ধূসর দিনের গল্প: রাজ্যশ্রী ঘোষ

Bengali short story: একটা ব্লক চালাতে গেলে অনেক ভেবে চিন্তে, অনেক রকম মানুষকে নিয়ে চলতে হয়। আমি জানি এখানে এদের এরকম একটা নোংরা প্র্যাকটিস আছে, যেটা আপনাদের মতো ভদ্র ঘরের মহিলাদের জন্য মারাত্মক টক্সিক।
আসছিলেন ছুটে ছুটে স্টেশনগামী অটোটা ধরবেন বলে। বিডিও অফিসেরই অটো, দাঁড় করানো ছিল অফিস চত্বরেই। অফিসটা আসলে স্টেশন থেকে বেশ দূরে। তাই ব্লকের যেসব কর্মচারী ট্রেনে যাতায়াত করেন, সকালে তাঁদের স্টেশন থেকে আনা এবং বিকালে স্টেশন অবধি পৌঁছে দেবার জন্য বিডিও অফিসে মজুত থাকে দুইটি অটো। মিনতি পাইক ট্রেন ধরেন না। স্টেশন যাবার পথেই একদম রাস্তার ধারে তাঁর বাড়ি। বিডিও অফিস থেকে হেঁটে পনেরো মিনিট, অটোতে পাঁচ। অথচ সুকন্যা চ্যাটার্জি ধরবেন ট্রেন । তাঁর ট্রেনের টাইম বাঁধা। ওই অটোটা না পেলে পরের অটো ছাড়বে আধ ঘন্টা পর। ফলে নির্ধারিত ট্রেনটি তিনি আর পাবেন না। তাঁকে যেতে হবে পরের ট্রেনে। পরের বলতে এক ঘন্টা পরের। তবু প্রায় প্রতিদিনই রেষা-রেষি করে সুকন্যাকে টপকে অটোর সিটটা দখল করা চাই মিনতির। কেউ এই নিয়ে কথা বলতে এলেই তাকে শুনতে হবে,

“তাতে কী? ওকে তো আর স্বামী-সন্তানের জন্য রান্না করতে হয় না বাড়ি গিয়ে। রাত দশটায় বাড়ি পৌঁছালেই বা কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে মহারাণীর?” 

সেদিনও যথারীতি একদম লাস্ট মোমেন্টে, যখন ওই অটোর সমস্ত আরোহী বসে পড়েছেন এবং পিছনে কেবলমাত্র আর একটি সিটই ফাঁকা, অটোর দিকে এগিয়ে আসা সুকন্যাকে পিছনে ফেলে সিটটার দখল নেবার জন্য দৌড় লাগিয়েছিলেন মিনতি। কোত্থাও কিচ্ছু নেই সকলের সামনে লাল মোরাম বিছানো শুকনো ডাঙায় বেমক্কা আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন।

লজ্জিত মুখে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে তুরন্ত উঠে দাঁড়ালেন ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে ড্রাইভার মনোজ আর সুমতিদি ডেকে সুকন্যাকে তুলে নিয়েছেন গাড়িতে। 
এ যাত্রা ট্রেনটা সে পেয়ে যাবে। 

পথদুর্ঘটনায় সরকারি চাকুরিজীবী স্বামীর অকালমৃত্যু ঘটলে কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে বছর ছাব্বিশের সুকন্যা এই চাকরিটি পেয়েছে। লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের পোস্ট। প্রথম পোস্টিং এই বিডিও অফিসে। অফিসে পৌঁছাতে তার প্রায় দেড় ঘন্টা লাগে। কেবল ট্রেনেই লেগে যায় ঝাড়া একটি ঘন্টা। অফিসে সুকন্যাকে ট্যাগ করা হয়েছে ইলেকশন দপ্তরের সঙ্গে। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। ফলে এখন কাজের চাপও প্রবল। তবে কাজের চাপ নিয়ে সুকন্যার সমস্যা নেই। তার সমস্যা উটকো চাপ। 

সে যদি মহিলা না হয়ে পুরুষ হত, অথবা মহিলা হলেও সে যদি অল্পবয়সী এবং সুন্দরী না হত, অথবা অল্পবয়সী এবং সুন্দরী হবার সঙ্গে সঙ্গে যদি সে আপোসকামীও হত, তাহলে হয়তো এই দ্বিতীয় ধরনের চাপটি তার থাকত না। এর আগে এ জাতীয় অন্য কোনও অফিসে সুকন্যা চাকরি করেনি। ফলে অন্যান্য অফিসে কাজের পরিবেশ কেমন তা তার জানা নেই। এই অফিসে আসা ইস্তক সে লক্ষ করছে পুরুষদের মধ্যে বেশিরভাগই কেমন যেন হ্যাংলা, গায়ে পড়া এবং মহিলারা বেশিরভাগ ঈর্ষাতুর, প্রতিযোগিতাপ্রবণ। নিজের সার্ভিস বুক সংক্রান্ত ব্যপার, ছুটির দরখাস্ত বা দপ্তরের কোনও কাজ… এস্টাবলিশমেন্ট সেকশনে নিয়ে যাওয়ার পরে অসহযোগীতার সম্মুখীন হওয়াটা তার কাছে যেন এক নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিডিও অফিসের বিশাল হলঘরটি জুড়ে যে কেরানিকুল গমগম করে, তাদের মধ্যে কারো কারো দাবীও তার কানে আসে,

“আমাদের রোজ এক ঘন্টা করে সময় দিন না ম্যাডাম। পাশে বসে একটু চা খান… গপ্পো গুজব করুন… দেখবেন আপনার কাজ কেমন আপনে আপ হয়ে যাচ্ছে। এই তো শেফালিদি বসে আছেন। জিজ্ঞেস করুন না ওনাকে… ওনার কোনও কাজ আটকে থাকে কিনা।” 

ক্ষয়াটে চেহারার শেফালি দাস মুখময় মেচেতা আর ঠোঁটে উগ্র রাণী লাল লিপস্টিক নিয়ে সুকন্যার দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি হানে। -

“হ্যাঁ, শেফালিদির বসে থাকা না থাকায় তোমাদের যেন আজকাল আর কত যায় আসে! কচি থেকে বুড়ো সকলের নজরই তো দেখি এখন একজনের দিকেই ঠাঁটানো।”  

ইনিও সুকন্যার মতই কম্প্যাশনেট গ্রাউন্ডে চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু দুজনের মধ্যে ফারাক বিস্তর। একজনের কাছে যে মনোযোগ অবাঞ্ছিত, অপরজনের তা-ই মনোবাঞ্ছা। এদের মধ্যে অবশ্য সকলেই যে সমান তা কিন্তু নয়। কত ভালোমানুষের সাক্ষাৎও তো সে এই অফিসে এসেই পেয়েছে। কিন্তু তারা হাতে গোনা, নগন্য… ফলে কোনঠাসা। আসল কথা প্রাঞ্জল চলে যাবার পর যে সহায় সম্বলহীন দশায় সুকন্যা পড়েছিল, চাকরিটা তার কাছে সেই দুর্দশা থেকে উত্তরণের একটা পথ। একটা লাইফ-লাইন। সে-ও তো সুকন্যাকে অর্জন করতে হয়েছে কত কাঠ-খড় পুড়িয়ে, কত লোকের দরবারে কত ছোটা-ছুটির পর। ফলে ভালো লাগছে না বলে হুট করে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে এমন চিন্তা এই মুহূর্তে তার কাছে নিছক বিলাসিতা।

