আত্মসংলাপের মধ্যে দিয়ে মানুষের কাছে ফিরে গিয়েছেন মণিকুন্তলা সেন

Manikuntala Sen: মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিতে যেভাবে মণিকুন্তলা ও অন্য মেয়েরা সংগঠিত হচ্ছিলেন, সংগঠিত করছিলেন, এবং পার্টির বাইরেও সংগঠিত হবার যে বৃহত্তর ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছিল তা কাটাছেঁড়া করা আজ অত্যন্ত জরুরী রাজনৈতিক কাজ।

পাড়া-গাঁয়ে বড় হয়ে ওঠা। সেই সূত্রে-ই এবং লিঙ্গ পরিচয়ে মেয়ে হওয়ার কারণে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর একটি নিজস্ব ভাবনা উঠতি বয়সেই তৈরি হয়ে যায়। বাড়িতে টালির চালের রান্নাঘর, দালান-উঠোন-কলতলাতেই নাওয়া-খাওয়া। গল্পগাছা, পরনিন্দা-পরচর্চা সব সেখানেই। রান্নাঘর সংলগ্ন দালানে বসে পা দোলাতে দোলাতে, কখনও বা রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে গল্প করার, চা-মুড়ি খাওয়ার কিংবা কৎবেল মাখার, পেয়ারা মাখা খাওয়ার বদঅভ্যাস ছোটবেলা থেকেই রপ্ত করা গিয়েছিল। সে সব দেখলেই ঠাকুমা রে রে করে উঠত। বলত, ‘ছাঁচতলায় বসতে নেই অলক্ষণ হয়’, ‘দোরে বসে খেতে নেই ঘরে নক্ষ্মী আসা যাওয়ায় বাধা হয়’। সাত-আট বছর বয়সেই এঁড়ে বাছুরের মতো সেই সব বাধা নিষেধের তোয়াক্কা করতাম না। তাতে ঘরে কতটা লক্ষ্মীলাভ বা লোকসান হলো তা হয়ত ঠাকুমা বেঁচে থাকলে জানা যেত। পরবর্তীতে, সেই রান্নাঘর, ছাঁচতলা, দালান দ্রুত পাল্টে গেল। বালিকা কিশোরী হলো। ঘরে-বাইরে মধ্যবিত্ত জীবনের স্থাপত্য বদলে গেল। বিশ্বায়িত আধা মফস্বল, পাড়া-গাঁর বাড়িগুলোতে ঝকঝকে মেঝে হলো। জমি-জিরেত, ক্ষেত-বরজ ইত্যাদির উপর নির্ভরতা ঝুরঝুরে হয়ে গেল। লক্ষ্মীকে ধরে রাখার জন্য দোরগোড়ার আর দরকার পড়ল না। নয়া-উদারবাদী জমানায় ঘরে ঘরে লক্ষী এল হেলতে-দুলতে; টাকা-কড়ি, কালার টিভি ও তজ্জনিত শ্রী এল। অথচ, যারা ছাঁচতলায় বসে পা দোলানো বন্ধ করল না, আজীবন তাদের অলক্ষী হওয়াটাই দস্তুর হয়ে উঠল। বাংলার দেশ-গাঁয়ে এমন বেয়াড়া লক্ষীছাড়া মেয়েদের এক স্বতন্ত্র ইতিহাস রয়েছে। সেই ইতিহাস ফিরে দেখার চেষ্টাই করছি। আসলে তা অলক্ষী হয়ে ওঠার এক সময়াতীত সংলাপ তৈরির প্রচেষ্টাও বটে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রেশ থিতু হয়েছে। গোটা উপমহাদেশে ব্রিটিশদের ‘রাজ’ গেঁড়ে বসেছে। ব্রিটিশবিরোধী কার্যকলাপ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ততটাই জোরদার ও সার্বিক হয়ে উঠছে। বরিশালের কীর্তনখোলা নদী সংলগ্ন জনপদের বালিকা-কিশোরী-যুবতীরাও আন্দোলনে উদ্বেলিত। বঙ্গ-ভঙ্গবিরোধী আন্দোলন থেকে স্বদেশী আন্দোলন, যুগান্তর পার্টির কাজকর্ম— বাদাবনের সমাজজীবনে একের পর এক আন্দোলন ধাক্কা দিচ্ছে। এর মধ্যেই কৈশোরে উত্তীর্ণ হচ্ছে যে মেয়েরা তাঁদের একজন— মণিকুন্তলা সেন। তাঁর হয়ে ওঠার তথ্য-গল্প-ঘটনা তিনি নিজেই লিখে রেখে গেছেন, আত্মজীবনী ‘সেদিনের কথা’য়। তাঁর জন্ম ১৯১০ সালে। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি স্থানীয় জমিদারের কমন ম্যানেজার বিলাসচন্দ্র সেনের মেয়ে। শিক্ষা, আচার-বিচার, পরিশীলিত রুচি নিয়েই বড় হচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু এই বাক্যবন্ধের ভিতর দিয়ে যে জীবনের ছবি আজও আমরা মধ্যবিত্ত সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাকে নিজের হাতে দুমড়ে-মুচড়ে ভাঙলেন। কেন? উত্তর কি শুধু সময়ের দাবি? যদি তাই হতো তাহলে, দীর্ঘ পঁচিশ বছর তিনি যে কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন, পার্টির চতুর্থ স্টেট কনফারেন্সে তৈরি হওয়া স্টেট-কমিটির একমাত্র মহিলা সদস্য ছিলেন, যিনি পার্টির একমাত্র মহিলা ভোটপ্রার্থী— তিনি পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন কেন? এ বিষয়ে পাঠককে, সঙ্গে নিজেকেও ‘কৈফিয়ত’ দিতে গিয়ে লিখেছেন, 

