বিদায়ের বিষাদে ফিরে দেখা ভারতের নাইটিঙ্গলের জীবন
চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর। বলিউডের সঙ্গীত ক্ষেত্রটিকে হরেক রকম গানের সম্পদে সম্মৃদ্ধ করেছেন প্রায় অর্ধ শতকেরও বেশি সময় ধরে। ‘এক প্যায়ার নগমা হায়’ থেকে ‘লগ জা গলে’ —তরঙ্গে তরঙ্গে চলকে ওঠে ‘ভারতের নাইটিঙ্গলে’র সুরেলা কণ্ঠ। গেয়েছেন প্রচুর আধুনিক গানও। আসুন, আজ এক ঝলক দেখে নিই তাঁর সমস্ত জীবন এক ঝলকে-
১৯২৯, ২৮ সেপ্টেম্বর মারাঠি সঙ্গীতের দিকপাল পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ও সেবন্তীর পরিবারে জন্মান লতা। মীনা খড়িকর, আশা ভোসলে, উষা মঙ্গেশকর এবং হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের বড় বোন লতার জন্মের সময় প্রদত্ত নাম ছিল হেমা। কিন্তু পরবর্তীতে বাবার লেখা নাটক ‘ভাও বন্ধনে’র ‘লতিকা’ চরিত্রটির নামে তাঁর পুনরায় নামকরণ করা হয়।
১৯৩৫ -খুব অল্পবয়েস থেকেই লতার বাবা লতাকে সঙ্গীতশিক্ষা দিতে শুরু করেন। মঙ্গেশকর নামটি আসলে গোয়ার ছোট্ট শহর মঙ্গেশির বাসিন্দাদের বোঝাত। দীননাথ সেটি পদবি হিসেবে গ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়েস থেকেই লতা বাবার গীতিনাট্যগুলিতে অভিনয় করতে শুরু করেন।
১৯৪১-ভারত স্বাধীন হওয়ার আগেই সঙ্গীতশিল্পী জীবন শুরু হয়েছিল লতার। মাত্র বারো বছর বয়েস তখন। এই বছর ১৬ ডিসেম্বর জীবনে প্রথমবার দুটি গান স্টুডিওতে রেকর্ড করেন তিনি।
১৯৪২- হৃদরোগে বাবার মৃত্যু। নওইয়ুগ চিত্রপট নামে একটি মুভি কোম্পানির মালিক বিনায়ক দামোদর কর্ণাটকী, মঙ্গেশকর পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তিনিই ছোট্ট লতার অভিনয় ও গানের গুণের কদর করলেন। সেই কোম্পানিরই ছবি ‘পেহলি মঙ্গলা-গওর’ সিনেমায় প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পেলেন লতা। এবং সেই ছবিতেই গাইলেন ‘নটলি চৈত্রাচি নওলাই’--প্রথম প্লে ব্যাক। তার আগে ‘নাচু ইয়া গড়ে, খেলু সারি মানি হউস ভারি’ গানটি ‘কিতি হসাল’ ছবির জন্য রেকর্ড করা হলেও ফাইনাল কাটে বাদ যায়।
১৯৪৩- মারাঠি ছবি ‘গজাভাউ’-এ প্রথম হিন্দি গানটি গাইলেন লতা– ‘মাতা এক সপুত কি দুনিয়া বদল দে তু’।
১৯৪৫- কর্ণাটকী নওইয়ুগ চিত্রপটের হেডকোয়ার্টার মুম্বইয়ে নিয়ে গেলে লতাও মুম্বইয়ে চলে আসেন বসবাসের জন্য। সেখানে কর্ণাটকী হিন্দুস্থানি ক্লাসিকল সঙ্গীতে লতার প্রশিক্ষণ শুরু করান ভিণ্ডিবাজার ঘরানার উস্তাদ আমন আলি খানের কাছে।
১৯৪৬-‘আপ কি সেওয়া মেঁ’ ছবির ‘পা লাগুঁ কর জোড়ি’ গানের মদ্যে দিয়ে হিন্দি সিনেমা জগতে পা রাখলেন লতা।
১৯৪৮-কর্ণাটকী সাহেব মারা যাওয়ার পরপরই লতার সঙ্গীতশিক্ষার ব্যাপারটির দেখাশোনা শুরু করেন সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দর। প্রযোজক শশধর মুখার্জীর ‘শহিদ’ ছবিতে খারিজ হওয়ার পরে মূলধারার হিন্দি সিনেমা ‘মজবুর’-এর ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কহিঁকা না ছোড়া’ গানটির প্লে ব্যাক করেন লতা।
১৯৪৯-মধুবালার লিপে ‘মহল’ ছবির ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি লতার অত্যন্ত জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম।
পঞ্চাশের দশক
লতার স্বর্ণযুগের শুরু। একদিকে চুটিয়ে গান গাইছেন বিভিন্ন ভাষার ছবিতে, আরেকদিকে নিজে প্রযোজনা করছেন চারটি ছবি–যার মধ্যে ‘ওয়াদল’ (মারাঠি, ১৯৫৩), ঝাঞ্ঝর (হিন্দি, ১৯৫৩) এবং ‘কাঞ্চন গঙ্গা’র (হিন্দি, ১৯৫৫) মতো সিনেমাও রয়েছে।