স্টেশনগামী অটোটার ধারের সিটে বসে, সবুজ পথবৃক্ষদের ক্রমাগত বিপরীত দিকে ছুটে চলা দেখতে দেখতে সুকন্যা আনমনা হয়ে পড়ে। তার মনও তখন ওইসব বৃক্ষরাজির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সময়ের উল্টোদিকে ছুট লাগায়। সুকন্যা পৌঁছে যায় অনেকদিন আগে ফেলে আসা তার সেই সংসারটির উঠোনে, যেখানে তাকে দিনশেষে হুড়োহুড়ি করে কোথাও থেকে ফিরতে হত না, সে থাকতো অন্য কারো ফেরার অপেক্ষায়…  

                                                                                         (২)
সে ছিল তাদের তিনটি প্রাণীর সংসার। প্রথমে মনুষ্য প্রজাতির দুই সদস্যকে নিয়ে শুরু হয়েছিল। স্বামী-স্ত্রী। প্রাঞ্জল আর সুকন্যা। স্বামীটি একদিন সকালবেলা বাজার সেরে ফেরার পথে পার্শ্ববর্তী এক নালা থেকে তৃতীয় যে সদস্যটিকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে এল, সেটি ছিল সদ্য চোখফোটা এক মার্জার শাবক। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে এলাকারই কোনও একটি বাড়ি থেকে ডাস্টবিন ব্যাগে ভরে এনে নালার মধ্যে তাকে ঝেড়ে ফেলে যাওয়া হয়েছিল। নালার নোংরা জলে ভিজে শিশুটি থরথর করে কাঁপছিল। আর কিছুক্ষণ ওইভাবে পড়ে থাকলে নির্ঘাত তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। ভালো করে গা মুছিয়ে, নরম কাপড়ে মুড়ে এলাকার সরকারি ভেটেরনারি ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ এবং গরম দুধ খাইয়ে তাকে তো চাঙ্গা করে তোলা হল। দুদিন পরেই দেখা গেল, গেরস্তের বাড়ির চাতালে সকালের রোদ আর চড়াইপাখিদের সঙ্গে সে রীতিমতো ধরাধরি খেলতে লেগেছে। এই সময় ছোট্ট একটা বাটিতে অল্প দুধ নিয়ে চুকচুক করে সুকন্যা তাকে ডাক দিতেই, পাখি-টাখি ফেলে সবুজ পুঁতির মত দুই চোখ পিটপিটিয়ে ‘ম্যাঃ’ বলে সে দৌড়ে এল। শব্দ তো ব্রহ্ম! করুণ, কোমল ওই ‘ম্যাঃ’ ডাক সুকন্যার মধ্যে যদি মাতৃভাব জাগিয়ে তুলেও থাকে, সে আর এমন কী কথা।

এরপর উষম উষম গরমজলে শ্যাম্পু ফেলে সুকন্যা যখন তাকে স্নান করিয়ে তুললো এবং তার কমলাটে হলুদ গায়ের উপর সাদা সাদা ডোরাকাটা ডিজাইন আর দুই চোখের কোনে কাজলরেখার মত টান প্রকট হয়ে উঠল, তখন কার সাধ্যি প্রাণীটির থেকে চোখ ফেরায়। স্বভাবগম্ভীর ঠিকে ঝি মালতির মাকে পর্যন্ত বলতে শোনা গেল, “এর বাড়ির জঞ্জাল তো ওর বাড়ির শোভা!” 

প্রাঞ্জল সরকারি কর্মচারী। এর পাশাপাশি সে একজন সাহিত্যকর্মী। লেখক হিসেবে মোটামুটি পরিচিতি আছে তার। প্রথম সারির প্রায় সমস্ত পত্র-পত্রিকাতেই তার লেখা বেরোয়। তবে তার মূল বিচরণক্ষেত্র লিটল ম্যাগাজিন। শনি রবি এলেই ঝোলাকাঁধে সে হাওয়া। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সাহিত্য আসরে তার ডাক পড়ে। তাছাড়া আছে শীত পড়লেই জেলায় জেলায় বইমেলা। অফিসের কাজের বাইরে প্রাঞ্জল মগ্ন থাকে নিজের লেখা এবং পড়ায়। তার পড়ার বিষয় অগুন্তি; বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার থেকে দেশ-বিদেশের দর্শনের গূঢ় তত্ত্ব। সে বিশ্বাস করে, একজন সাহিত্যিককে কেবল সাহিত্য জানলেই চলবে না। সাহিত্যিকের জ্ঞানের পরিধি হবে সীমাহীন। তা যদি সম্ভব না-ও হয় অন্তত তাঁকে কৌতূহলী থাকতে হবে।

প্রাঞ্জল যখন বাইরে বাইরে ঘোরে, বাড়িতে একা থাকে সুকন্যা। তাকে সঙ্গ দেয় তার মার্জার পুত্র। সুকন্যা তার নাম রেখেছে বাঘা। বাঘাকে সামলাতে সামলাতে আর তার কান্ডকারখানা দেখতে দেখতেই দিন কেটে যায় সুকন্যার। কৃষ্ণের মধ্যে বিশ্বরূপ দর্শন হয়েছিল মা যশোদার। বাঘা বেড়াল বলে কি তার চেয়ে কম কিছু? দুই কামরার ভাড়া বাড়িতে তাদের একটা ন্যাড়া ছাতও ছিল। সেটি ছিল তাদের ভূস্বর্গ। ছুটির দিনে প্রাঞ্জল সেখানে বসে লেখালেখি করত। সুকন্যা রোদে দিত ভেজা জামা-কাপড়, বিছানা-বালিশ, ঘরে তৈরি আচার, বড়ি… আর এই ছাতেই সুবিধা মত একটা ভ্যান্টেজ পয়েন্ট দখল করে চারিদিকে কড়া নজর রাখতে বসে যেত বাঘা। মানুষজন, পাখ-পাখালি, পাড়ার গরু, ছাগল, কুকুর, বেড়াল কিছুই বাদ যেত না তার নজরদারি থেকে। সম্ভবত সে অশরীরী আত্মাদেরও দেখা পেত। কারণ কোত্থাও কিছু নেই হঠাৎ বাঘার চোখ আটকে গেল শূন্যে। তার দৃষ্টিপথ অনুসরণ করে তাকাও… খুব মন দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকলেও মানুষের চর্মচক্ষে ঠাওর হবে না কিছুই। মশা, মাছি বা নিদেনপক্ষে খুব উঁচু থেকে ঝুল খেয়ে নেমে আসা একটা মাকড়সা… তা-ও না। নজরদারি করে করে ক্লান্তি এলে বা খাওয়া-দাওয়ার পরে চার হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে ছাতের মিঠে রোদে বাঘা একটু গড়িয়ে নেবে। কখনও বা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে, পৃথিবীর যাবতীয় সময় নিয়ে সে চেটে চেটে পরিষ্কার করতে থাকবে হাত-পায়ের থাবা, আঙুল, নখ, ল্যাজ, সারা দেহ…। এই সময় হয়তো প্রাঞ্জল বই খুলে সুকন্যাকে পড়ে শোনাবে জীবনানন্দ দাশের ‘বিড়াল’ নামক কবিতাটি… 

