কেন বৌদ্ধধর্মেও আজ পালিত অশোক বিজয়া দশমী! দশমীর এ কাহিনি অজানাই
Durgapuja 2022: বৌদ্ধধর্মেরও আবার বিজয় দশমীর এক তাৎপর্য রয়েছে। বিজয়া দশমীর অন্য এক নাম অশোক বিজয়া দশমী। আজকের দিনেই সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধে জয়লাভ করেন।
‘নবমীর নিশি গো তুমি আর যেন পোহাইয়ো না
দুঃখিনী মায়ের প্রাণে আর ব্যথা দিও না’
দেখতে দেখতে পুজোর চারটে দিন পেরিয়ে আজ দশমী । উমার আবার স্বামীর ঘরে ফেরার দিন চলেই এল। সারা বছর পুজোকে ঘিরে গোটা বাঙালির যে আশা আনন্দ থাকে, কত সহজেই তা কয়েক মুহূর্তেই ফুরিয়ে যায়। এই চারটে দিন, সময় যেন আলোর চেয়েও দ্রুত বেগে ছোটে। দশমী মানেই বাঙালির এক ভীষণ মনখারাপের দিন, উমাকে পানপাতা দিয়ে বরণ করে, মিষ্টি দিয়ে কান্নাভেজা হাসিমুখে আবার ভোলানাথের কৈলাসে পাঠানো আসলে উমা যে ঘরেরই মেয়ে। তবে দশমীর এই বিষাদের সঙ্গেই আসে বিজয়ার পালা। দশমীর দুঃখ ভুলে বাঙালি আবার মেতে ওঠে মিষ্টি খাবার উৎসবে। বিজয়া দশমীর এই ধারণা আমাদের সকলেরই জানা কিন্তু বিজয়া দশমীর যে কাহিনি আজ বলব তা যে কেবল বাঙালিদের, তেমন কিন্তু নয়। আজ বলব বিজয়া দশমীর এক বৃহত্তর ক্ষেত্রের কথা।
পুরাণে মহিষাসুর বধের কাহিনি অনুসারে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরের সঙ্গে টানা নয় দিন, নয় রাত্রি যুদ্ধ চালান। তার মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিল চারদিন। তিথি অনুযায়ী এই চারদিন ছিল, আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এবং আজ অর্থাৎ শুক্লাপক্ষের দশম দিন। আজই দুর্গা মহিষাসুরকে হত্যা করতে সক্ষম হন। দুর্গার এই যুদ্ধে বিজয় লাভের কারণে এই দিনকে ‘বিজয়া’ বলা হয়ে থাকে। আবার শ্রীশ্রীচণ্ডী কাহিনি অনুযায়ী, দেবীর আবির্ভাব হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে। পরে শুক্লা দশমীতে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন তিনি, বিজয়া দশমী এই বিজয়কেই চিহ্নিত করে।
আরও পড়ুন- মৃৎশিল্পীর ভুলে দেবী হয়ে গেলেন নীল, কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়
এবার আসা যাক, রামায়ণের প্রসঙ্গে। সীতাহরণকে কেন্দ্র করে রাম এবং রাবণের যে যুদ্ধ লঙ্কায় হয়েছিল, সেই যুদ্ধেও রাম আজকের দিনেই রাবণকে বধ করেছিলেন। সেখান থেকেও আবার আজকের দিনটি চিহ্নিত 'বিজয়া' হিসাবে। আজকের দিনে তাই উত্তর এবং মধ্য ভারতে বিজয়া দশমীর পাশাপাশি পালিত হয় আরও একটি উৎসব, ‘দশেরা’। এই দশেরার সঙ্গে দশমীর কোনও সম্পর্ক নেই। ‘দশেরা’ কথাটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘দশহর’ থেকে। এই দশহর, দশানন রাবণের মৃত্যুকে চিহ্নিত করে। বাল্মীকির রামায়ণে বলা হয়েছে, আশ্বিন মাসের ত্রিশতম দিনে শ্রী রামচন্দ্র, সীতা এবং লক্ষ্মণ সহযোগে চোদ্দ বছর পর অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। এই দিনেই পালিত হয় দীপাবলি উৎসব। মহাভারত বলে আবার অন্য কথা । ১২ বছর অজ্ঞাতবাসে থেকে আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে পাণ্ডবরা শমীবৃক্ষে তাঁদের লুকনো অস্ত্র উদ্ধার করে এবং ছদ্মবেশ ছেড়ে পুনরায় সাধারণ জীবনে পদার্পণ করেন।
