অরুন্ধতীর অক্ষরের সরোবরে আমাদের ছায়া পড়ে
Arundhati Roy: যে কোনো ঘটনাকে এই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবার সারল্যই তাঁকে পৃথক করছে, বারবার। আবার সেই সারল্যই নগ্ন শিশুর মতো প্রশ্ন করছে রাজাকে। প্রতি মুহূর্তে তিনি চ্যালেঞ্জ করছেন সমাজ অব্যবস্থাকে।
ঠাকুমা বলত, ‘অলক্ষ্মীরে কুলার বাতাস দিয়া বাড়ির বাইর কইরতে অয়’। অলক্ষ্মী হলো লক্ষ্মীর বিপরীত ছায়া। লক্ষ্মী যদি শ্রী-সম্পদে উপচে দেন ভক্তকে, অলক্ষ্মী তবে শ্রী-হীন করেন। কপর্দক শূন্য হয়ে রাজাও পথের ভিখারি হয়ে যেতে পারেন গৃহে অলক্ষ্মীর পা পড়লে। অতএব, অলক্ষ্মী আমাদের কাছে পরিত্যাজ্য, সমাজ থেকে, গৃহ থেকে, সমস্ত মঙ্গলচিহ্ন থেকে। সমস্ত ভালোর সংজ্ঞা জুড়ে কেবল আছেন লক্ষ্মী। এমনকি, লিঙ্গ ভেদেও সেই সংজ্ঞা থাকে অটুট। ভালো ছেলেদেরও মায়েরা প্রায়ই লক্ষ্মীছেলে বলে থাকেন। যে মেয়েরা বেশি কথা বলে, স্বামী শ্বশুরকুল কিংবা সমাজের দোষ দেখতে পায় তারা সমাজের লক্ষ্মীমন্ততার মাপকাঠিতে অলক্ষ্মী। এমনই একজন লেখক অরুন্ধতী রায়। তিনি যা লেখেন তাঁর প্রতিটি শব্দ থেকে উঠে আসে সত্যের তীব্র স্বর। তাঁর যাবতীয় লেখা, প্রতিটি বক্তব্য সমাজের কিছু ধারাবিবরণী কিন্তু চাবুকের মতো উদ্যত। লেখার গভীরে খুঁজলে দেখা যায় এক কাকচক্ষু সরোবর, তাতে ছায়া পড়েছে আমাদেরই। 'দ্য ম্যান্ডিবলস’-এর লেখক লায়োনেল শ্রিভার একবার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন,
‘আপনার ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ সত্তার জন্য কথাসাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় না? একই সঙ্গে, এই যে রাজনীতির যূপকাষ্ঠে আপনার ঘাড় পেতে দেওয়া, এর কারণেও আপনার সাহিত্যের প্রতি পাঠক সমালোচকের ভিন্ন দাবি তৈরি হয়। ব্যাপারগুলো কীভাবে সামলান?’
অরুন্ধতী বলেছিলেন,
‘অ্যাক্টিভিস্ট শব্দের সঙ্গে আমার বিরোধ আছে, আমাকে প্রায়ই এ শব্দের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। আমার মনে হয়, এই শব্দটি নতুন এসেছে। কখন এর জন্ম হলো আমি জানি না। তবে সম্প্রতি তার সন্দেহ নেই। লেখালেখি ছাড়া আমার দ্বিতীয় কোনো পেশা নেই। লেখাই পেশার সবটুকু। পুরনো দিনের দিকে যদি তাকাই, দেখি, লেখকরা রাজনৈতিক জীব। সবাই না হলেও বেশির ভাগ। লেখকের কাজই তো এই— চারপাশে যা ঘটছে তার দিকে ভিন্ন চোখে তাকানো। সুতরাং, ‘অ্যাক্টিভিজমের’ জন্য কথাসাহিত্যে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে– এমন আমার মনে হয় না বা তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আমার কথাসাহিত্য, মননশীল সাহিত্য দুটোই কিন্তু রাজনৈতিক। কথাসাহিত্য যদি পৃথিবী হয়, তাহলে মননসাহিত্য তার পার্থিব যুক্তি। আমি বরং অন্য কিছু নিয়ে চিন্তিত। তীব্র দুশ্চিন্তা কাজ করে যখন দেখি লেখকরা রাজনৈতিক হয়ে উঠছেন না। একটা ভয়ঙ্কর চিন্তার উদ্ভব ঘটছে, তা হলো, ধরে নেওয়া হচ্ছে লেখকরা হবেন নিছক