“সারাদিন একটা বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কেবলই আমার দেখা হয়
গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামী পাতার ভিড়ে;
কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর
তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মত নিমগ্ন হ’য়ে আছে দেখি…” 

বাঘার বয়স এক বছর পূর্ণ হতেই দেখা গেল সে ভারি শিকারী। বিশেষ করে যেসব মরশুমে প্রাঞ্জল বেপাত্তা, বাঘা তখন প্রায়শই শিকার ধরে এনে ধপ করে বাড়ির উঠোনে ফেলে। -গেছো ইঁদুর, পাখি, বাগানি পাড়া থেকে মেরে আনা নিজ আয়তনের দ্বিগুন বড় মুর্গি…  প্রতিদানে যদিও সর্বদা তিরস্কারই জোটে বাঘার কপালে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। 

কী ভেবে বাঘা এসব করে? সে দায়িত্ব নিয়ে শিকার ধরে না আনলে অনাহারে মারা যাবে তার এই মানবী-মাতা? দুবেলা বাঘাকে দুধে-মাছে রাখার পরেও এমন ভাবনা কেন যে আসে তার। সে কি জানে না মানুষের বাড়িতে ফ্রিজ বলে একটা যন্তর-মন্তর ব্যাপার থাকে, যার মধ্যে তারা সপ্তাহের রসদ মজুত রাখতে পারে? মোট কথা প্রাঞ্জল বাইরে গেলেই একেবারে তটস্থ হয়ে থাকে সুকন্যা। এই বুঝি বাঘা আবার কোনও প্রাণীর মৃতদেহ নিয়ে এসে উঠোনে ফেলে তার কাজ বাড়ালো। বাড়িতে রাধাগোবিন্দ রয়েছেন। ফলে সঙ্গে সঙ্গে ওই শবদেহ তুলে বাইরে ফেলতে হয় তাকে। তারপর বালতি বালতি জল ঢেলে উঠোন ধোও রে, নিজে স্নান করো রে…. ঝক্কির কি আর অন্ত আছে? আরও একটি অত্যন্ত খারাপ স্বভাব ছিল বাঘার। চলন্ত মানুষের পায়ের ফাঁকে গুলোগুলি করে ঢুকে গিয়ে আকাচাকা তাদেরকে ফেলে দেওয়া। হতে পারে এটি বাঘার নেহাতই শিশুসুলভ কোনও খেলা অথবা পাক্কা শয়তানি স্ট্র্যাটেজি। ওকে দেখে কেউ হয়তো কখনও ঢিল ছুঁড়েছে, পাড়ার কোনও ঝগড়াটে মহিলা সুকন্যাকে হয়তো কখনও কাঁদিয়ে গেছে… বাঘা তাদেরকে ঠিক চিনে রেখে দিত এবং তক্কে তক্কে থাকত। তারপর সুযোগ বুঝে একদিন, তারা যখন অন্যমনস্ক, তাড়াহুড়ো করে হয়তো নিজের কাজে চলেছে… বাঘা দৌড়ে এসে আচমকা তাদের দুই পায়ের ফাঁকে এমনভাবে ঢুকে পড়ত, যে শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ধরাশায়ী হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনও উপায় থাকত না। এভাবে বাঘা অনেককেই ফেলেছে।

তবে এই পদ্ধতিতে চোর ধরিয়ে বাঘা পাড়ায় একবার হই-চই ফেলে দিয়েছিল। প্রাঞ্জল যথারীতি বাড়ি নেই। শুক্রবার অফিস করে সে রওনা দিয়েছে, ফিরতে ফিরতে সেই সোমবার ভোর। বরাবরই ভীষণ ডাকাবুকো স্বভাবের মেয়ে সুকন্যা। এরকম সময়ে বহুবার তার মা একা মেয়েকে সঙ্গ দিতে আসতে চেয়েছে। কিন্তু প্রতিবারেই সে প্রবল আপত্তি জানিয়ে একাই থেকেছে বাড়ি আগলে। কেবল রাতে শোবার সময় মাথার কাছে আঁশবঁটিটা নিয়ে শুয়েছে। 
এমন এক রাতে বাড়িতে চোর ঢুকল। সুকন্যা বামুনের মেয়ে এবং ভক্তিমতী। নোনাধরা দেওয়ালের ভাড়া বাড়িতেও তার ঠাকুরঘর জমজম করে। মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পুরনো আমলের কাঁসা পিতলের বেশ কিছু বাসনপত্র ছিল তার ঠাকুর ঘরে। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা বাড়ি। সদর দরজার চৌকাঠ ডিঙোলে উঠোন। উঠোন পেরিয়ে চার-পাঁচটা সিঁড়ি টপকে সরু দালান। দালান লাগোয়া দুটো ঘর ওদের ব্যবহার্য। তাদের মধ্যে একটা শোবার ঘর। অন্য ঘরটা অপেক্ষাকৃত বড় যার একদিকে রয়েছে ঠাকুরের আসন আর অন্যদিকে অতিথি অভ্যাগত এলে বসবার ব্যবস্থা। দালানের এক কোনা ঘিরে রান্নাঘর। 

প্রাঞ্জল বাড়ি না থাকায় রাতের রান্নার ঝক্কি কম। তাই কাজকর্ম সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল সুকন্যা। কিসের শব্দে গভীর ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যাওয়ায় উঠোনের দিকের জানালাটা একটু ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিল সে। 
কুয়াশার চাদরে মোড়া নিটোল একটা শীত-রাত উঠোনময়। উঠোনের আলোর সুইচ তার হাতের নাগালে। আলো জ্বালতেই চোখে পড়ল ঢ্যাঙা, সিড়িঙ্গে, ঝোলাকাঁধে লোকটাকে। ঘন কুয়াশার পর্দা ফুঁড়ে হনহন করে সে হাঁটছে। তার হাঁটার তালে তালে ঠং ঠং শব্দ উঠছে কাঁধের ঝোলাটি থেকে। হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় সে টেনে লাগালো এক ছুট সদর দরজার দিকে। আর ঠিক তখনই কমলা উলের গোলার মত কিছু একটা পাঁচিলের উপর থেকে লাফ মেরে নেমে যেন গড়িয়ে ঢুকে পড়ল পলায়নরত লোকটির দুই পায়ের ফাঁকে। ভারসাম্য হারিয়ে মোক্ষম একটা আছাড় খেল সে। রাতের স্তব্ধতা খানখান করে দিয়ে ঝোলা খুলে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল ভারী ভারী কাঁসা পিতলের বাসনপত্র। 

শব্দ শুনে পাড়ার লোকজন যখন দৌড়ে এল, তখনও লোকটা উঠোনে পড়ে। ঝুঁঝিয়ে রক্ত ঝরছে থুতনি ফেটে। কোমরেও সম্ভবত চোট খেয়েছে। কমলা গোলা ততক্ষণে কিন্তু বাঘা হয়ে বসে একমনে থাবা চাটছে যেন কিচ্ছুটি হয়নি। সুকন্যা কাছে গিয়ে কোলে তুলে নিতেই বাঘা মৃদু স্বরে শুধু একবার বলেছিল, ‘ম্যাঃ’! 
আর এই ঘটনার পর থেকেই পাড়ায় বাঘার নাম হয়ে গিয়েছিল বাঘ বাহাদুর।

ট্রেনের শব্দে সুকন্যার ভাবনায় ছেদ পড়ল। স্টেশন এসে গেছে। অটো থেকে নেমে ট্রেন ধরতে হবে এবার। সে এক যুদ্ধ।