১৯৬৩- ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগোঁ’ জনপ্রিয় হল। লতার কণ্ঠে এই গান শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওয়াহর লাল নেহ্রু। প্রসঙ্গত, তখন ইন্দো-চীন যুদ্ধ চলছে। এবছরেই সঙ্গীত পরিচালকদ্বয় লক্সমিকান্ত্-প্যায়ারেলালের পরিচয় হয় লতার। এরপরে ওঁদের সুরে প্রচুর গান গাইবেন লতা, পারস্পরিক সম্পর্ক আরো গভীর হয়ে উঠবে তাঁদের। ‘মিঃ এক্স ইন বোম্বে’, ‘মেরে হামদম মেরে দোস্ত’, ‘ইন্তেকাম’, ‘দো রাস্তে’ ইত্যাদি একের পর এক হিট স্মরণীয় এ প্রসঙ্গে।
ষাটের দশক
এই সময়ে লতা সঙ্গীত পরিচালনা ক্ষেত্রটিতে একটু একটু করে আসন করে নিচ্ছিলেন। ‘আনন্দ ঘন’ ছদ্মনামে মারাঠি ছবি ‘রাম রাম পভন’ (১৯৬০), ‘মারাঠা টিটুকা মেলাওয়া’ (১৯৬৩), ‘সধি মানসে’ (১৯৬৫) এবং ‘তামবাড়ি মাটি’ (১৯৬৯)-তে সঙ্গীত পরিচালনা করছেন এবং মারাঠা সরকার তাঁকে ‘সধি মানসে’-র জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত-পরিচালকের সম্মানে ভূষিত করছে। ‘ঐরানিচ্চ দেওয়া তুলা’ গানটি শ্রেষ্ঠ গানের সম্মান পাচ্ছে।
১৯৬৯-সঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষে মন ভিরিয়ে রাখার জন্য ১৯৬৯ সালে লতাকে পদ্মভূষণ উপাধি দেওয়া হয়।
১৯৭৪-প্রথম আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান লতার। লণ্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে ভারতীয় হিসেবে তিনিই প্রথম। এই বছরেই, ১৯৪৮-১৯৭৪ সময়কালে বিশ্বের সমস্ত সঙ্গীতশিল্পীর মধ্যে সর্বাধিক রেকর্ডিং থাকার জন্যে গিনিস বুক ওব ওয়ার্ল্ডে নাম ওঠে তাঁর। দাবি করা হয় সেই সময় ২৫০০০ একক সঙ্গীত, দ্বৈতসঙ্গীত ও কোরাস রেকর্ড করেছেন লতা কুড়িটি ভিন্ন ভিন্ন ভারতীয় ভাষায়। যদিও ১৯৯১এর পর থেকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এন্ট্রিটি মুছে দেওয়া হয়।
সত্তরের দশক
এ সময় লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল জুটি ও আর ডি বর্মণের সুরে একের পর এক জনপ্রিয় গান গাইছেন লতা। কিশোর কুমার, মান্না দে, মুকেশ, মহম্মদ রফি, আশা, ঊষা, হেমন্ত–সমস্ত নামকরা শিল্পীর সঙ্গেও কাজ করে চলেছেন।
১৯৮৯- দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাচ্ছেন।
১৯৯৭-রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ পুরস্কার মহারাষ্ট্র-ভূষণ পাচ্ছেন।
১৯৯৯-ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার পদ্ম-বিভূষণ পাচ্ছেন লতা মঙ্গেশকর।
২০০১-ভারতীয় সিনেমা এবং সঙ্গীতের জগতে অবদানের জন্য তাঁকে দেওয়া হচ্ছে ভারতরত্ন পুরস্কার, ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার।
২০০৯- ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হচ্ছে তাঁকে, ‘অফিসার অফ দ্য ফ্রেঞ্চ লিজিয়ন অফ অনার’।
২০১২- এল এম মিউজিক থেকে বোন ঊষার সঙ্গে একটি ভজনের অ্যালবাম বেরোচ্ছে তাঁর।
২০১৫- লতা তাঁর শেষ গানটি গাইছেন। কপিল শর্মা অভিনীত ‘ডোন্নো ওয়াই…না জানে কিউঁ’ এর সিক্যুয়্যাল ‘ডোন্নো ওয়াই 2…লাইফ ইজ আ মোমেণ্ট’ ছবির গান সেটি। লতা নিজস্ব স্টুডিওতে রেকর্ড করেন গানটি।
২০২২-বিদায় নিলেন ভারতের সাধের ‘নাইটিঙ্গল’। আগামী দুদিন জাতীয় শোকদিবস ঘোষণা করেছে সরকার। এই দুদিন ভারতীয় পতকা অর্ধনমিত থাকবে।