এক পণ্যের স্রষ্টা, যে পণ্য ক্রেতারা সাদরে নেবেন। অতঃপর গলাধঃকরণ নিরঙ্কুশ সমাধান হবে, লেখক ভালোবাসা পাবেন, হয়ে উঠবেন ‘বেস্টসেলার’! এটা ভীষণ আতঙ্কের। ভারতের কথাই ধরা যাক। ভারতে সংখ্যাধিক্যবাদ (মেজরিটারিয়ানিজম) শেকড় গেড়ে বসছে। আমি শুধু সরকারের কথা বলছি না, ভারতে বর্তমানে প্রতিটি মানুষই একেকজন খুদে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। সংখ্যাধিক্যবাদী ওই সব মনপছন্দ লেখার প্রভাব। তাৎক্ষণিক জনরোষ জমাট বাঁধছে, সহিংসতা ঘটছে, ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষকে। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে একজন লেখকের লক্ষ্য নিয়ে আমি কী বলতে পারি? বলতে পারি এটাই যে, লেখককে হতে হবে অপ্রিয়ংবদ। লেখক বলবেন অপ্রিয় সত্য কথা। অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন, লেখককে স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে অজনপ্রিয় হওয়ার জন্য লিখতে হবে। বলতে হবে, আমি তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম, একা কি বহু, পরোয়া করি না।’
আরও পড়ুন
আত্মসংলাপের মধ্যে দিয়ে মানুষের কাছে ফিরে গিয়েছেন মণিকুন্তলা সেন
এ কথা যিনি বলছেন তাঁর লেখা প্রথম বই ‘গড অফ স্মল থিংস’ বুকার পুরস্কার পেয়েছে। অগণিত ভক্ত পাঠকেরা আছেন বিশ্বজুড়ে। এবং তিনি যে কেবল কথার কথা বলার জন্য এমনটা বলছেন না, তার প্রমাণ মেলে তাঁরই লেখাতে। ২০২৫ সালে লিখলেন ‘মাদার মেরি কামস টু মি’। লিখলেন ব্যক্তিগত গল্প। মিসেস মেরি রায় অর্থাৎ অরুন্ধতীর মা বিয়ে করেছিলেন বাড়ি থেকে পালাতে। বাবা-মায়ের তৈরি করা অসহনীয় একটা পরিবেশ থেকে কেবল বেরোনোর জন্য আরও অনেক অনেক উপমহাদেশীয় মেয়েদের মতোই মেরি রায় বিয়ে করে ফেললেন প্রথম প্রেম নিবেদন করা পুরুষকেই। এ যেন সেই, দরজা খুলে প্রথম যাকে দেখা তাকেই বিয়ে করা সেই অভিশপ্ত রাজকুমারীর গল্পের মতো, তবে সত্যি ঘটনা। বিয়ের পর, দুটি সন্তানের জননী হওয়ার পর মেরি জানতে পারেন স্বামীর তীব্র মাদকাসক্তি এবং চা-বাগানের কম বয়সি অধস্তন পুরুষ কর্মচারীদের সঙ্গে স্বামীর নিয়মিত শারীরিক সম্পর্কের কথা। ব্যথিত অপমানিত মেরি বুঝতে পারেন এই পাণ্ডববর্জিত চা-বাগানে এমন কারও স্ত্রীর পরিচয়ে সংসার করাটা তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। আসাম থেকে তিনি পালিয়ে আসেন ছোট ছোট দুটি ছেলেমেয়ের হাত ধরে। এইরকম হাজারও সত্যিকে দু-মলাটে বলেছেন অরুন্ধতী। বলেছেন, যে মা স্কুলে পড়ানোর সময় বয়ঃসন্ধির ছাত্রদের নিজের অন্তর্বাস আনতে পাঠান হস্টেল থেকে, যাতে তারা তাদের সহপাঠিনীদের উত্যক্ত না করে, সেই মা-ই নিজের ছেলেকে বলেন, ‘মেল শভিনিস্ট পিগ’। বাবার বেধড়ক মার একদিন যে মেরিকে বিয়ে করে পালিয়ে বাঁচতে বাধ্য করেছিল, সেই মেরি মেয়ের সামনে নিজের ছেলেকে সেইভাবেই ঠ্যাঙান পড়াশোনায় মাঝারি গ্রেড পেয়েছে বলে। জেনেরেশনাল ট্রমা ক্যারিফরওয়ার্ড হচ্ছে। অরুন্ধতি সত্যি লিখছেন। লিখছেন অকুতোভয় সেই মেরির কথা, যিনি তাঁর নিজের মা, কিন্তু লেখায় তাঁকে সম্বোধন করছেন মিসেস মেরি রায় বলে। নিজের একান্ত আপনটুকুকে বিশ্বের সামনে যেমন ছিল তেমনিভাবেই মেলে ধরা বড় সহজ কাজ নয়, কিন্তু অরুন্ধতী পেরেছেন।