                                                                                           (৩)

ভিড় ঠেলে ট্রেনে উঠে বসতে না বসতেই বিডিও সাহেবের মেসেজ।

“তখন তো কথা বলা গেল না। বাড়ি পৌঁছে ফোন করতে পারেন।”

আসল কথা অফিস স্টাফেদের একটা গ্রুপ ইদানিং বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য সজল নামের এক গ্রুপ ডি স্টাফ। সজল এলাকার ছেলে। তার মদ এবং মহিলাপ্রীতি সর্বজনবিদিত। কিন্তু সে অফিসের বড়বাবুর ভারি পেয়ারের লোক। তাঁরই প্রশ্রয়ে ধরাকে সে সরাজ্ঞান করে। 

দপ্তরের কাজে মাঝে মধ্যে সুকন্যাকে জেলা অফিসে যেতে হয়।  ও সি ইলেকশন অর্থাৎ সুকন্যার দপ্তরের যিনি হেড, তাঁর নাম দেবদূত চন্দ। অত্যন্ত করিৎকর্মা ছেলে। সেই সঙ্গে ভারি নম্র এবং ভদ্র। সুকন্যার সমবয়সীই প্রায় কিন্তু দিদি দিদি করে কথা বলে। কোনও কাজে কাউকে জেলায় পাঠানোর প্রয়োজন হলে ছেলেটি সুকন্যাকে পাঠানোর চেষ্টা করে। এর দুটো কারণ। এক, সুকন্যার দায়িত্বজ্ঞানের তুলনা নেই। দুই, ও সি ইলেকশন সাহেবের সহমর্মিতা। জেলা অফিসটা স্টেশনের খুব কাছে। ফলে এইসব দিনে সুকন্যা একটু হলেও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারে। ছেলেটি তাকে বলেই দেয়, 

“আজ আর ব্লকে ফেরবার দরকার নেই দিদি। কাজ হয়ে গেলে ট্রেন ধরে সোজা বাড়ি চলে যেও।”

এই রকম সময়ে বিডিও অফিসের যে অটোটিতে করে সুকন্যা জেলায় যাবে, লাফ মেরে তাতে হয়তো উঠে বসল গ্রুপ-ডি সজল। তারও নাকি জেলা ট্রেজারি অফিসে কাজ আছে। এরপর গোটা রাস্তাটা সে চেষ্টা করে যাবে সুকন্যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসার। এমনও হয়েছে যে অতিষ্ট হয়ে পিছনের সিট ছেড়ে সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে গিয়ে বসেছে সুকন্যা। কিন্তু তারপরেও লোকটির মধ্যে কোনও হেলদোল লক্ষ করা যায়নি। 


বার কয়েক এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবার পর এই নিয়ে অফিসের বড়বাবুকে একবার অভিযোগ জানাতে গিয়েছিল সুকন্যা। নিচু হয়ে ডাস্টবিনটা কোলের উপর তুলে নিয়ে তার ভিতরে ‘থুক’ করে মুখ থেকে একদলা পানের পিক ফেলে তিনি বলেছিলেন,

“গাড়িটা তো ব্লক অফিসের ম্যাডাম। আপনার একার ব্যবহারের জন্য থোড়াই। আপনারই আরেক কলিগ… অফিসেরই কাজে ওই গাড়িতে উঠেছে। তা চলাফেরার পথে এট্টু-আদটু গায়ে গা তো লাগতেই পারে! এতো সেনসিটিভ হলে বাইরে বেরিয়ে চাকরি করবেন কী করে ম্যাডাম!” 

পাশ থেকে ইউ ডি মন্মথবাবু দু’কলি যোগ করেন।

“শুনলাম জেলার কাজ ম্যাডামের আড়াইটে-তিনটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। তারপর উনি অফিসে না ফিরে ট্রেন ধরে সোজা বাড়ি চলে যান। অফিস কটা পর্যন্ত বড়বাবু? পাঁচটা না তিনটে? বিডিওকে বলি এবার থেকে আমাদেরও তাহলে তিনটেয় ছেড়ে দিতে হবে!”

বড়বাবু একটা কাঠি দিয়ে নোংরা দাঁতের সারি খোঁচাতে খোঁচাতে সুকন্যার দিকে তাকিয়ে হাসেন।

“তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে কী করেন ম্যাডাম? হাজব্যান্ড তো নেই… বাচ্চা কাচ্চা কিছু… ও হো! তা-ও তো নেই! একদিক থেকে অবশ্য ভালোই! কোনও পিছুটানও নেই! বয়সও অল্প… এই তো খাটার সময় ম্যাডাম! মন দিয়ে কাজ করুন! আর আমাদের মধ্যে… এই মানে…  কাজের মধ্যে থাকুন!” 

মন্মথবাবু এবার গলাটা একটু নরম করে বলেন,

“এখানে কেউ আপনার শত্রু নয় ম্যাডাম। সবাই আমরা আপনার শুভানুধ্যায়ী। এই যে… যে সজলের নামে আপনি কমপ্লেন করতে এসেছেন… সেও কিন্তু আপনার কথা ভাবে। এই তো সেদিন কত দুঃখ করছিল… আহা রে এই অল্পবয়সে স্বামীহারা! ওনার তো তাহলে খুব কষ্ট…”

“সেরম কষ্ট হলে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন ম্যাডাম। লজ্জা করবেন না। আমরা অলওয়েজ অ্যাট ইয়োর সার্ভিস।”

লাল লাল দাঁত বার করে বড়বাবু হাসতে থাকেন…

সুকন্যা বিবমিষা সামলে ইলেকশন ঘরে তার চেয়ারে এসে বসে। সুমতিদি শুনে মহা চিল্লামিল্লি জুড়ে দেন। -জেলার কাজে গিয়ে কোন লোকটা আবার ব্লক অফিসে ফেরে? মন্মথ ফেরে? বড়বাবু নিজে ফেরেন? আর অফিস থেকে বেরোতে যখন সাতটা-আটটা বাজে তোর? এই তো কদিন আগে গোটা একটা সপ্তাহ প্রতিদিন রাত দশটায় বেরোলি। শনি রবিবারও বাদ গেল না। যতই গাড়ি দিক, ওনারা খোঁজ নিয়েছেন একজন মহিলা এই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কীভাবে বাড়ি পৌঁছাচ্ছে অত রাতে? আড়াইটে-তিনটে দেখাচ্ছে! লুচ্চা-লম্পটের দল যতসব…  ক্যাজুয়াল স্টাফ ব্যোমকেশ বলে, -কথাটা দেবদূতবাবুর কানে একবার উঠলে হয়। এক্ষুনি ওই ঘরে গিয়ে দক্ষ যক্ষ বাঁধিয়ে দেবে।

-কিন্তু সেটা তো ভালো কথা নয় ব্যোমকেশ। ইলেকশন সামনে। এখন সকলকে নিয়েই কাজ তুলতে হবে। কাউকে চটালে চলবে না। তোমরা দেবদূতবাবুর কানে এসব কথা তুলো না। আমি একদমই চাই না আমার জন্য ওনাকে কোনওরকম ঝঞ্ঝাট পোহাতে হোক। 

