুলি-সহ সমগ্র অনুষ্ঠানটিই প্রশংসার দাবি রাখে।

তবে মহিষাসুরমর্দ্দিনীর সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যাওয়াটাই বিপুল সমালোচনার মূল কারণ। কারণ মহালয়ার ভোরে ‘অমরলোকের সন্ধান’ একমাত্র দিতে পারে কালজয়ী ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ই।

More Articles