অরুন্ধতীর কাছে তাঁরই লেখা বইয়ের (‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’) একটি কপি অর্ধেক দামে বিক্রি করতে এসেছিলেন একজন। পরে অরুন্ধতী জানান এই দেখে তিনি একটুও অবাক হননি বরং ‘বিমলানন্দ’ পেয়েছিলেন। অর্থাৎ একটি বই যেটা ৬৬ টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, তার পাইরেটেড কপি লেখকের কাছে আসছে অর্ধেক দামে, লেখক কেবল দেখছেন পাঠকের এই বিপুল চাহিদাকে। এই ব্যাপারটা তিনি পজিটিভলি নিচ্ছেন এবং এই প্রতিক্রিয়া পেয়ে যে তাঁর অনাবিল আনন্দ হচ্ছে, সেটাও জনসমক্ষে নিজেই জানাচ্ছেন। যে কোনো ঘটনাকে এই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবার সারল্যই তাঁকে পৃথক করছে, বারবার। আবার সেই সারল্যই নগ্ন শিশুর মতো প্রশ্ন করছে রাজাকে। প্রতি মুহূর্তে তিনি চ্যালেঞ্জ করছেন সমাজ অব্যবস্থাকে।
আরও পড়ুন
বানু মুশতাকের ‘হার্ট ল্যাম্প’: মেয়েলি প্রতিরোধের আশ্চর্য ধরনধারণ
প্রচলিত বুলির বাইরে যিনি আলাদা কথা বলতে পারেন, তাঁর স্বাধীন কন্ঠ দেশের পক্ষে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে আশঙ্কার তো বটেই। তিনি কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভারত সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন বারবার। কথা বলেছেন মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সামরিক শক্তির অপব্যবহারের। তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য পেশ করার জন্য ইউএপিএ ধারায় দায়ের হয়েছে মামলা। এই ঘটনার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরেই তিনি ২০২৪-এ ‘পেন পিন্টার’ সম্মান পেয়েছেন নির্ভীক ও অবিচল থেকে সাহিত্য রচনার জন্য। তাঁর কাজ ধারাবাহিক ভাবে সামাজিক এবং বৈশ্বিক বিষয়ে সমালোচনা করার চিন্তা জাগিয়ে তুলছে জনমানসে।
ঠাকুমার সেই ‘কুলা’ হল কুলো, ধান বা অন্যান্য শস্য যাতে ঝাড়াই বাছাই করা যায়। কুলোর বাতাসে যেমন উড়ে যায় শস্যের অপ্রয়োজনীয় অংশ, তেমনি অলক্ষ্মী নাকি থাকেন অপরিষ্কার নোংরা জায়গায়, তাঁর মূর্তি তৈরি হয় গোবর দিয়ে, কলার ভেলা অর্থাৎ কলাগাছের কাটা অংশে সেই মূর্তি রেখে কুলোর বাতাস দিয়ে ঘরের বাইরে বের করে গৃহের ভেতরে লক্ষ্মীর আরাধনা শুরু করে ভক্ত। যিনি শুভফল লাভের শুরুতে কড়া পরীক্ষক, কুলোর বাতাস যার পুজোর অপরিহার্য নিয়ম, যে বাতাসে উড়ে যায় খাদ্যশস্যের অনাবশ্যকটুকু, তিনি কি কখনও ব্রাত্য হতে পারেন? যে অরুন্ধতী এই দুঃসময়ে আশার আলো জ্বালাচ্ছেন, চিনিয়ে দিচ্ছেন সকল কালো, অলক্ষ্মীর মতো পান করছেন সমাজের গরল, তাঁদের আমরা সত্যি চিনতে পারছি কি?
Whatsapp