কিন্তু ব্লক অফিসে কথা কানে হাঁটে। সুকন্যার নিষেধ সত্ত্বেও ঘটনাটি ও সি ইলেকশনের গোচরে আসে। বিডিও সাহেবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশ ভালো। কাজের বাইরেও এই ওই টপিক নিয়ে মাঝে মধ্যেই তাঁরা আড্ডা জমান। তিনি একদিন নিরিবিলিতে বিডিও সাহেবের চেম্বারে বসে তাঁর সঙ্গে সুকন্যার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন এবং সব শুনে বিডিও সাহেব বলেন সুকন্যা ম্যাডামকে একদিন তাঁর কাছে পাঠাতে। তিনি পুরোটা আগে সুকন্যা ম্যাডামের নিজের মুখ থেকে শুনবেন। ব্যাপারটা খুবই সেনসিটিভ এবং যেহেতু ইলেকশন সামনে তাই খুবই ট্যাক্টফুলি হ্যান্ডেল করার বিষয়। এমন কোনও উপায় বার করতে হবে যাতে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। তবে সবার আগে ম্যাডামের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে একটু খোলা-খুলি ওয়ান টু ওয়ান কথা বলতে হবে।

সেই মত সুকন্যা বিডিও সাহেবের চেম্বারে যায় কথা বলতে। কিন্তু কথা শুরু করার অনতিবিলম্বেই কিছু বিল সই করাতে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে গ্রুপ ডি সজল এবং এস্টাবলিশমেন্টের আরো কতিপয় লোক। ফলে কথোপকথন আর এগোয় না এবং এই প্রেক্ষিতেই ট্রেনে ওঠার পরে সুকন্যা বিডিও সাহেবের তরফ থেকে ঐ ফোন-কলটি পায়।

সুকন্যা বাড়ি ঢুকলো সাড়ে আটটা নাগাদ। ক্লান্ত হয়ে ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে সবে একটু বসেছে… বিডিও সাহেবের ফোন। -কথা বলতে পারবেন?

-এইমাত্র বাড়ি ঢুকলাম স্যার। 

-আচ্ছা আপনি একটু জিরিয়ে নিয়ে ফোন করুন। কারণ অফিসে দেখলেন তো। কথা বলা যাবে না। নিজের সময় নিয়ে ফোনটা করুন। নটা, দশটা, এগারোটা… আমি আছি।
সুকন্যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নেয়। গ্যাস এ বসিয়ে দেয় ভাত, ডাল। তারপর আঁচ কমিয়ে নটা নাগাদ সে বিডিও সাহেবকে ফোন করে। বিশদে সবটা শোনার পর তিনি খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকেন। তারপর একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলেনঃ

-আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি আপনার জায়গাটা। কিন্তু যেটা বুঝতে পারছি না তা হল, হাউ ক্যান আই সল্ভ দিস ম্যাটার। একটা ব্লক চালাতে গেলে অনেক ভেবে চিন্তে, অনেক রকম মানুষকে নিয়ে চলতে হয়। আমি জানি এখানে এদের এরকম একটা নোংরা প্র্যাকটিস আছে, যেটা আপনাদের মত ভদ্রঘরের মহিলাদের জন্য মারাত্মক টক্সিক। কিন্তু… যেটা আমি জানি না তা হল হাউ টু হ্যান্ডল দিস!

-ইলেকশন চুকে গেলে অন্য ব্লকে ট্রান্সফারের জন্য যদি প্রেয়ার দিই স্যার? আপনি হেল্প করবেন?

-সে আমার হাতে যতটুকু ক্ষমতা থাকবে তাই দিয়ে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব ম্যাডাম। কিন্তু অন্য ব্লকেও যে এই ঝামেলা আপনাকে পোহাতে হবে না সে কথা আপনাকে কে বলল? এখানে তবু দেবদূত আছে… আপনার ভাইয়ের মত। আপনার প্রতি খুবই কেয়ারিং। আমি আছি… অন্য ব্লকে যদি এটুকুও না পান?
কথাটায় যুক্তি আছে বটে। সুকন্যা চুপচাপ ভাবে।

-আজ রাতের মেনু কি ম্যাডাম?

-স্পেশাল কিছু নয়। এই তো ডাল-ভাত বসিয়েছি।

-হা হা আমি চিকেন কষাতে কষাতে কথা বলছি। বৌ বাপের বাড়ি গেছে কিনা।
বিডিও সাহেবের ব্যক্তিগত জীবনের অত গভীরে ঢুকতে সুকন্যা উৎসাহ পায় না। 
সুকন্যাকে চুপচাপ দেখে বিডিও সাহেব পুরোনো প্রসঙ্গে ফিরে আসেন। 

-এর আগের ব্লকে আপনারই মত একজনকে দেখেছিলাম। সুন্দরী, অল্পবয়সী… অনেক অসম্মান নিয়ে তাকে সেই ব্লক ছাড়তে হয়েছিল। মুশকিলটা হয়েছিল কি জানেন? সে আমাকে আগে কখনও কিছু জানায়নি সঙ্কোচে। আমি যখন জানতে পেরেছি… তখন অলরেডি কেস হাতের বাইরে চলে গেছে। তাই আপনাকে বলছি… জানি সমস্যার আশু কোনও সমাধান দিতে পারব না… তবু যা যা ঘটবে আমাকে জানাতে থাকবেন। যাতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবার আগেই কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে পারি। 

-নিশ্চয় স্যার।

-আচ্ছা, বাই দ্য ওয়ে! আর কোনও পরীক্ষা-টরীক্ষা দিচ্ছেন না আপনি? দিলে বলবেন… প্রিপারেশনের জন্য ছুটি-ছাটা বা অন্য যে-এ-এ-এ কোনও রকম হেল্প দরকার হলে বলবেন। ব্যবস্থা করে দেব।
বিয়ের পর প্রাঞ্জলের সঙ্গে ঘর করা ছাড়া আর তো কোনও লক্ষ্যই ছিল না সুকন্যার। কিন্তু ইদানিং সে ভাবছিল বটে ডিসট্যান্সে এম এ টা কমপ্লিট করে নিলে হয়। তাছাড়া এই চাকরি করতে করতেই অন্যান্য চাকরির পরীক্ষাতেও বসবে সে। বেটার কোনও অপশন পেলেই ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। এই কদিনে সে খুব ভালো ভাবেই বুঝে গেছে বর্তমান চাকরিটি সাময়িক ভাবে তার জীবন নির্বাহের উপায় হতে পারে মাত্র, উদ্দেশ্য কখনোই নয়। কিন্তু চাকরিটি জয়েন করার পর থেকে বইপত্র নিয়ে বসার এক তো সে সময় পাচ্ছে না। আর দুই, সময় পেলেও তার মাথা এত ঘেঁটে থাকছে যে সে মনোযোগই দিতে পারছে না। এমতাবস্থায় বিডিও সাহেবের আশ্বাসে তার মনে আশা জাগে।

-যে কোনও রকম অসুবিধা বা সুবিধায় ফোন করবেন, কেমন?