বৌদ্ধধর্মেরও আবার বিজয় দশমীর এক তাৎপর্য রয়েছে। বিজয়া দশমীর অন্য এক নাম অশোক বিজয়া দশমী। আজকের দিনেই সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এই যুদ্ধে জয়লাভ করার পরে তিনি টানা দশ দিন ধরে যে বিজয় উৎসব পালন করেছিলেন তাই অশোক বিজয় দশমী হিসাবে পরিচিত। এই কলিঙ্গ যুদ্ধের পর একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুককে দেখে তিনি এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং চিরকালের জন্য হিংসার পথ থেকে দূরে সরে আসেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অসংখ্য বৌদ্ধ স্থানে ভ্রমণ করেন এবং বহু শিলালিপি, ধর্ম-স্তম্ভ স্থাপন করেন। বুদ্ধের জীবনচর্চা এবং সেই জীবনকেই অতিবাহিত করেন তিনি। সম্রাট অশোক রাজপরিবারের সঙ্গে ভন্তে মোজ্ঞলিপুত্ত নিষ্পের থেকে বৌদ্ধধর্মের দীক্ষা নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- মুম্বইয়ের রঙ কোম্পানি বদলে দিল বাংলার দুর্গাপুজো! কীভাবে শুরু হল থিমের পুজো?
হিন্দুশাস্ত্র মতে, দুর্গাদেবীকে পুজোর জন্য আহ্বান করে আসার পরেই মাটির প্রতিমা প্রস্তুতির কাজ শুরু করা হয়। আবার দশমীতে, পুজো শেষ হলে দেবীর উদ্দেশ্যে বলা হয়, তিনি এখন যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন। তখন প্রতিমা থেকে দেবীর মুক্তি ঘটে। তারপর সেই প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়ে থাকে, তাই বিসর্জন অর্থে বিনাশ নয় বরং মুক্তি দেওয়া। অনেক জায়গাতেই আবার দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় না। বছরান্তে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে নতুন প্রতিমা ঘরে আনা হয়। আবার ধাতব প্রতিমা হলে তা কখনই বিসর্জন দেওয়া হয় না। অর্থাৎ বিজয়া অর্থে একাধারে দেবী দুর্গা এবং রামচন্দ্রের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করা।
অতি সাধারণভাবে দেখতে গেলে, দশমী যেন বাঙালিদের সামাজ জীবনের কথাই বলে। বিয়ের পর যেভাবে বাপের বাড়িতে কয়েকদিনের অতিথি হয়ে থাকতে হয় এখনও কিছু মেয়েকে, আবার নির্দিষ্ট সময় ফিরে যায় শ্বশুরঘরে, দশমীর কাহিনিও যেন সেই সমাজ জীবনের চিত্রই আমাদের সামনে অন্যভাবে তুলে ধরে। তাই তো বাঙালি মায়েরা যেন দেবীকে বিদায় জানান না, বিদায় জানান নিজের ঘরের কন্যাসন্তানকে আর আশা করে থাকেন আবার পরের বছরের, কবে আবার ঘরে ফিরবে উমা?
তথ্যসূত্রঃ
২. https://bangla.asianetnews.com/life/the-significance-of-vijaya-dashami-py0r13

Whatsapp