-অনেক ধন্যবাদ স্যার।

                                                                                     (৪)
ফোনটা রাখার পর বিডিও সাহেবের আন্তরিকতায় সুকন্যা মানসিক ভাবে একটু হলেও স্বস্তি বোধ করে। 
কিন্তু তার এই মানসিক স্থিতি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। কারণ বিডিও সাহেব স্বয়ং এবার তাকে যখন তখন ফোন করা শুরু করেন। 

তিনি ফোনটা করেন মূলত রাতের দিকে… সুকন্যার হাল-হাকিকৎ জিজ্ঞেস করা দিয়ে শুরু হয়… তারপর কেরিয়ার এবং পরীক্ষা প্রিপারেশনের জায়গাটা একটু ছুঁয়েই তিনি চলে যান তাঁর নিজের জীবনে একাকীত্বের ব্যাখ্যানায়। স্ত্রী এবং পরিবার থাকা সত্ত্বেও তিনি যে কত একা… তাঁকে বোঝার মত খাঁটি বন্ধুর যে কত অভাব… এসব কথাই তিনি মূলত বলতে থাকেন এবং কথা শুরু হলে তা আর থামতে চায় না। 

এদিকে যে উপলক্ষে বিডিও সাহেবে সঙ্গে কথা-বার্তা তার কিন্তু কোনও সুরাহা হয় না। সজল অ্যান্ড কোং-এর উৎপাত থামা তো দূরের কথা দিন দিন যেন বাড়তে থাকে। ফেরার পথে সুকন্যার পিছু নিয়ে সজল একদিন তার পাড়া পর্যন্ত গিয়ে হাজির হয়। সেই সঙ্গে আরেকটি নতুন উপসর্গ এসে জোটে। ব্লককর্মী শেফালি দাসের তরফ থেকে একটা অভূতপূর্ব আক্রমনের শিকার হতে থাকে সে। সুযোগ পেলেই সুকন্যার প্রতি বাঁকা মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া, নানাজনের কাছে তার সম্পর্কে  নানারকম ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো… এ যেন শেফালি দাসের নিত্যকর্ম হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে একদিন গোটাটাই সুকন্যার সহ্যের বাইরে চলে যায় যখন দেবদূত আর সুকন্যার সম্পর্ক নিয়ে শেফালি দাস কুৎসা রটানো শুরু করে।

ঘটনাটি সুকন্যাকে এতটাই রাগান্বিত করে তোলে যে সে আর কোনও দিকে না তাকিয়ে দড়াম করে বিডিওর চেম্বারের দরজা ঠেলে সোজা ভিতরে ঢুকে পড়ে অভিযোগ জানাতে।

বিডিও সাহেব পরম নির্বিকার। -তা লোকের আর দোষ কি ম্যাডাম! দুনিয়ার কোনও লোককে আপনি পাত্তা দেবেন না… এমনকি স্বয়ং ব্লক ডেভলপমেন্ট আধিকারিককেও না। আপনার যত হাসাহাসি আলাপ-আলোচনা সব দেবদূতবাবুর সঙ্গে! মানুষের হিংসা তো হবেই!

সুকন্যা স্তম্ভিত হয়ে যায়। কাজের বাইরে সে কথাবার্তা কারো সঙ্গেই বিশেষ বলে না। ঐ ইলেকশন ঘরের বাইরে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে সে বেরোয়ও না। কিন্তু মানুষ সারাদিন যাদের সঙ্গে, যাদের পাশে বসে কাটায়… খুব স্বাভাবিক ভাবেই কিছু কথা-বার্তা, কিছু লঘু-চপল মুহূর্তের আদান-প্রদান তারা নিজেদের মধ্যে করেই থাকে। সুকন্যাও তাই করেছে। এর থেকে কিছু বেশি নয়, কমও নয়।

সুকন্যা বুঝে যায়, উল্টোদিকের ব্যক্তিটি তাকে আদতে কোনও সহায়তা করে উঠতে পারবেন না। ওই মুহূর্তেই সে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে। অফিস আওয়ারের বাইরে এমার্জেন্সি কোনও কাজ না থাকলে বিডিও সাহেবের ফোন সে আর রিসিভ করবে না।

তবে শেফালি দাসের ব্যাপারটা তাকে বুঝতে সাহায্য করে ব্লকের ছোকরা অটোওয়ালা সরিফুল। সুকন্যার জেলায় যাবার গাড়িতে সজলের চড়ে বসা, তাকে ফলো করে পাড়া অবধি পৌঁছে যাওয়া এসব নিয়ে দেবদূত সত্যি সত্যিই একদিন সজলকে ধরে খুব কড়কে দেওয়ায় সজল একটু দমে ছিল। ফলে সুকন্যা সরিফুলের অটোতে করে জেলার কাজে একাই যাচ্ছিল। অটোর আয়নায় সুকন্যার ক্লান্ত উদাস মুখটা চোখে পড়ায় সরিফুলের হয়তো মায়া হয়। সুকন্যা এবং দেবদূতকে নিয়ে ব্লকে ইদানিং যে কানাঘুষো চলছিল তা সরিফুলেরও কানে এসেছে। সে হঠাৎ বলে ওঠে, মন খারাপ করেন না ম্যাডাম। আমরা সবাই জানি শেফালিদি মিথ্যে মিথ্যে এইসব রটিয়ে বেড়াচ্ছে। কেন রটাচ্ছে তা-ও জানি।

তখন সরিফুলের কাছ থেকে সুকন্যা জানতে পারে যে শেফালি ব্লকে জয়েন করার পর সজল একেবারে ছিনে জোঁকের মত তার পিছনে পড়ে থাকত। ঠিক যেমন আজকাল সে সুকন্যার পিছনে পড়ে থাকে। পার্থক্য হল শেফালি পটে গেছিল। সুকন্যা পাত্তা দেয় না। শেফালি আর সজলকে অফিসের অনেকেই একসাথে বিভিন্ন আনঅফিশিয়াল জায়গায় দেখেছে। এই যেমন, সিনেমা হল, প্রিন্সেপ ঘাট, দীঘার হোটেল ইত্যাদি। শেফালির বাড়িতেও কিবা দিন কিবা রাত সজলের অবাধ গতিবিধি। মোট কথা এতদিন শেফালিই ছিল সজলের ‘সুইট-হার্ট’। তা সেই শেফালিকে ছেড়ে সজল আজকাল সুকন্যার দিকে ঝুঁকে পড়ায় শেফালি অমন অজগর সাপের মত ফুঁসতে লেগেছে।
শেফালির উপর এবার রাগের বদলে করুণা হতে থাকে সুকন্যার। শেফালির ছেলে কোথাকার কোন এক বোর্ডিং স্কুলে পড়ে। বাড়িতে তার অথর্ব বৃদ্ধা শাশুড়ি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাতদিন তিনি ছেলের অকালমৃত্যুর জন্য শেফালিকে গাল-মন্দ করেন। তবু শেফালি যতটা পারে চুপ-চাপ শাশুড়ির সেবা করে যায়। কিন্তু মানুষের জীবন তো। সংসারে সেবা, দায়িত্ব এসবের বাইরেও তো বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কিছু উপাদান লাগে। সে প্রেম হোক বা সম্ভোগ। হয়তো সজলের মাধ্যমে সেই উপাদানের হদিশ শেফালি দাস পেয়েছিল। কিন্তু তাকে সে যতটা দীর্ঘমেয়াদি মনে করেছিল… বাস্তবে ততটা দীর্ঘমেয়াদি তা ছিল না। এখন এই কঠিন সত্যটাকে মেনে নেওয়ার চেয়ে… হয়তো বিদ্বেষটাই শেফালির কাছে সহজ… 

শেফালির দাসের আচরণ যদিও বা বোধগম্য হয়। বিডিও সাহেবের মত মানুষজনদের হাব-ভাব সুকন্যা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। 

পড়ন্ত বিকেলের মায়াবী আলোয় বিডিও-পত্নী ব্লক অফিসে তাঁদের কোয়ার্টারের দিকে কেয়ারি করা ফুল-বাগানে ঘুরে বেড়ান। রাঙা আলো ঠিকরে পড়ে তাঁর ধপধপে ফর্সা মুখে। পরিপাটি করে বাঁধা চুলের মাঝখানে সিঁদুরটা আরো রাঙা দেখায়। অদূরেই আয়ার সঙ্গে খেলা করে তাঁদের বছর চারেকের ফুটফুটে মেয়েটি। জেলার মিটিং সেরে গেট দিয়ে বিডিও সাহেবের গাড়িটি ঢোকামাত্র সেদিকে দৌড়ে যায় তাঁর শিশুকন্যা। বিডিও পত্নীর মুখটা খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। তবু বিডিও অসময়ের ফোনকলে রাত-দিন সুকন্যাকে শোনান…তিনি একা, তাঁকে বোঝার মত কেউ নেই।
সুকন্যা কাজের বাইরে বিডিও সাহেবের অসময়ের ফোনকলগুলি ধরা বন্ধ করে। বা নিতান্ত বাধ্য হয়ে ধরতে হলেও এই সেই কাজ দেখিয়ে তাড়াতাড়ি রেখে দেয়। দেবদূত তাকে সরকারি চাকরির প্রিপারেশনের জন্য কিছু বই-পত্র জোগাড় করে দিয়েছে। বাড়ি ফিরে রাতে সে সেইসব নিয়ে বসে। দেবদূত নিজেও একটি বড় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার দেওয়া একটি পরামর্শ সুকন্যার ভারি মনে ধরেছে। যত কষ্টই হোক অন্তত আধঘন্টার জন্য প্রতিদিন বই নিয়ে বসতেই হবে। 

বাড়ি ফিরতে আজ তার বেশ দেরি হয়েছে। ঘরের কাজকর্ম সেরে উঠতে উঠতে এগারোটা বাজল। এর মধ্যে বার দুই বিডিও সাহেবের ফোন এল। সে রিসিভ করল না। দেবদূতবাবুর সঙ্গে একটা গোপন আঁতাত হয়েছে তার। অফিসের পরে কাজের ব্যাপারে কোনও দরকারি কথা থাকলে দেবদূত বাবু নিজে মেসেজ বা ফোন করে সেটি সুকন্যাকে জানিয়ে দেবেন। তারপর প্রয়োজন বুঝলে সুকন্যা ফোন ব্যাক করবে। দেবদূতের তরফ থেকে কোনও বার্তা না পেলে বুঝতে হবে যে বিডিও সাহেবের ফোনটা কাজের কথা বলার জন্য নয়। 

দেবদূত বাবুর তরফ থেকে কোনও বার্তা সে পায়নি। তাই যা বোঝার সুকন্যা বুঝে নিল। আরো বার দুই বিডিও সাহেবের নাম্বারটা মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে ওঠা সত্ত্বেও সে রিসিভ করল না। তেমন হলে পরদিন অফিসে গিয়ে ওনাকে বলবে যে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম স্যার। তাই ফোনটা আর ধরতে পারিনি। সে প্রাঞ্জলের লেখার টেবিলে নিজের বই-পত্র নিয়ে বসে।

সুকন্যা একেবারে নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় ক্যাঁচ করে দরজায় একটা শব্দ হতে সে চমকে তাকালো। দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে আছে। বোধহয় ঝড় উঠেছে। এত রাতে সাধারনত দরজায় সে খিল দিয়ে দেয়। নিশ্চয় আজ তাড়াহুড়োয় দরজাটা সে বন্ধ করতে ভুলে গেছে।

একসময় অমন ক্যাঁচ শব্দ করে মাথা দিয়ে ভেজানো দরজাটা ঠেলে ঘরে ঢোকার অভ্যাস ছিল বাঘার। মাঝে মাঝে সারাদিনের জন্য সে কোথায় বেপাত্তা হয়ে যেত। শত ডেকেও তার সাড়া পাওয়া যেত না। কতবার এমনও হয়েছে যে তিন-চারদিনের মত বাঘা বেপাত্তা। তারপর হয়তো একদিন দুপুরে… কি সন্ধ্যার দিকে সে অমনি ভাবে মাথা দিয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকত। নিজের কাজ থেকে চোখ না সরিয়েই সুকন্যা বলত, “কে রে? বাঘা?”
উত্তর আসত, “ম্যাঃ”!

প্রাঞ্জলের মৃত্যুর মাসখানেক পরে বাঘা এমনই একবার বেপাত্তা হয়ে গেল। একদিন গেল, দুদিন গেল… বাঘা আসে না। তিনদিনের দিন সন্ধেবেলা ক্যাঁচ করে দরজাটা হঠাৎ ঠিক এমনি ভাবেই একটু ফাঁক হয়ে গিয়েছিল। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে সুকন্যা তখন কাঁদছিল। মুখ না তুলেই কান্নাভেজা স্বরে অভ্যাসমত সে বলে উঠেছিল “বাঘা”? কোনও সাড়া না পেয়ে মাথা তুলে সে তাকিয়ে দেখে, কোথায় বাঘা? দরজাটা অল্প ফাঁক। তার মধ্যে দিয়ে হা হা করে ভিতরে ঢুকছে হিমেল বাতাস। সেই মুহূর্তে, হঠাৎ কিভাবে যেন সে বুঝে গিয়েছিল, বাঘা আর কখনও ফিরবে না।

পরদিন মালতির মাকে চেপে ধরতেই সত্যটা সে জানতে পেরেছিল।  বরাবরের মত বাগানি পাড়ার কারো বাড়ি থেকে একটা মুরগির ঘাড় মটকে মুখে করে নিয়ে বাঘা পালিয়ে আসছিল। বাগানি পাড়ার লোকেরা এর আগে বাঘার কারণে অনেকবার ‘লস’ সহ্য করেছে। এবার তারা তক্কে তক্কে ছিল। দলবেঁধে বাঘাকে তারা ঘিরে ফেলে এবং লাঠির এক আঘাতে তার মাথার খুলি দুফাঁক করে দেয়। যে নালার মধ্যে থেকে প্রাঞ্জল তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল… সেই নালার মধ্যেই বাঘার রক্তাক্ত দেহটা পড়ে থাকতে দেখা যায়। পাড়ার ছেলেরাই তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে লেবুতলার মাঠে কবর দিয়ে এসেছে। সঙ্গত কারণেই সুকন্যাকে ঘটনাটা আর জানানো হয়নি।

                                                                                        (৫)
সুকন্যার কর্মস্থলটা এমনই, যে তার মন খুব বেশি সময়ের জন্য অতীতে বিচরণ করতে পারে না। তাকে বর্তমানে ফিরে আসতেই হয়। আগের রাতে বিডিও সাহেবের ফোন না ধরাটা তাকে এক গভীর আবর্তের মধ্যে এনে ফেলে। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত অফিসে চরম হেনস্থার সম্মুখীন হতে থাকে সে। সামনে ইলেকশন। ফলে এই মর্মে ফর্মান জারি করা হয়, প্রতি শনি রবিবার (প্রয়োজন থাক বা না থাক) ইলেকশন ক্লার্ককে অফিস আসতে হবে। তাকে হাজির থাকতে হবে প্রতিটি ক্যাম্পেন এবং মিটিঙে। ও সি ইলেকশন আপত্তি জানাতে গেলেও বিশ্রী ইঙ্গিত দিয়ে তাঁকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। পান থেকে চুন খসলেই বিডিও চেম্বারে ডেকে সকলের সামনে সুকন্যাকে যা তা রকমের ঝাড় দেওয়া শুরু করেন। 

সেদিন রবিবার। কাজ তেমন কিছু ছিল না। তবু বিডিও সাহেবের হুকুম, জেলা থেকে ক্যাম্পেনের গাড়ি আসবে তাই তাকেও হাজির থাকতে হবে। বসে বসেই সারাটা দিন প্রায় কেটে গেল। পাঁচটা বেজে গেছে। এক এক করে সব কর্মচারীরা বেরুচ্ছে। বিডিও নিজের ঘরে চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে সি সি টিভিতে সকলের যাওয়া দেখছেন। তিনি সুকন্যাকেও বেরোতে দেখলেন। অটোতে উঠতে দেখলেন। বেরিয়ে যেতে দেখলেন। তারপর মিনিট দশেক অতিবাহিত করে তাকে ফোন লাগালেন। কোথায় আপনি? ততক্ষণে সে স্টেশনের দিকে অনেকটা রাস্তা এগিয়ে গেছে। কাল তো জেলায় মিটিং আছে। আপনি রিপোর্টগুলো নিয়ে ইমিডিয়েটলি আসুন তো একবার আমার চেম্বারে। 
-স্যার, আমি তো বেরিয়ে গেছি! 

-আচ্ছা, কার পারমিশন নিয়ে বেরিয়েছেন? মুখচোরা সুকন্যা তো অবাক! কার পারমিশন নেবে। কার পারমিশন নিতে হয়!  এমনিতেই রবিবার। বিশেষ কেউ আজ আসেনি। এমনি সময়েও সাড়ে চারটে বেজে গেলেই মোটামুটি ব্লক থেকে লোকজন বেরোতে শুরু করে। আর সে তো বেরিয়েছে পাঁচটা বেজে গেলে।  -আপনি এক্ষুনি ব্যাক করুন। ফাইল নিয়ে আমার চেম্বারে ঘুরে যান। 

-কেন, ও সি ইলেকশন সাহেব তো আছেন। আপনি ওনাকে বলুন না স্যার! সমস্ত রিপোর্ট আপনি ওনার কাছেই পেয়ে যাবেন।

 -হোয়াট! আপনি আমাকে শেখাবেন কখন কাকে ডাকতে হবে? ও সি ইলেকশন অন্য কাজে ব্যস্ত আছে। তাই আপনাকে আসতে বলা হয়েছে। ওকে ফাইন! আপনি বাড়ি চলে যান! আমি জেলায় জানিয়ে দিচ্ছি যে ব্লক অফিসে কাজ করার মত মাইন্ডসেট আপনার নেই।

অগত্যা ফিরে আসতে হয় সুকন্যাকে। সুকন্যা অবাক হয়ে লক্ষ করে, তার তথাকথিত রক্ষাকর্তা তার হেনস্থাকারীদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া তো দূর, বরং নিজেই সেই দলে শামিল হয়ে গেলেন। এই দলের প্রত্যেকেরই লক্ষ্য মূলত এক… সুকন্যাকে কোনঠাসা করে দেওয়া… তার গরিমা, আত্মসম্মান এবং আত্মবিশ্বাস ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া… তার আভাকে ম্লান করে তাকে বশ্যতাস্বীকারে বাধ্য করা। নইলে তাদের আর শান্তি নেই, স্বস্তি নেই।  এই ভাবে কেটে গেল ইলেকশন পর্ব। ও সি ইলেকশন সাহেব সুকন্যাকে বললেন অন্য ব্লকে ট্রান্সফারের জন্য চেষ্টা করতে। তিনিও তাই করছেন। কারণ তাঁরও মন ভেঙে গেছে। আর বললেন, সামনেই সিভিল সার্ভিসেস এক্সাম। জান লড়িয়ে দিন সুকন্যাদি।  সেই মত দাঁতে দাঁত চেপে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সে। চিঠি-চাপাটি করে প্রয়োজনীয় অনুমতিও আদায় করা হয়ে গেছে তার। দেবদূত তো আছেনই। ব্লকে নতুন আসা জয়েন্ট বিডিও ম্যাডামও খুব সাহায্য করছেন সুকন্যাকে। ইনি অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়ী এক মহিলা। বিডিও পর্যন্ত তাঁকে ঘাঁটাতে সাহস করেন না।  এভাবেই দিন কেটে যায়। দেখতে দেখতে সুকন্যার পরীক্ষা কাছাকাছি চলে আসে। হাতে আর মাত্র পাঁচটা দিন। তাই এ কদিন যে করেই হোক একটু আগে আগে বাড়ি ফিরে যাবার চেষ্টা করছে সে। ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটা। সে বেরোতে যাচ্ছে। দূর থেকে বিডিও কে দেখা গেল। অফিসের মধ্যেই তাঁর কোয়ার্টার। কোয়ার্টারের দিক থেকে সুকন্যাকে দেখতে পেয়েই তিনি আসছেন হন্ত-দন্ত হয়ে।

“আপনি রিপোর্টগুলো নিয়ে আসুন তো একবার আমার চেম…”

কথা শেষ হলো না… মোরাম বিছানো শুকনো ডাঙায় হঠাৎ জোর আছাড় খেলেন বিডিও সাহেব। ছিটকে পড়ল হাতে ধরা মোবাইল, ডায়েরি… রব উঠলো ধর! ধর! তোল তোল!  বামকাতি হয়ে পড়েছিলেন বিডিও সাহেব। অধঃপতিত মানুষটাকে তোলার পর দেখা গেল নুলোর মত ঝুলছে বাম হাত খানা। খুব সম্ভবত ভেঙেছে। জয়েন্ট ম্যাডাম এগিয়ে এলেন, -যান সুকন্যা। আর কী? আপনি বেরিয়ে যান। বিডিও সাহেবকে নিয়ে এখনই হসপিটাল ছুটতে হবে। 
ব্লকের আর্দালি বরকত গজগজ করতে লাগল।

“কোত্থাও কিচ্ছু নি কো… আবার শুকনো ডাঙায় আছাড় খাতি হলো!”

স্টেশনগামী অটোটার পিছনের সিটে বসে বরকত আলির কথাগুলোই কানে ভাসছিল সুকন্যার।

“কোত্থাও কিছু নি কো…”

কে বললো “কোত্থাও কিছু” নেই? 

“সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলেছে 
সে
একবার তাকে দেখা যায়,
একবার হারিয়ে যায় কোথায়…”

তবুও, এইবার দেখতে কোনও ভুল হয়নি তার। আকাশ থেকে অস্তগামী কমলারঙের গোলাটাই যেন গড়িয়ে নেমে এলো হঠাৎ। তারপর বাঘার রূপ নিলো। লাল কাঁকরের পথে বিডিও-র দুই পায়ের মধ্যে দিয়ে আচমকা অমন রাস্তা কেটে গেলে ব্যালেন্স থাকে কারো? কাঁকরের রুক্ষ রাস্তায় বিডিও সাহেবকে ফেলে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে নিশ্চিন্তে থাবা চেটে নিল সে একবার…তারপর লাফ মেরে অন্তর্হিত হল দিগন্তের ওপারে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে।

 

More Articles