“কমরেড ভবানী সেন বলেছিলেন আপনি থাকবেন কী করে— জবাব দিইনি। মনে মনে ভাবলাম— বেরতে তো চাইনি, কিন্তু থাকতে পারলাম না বলেই তো বেরতে হল। অন্যদের কী হয় জানি না, কিন্তু আমার যে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। একটু খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে চাই।”

‘নিজের কক্ষপথ ছেড়ে ছিটকে পড়া তারার মতোই হারিয়ে’ যাওয়ার অবস্থাকে তিনি নিজেই চিহ্নিত করলেন ‘স্বেচ্ছানির্বাসন’ হিসেবে। মণিকুন্তলা-র রাজনৈতিক জীবনে ইতিটানা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল না। এ কথা আমরা জানি। তাঁর কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার পরত খুলে খুলে যত দেখা যায় তত এই জানা-বোঝা পরিপক্ক হয়।

আরও পড়ুন

মফসসলের অলক্ষ্মী-ছাপ

বরিশালের খালি-বিল, জলাজমি, নদী-বকচরের নিসর্গ-ই মণিকুন্তলা-র শিশুমনে দরজা-জানলা খুলে দেয়। বাড়িতে মোটামুটি ধর্মীয় আবহে বড় হয়ে ওঠা তাঁর। তৎকালীন জাতীয়তাবাদী নেতা অশ্বিনী কুমার দত্তের সাহচর্যে ব্রাহ্মসমাজের দর্শন ও আদর্শের সঙ্গে বোঝাপড়া  ঘটে। এরপর কখনও থিয়সফিক্যাল সোসাইটি সম্পর্কে জানছেন তো, আবার কখনও বাড়ির লোক, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ধর্মালোচনা শুনতে শুনতে  বড় হচ্ছেন মণি। পড়ছেন গীতা-ভাগবত। শুধু তাই নয়, ধর্মের ভিতর দিয়েই তিনি জীবনকে বোঝার চেষ্টা করছেন। তা নিয়ে ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকাতে লেখাপত্র দিচ্ছেন। নিজেই স্বীকার করেছিলেন– তাঁর মধ্যে সন্ন্যাসী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। অন্যদিকে, বরিশালের পাড়ায় পাড়ায় চলা স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার-ভাটা; কংগ্রেস ও গান্ধীজির রাজনৈতিক ধারণা, তাও তাঁকে ভাবাচ্ছিল। স্বদেশী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন কিশোরী মণিকুন্তলা। আবার, দেশ ও বিশ্বের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির আকর্ষণে সেই কৈশোর আরও ছটফটে হয়ে উঠছে। পারিবারিক সূত্রে চারণ কবি মুকুন্দ দাসকে চিনছেন। মুকুন্দ দাসের গান, নাটক অভিনয় সবকিছু গোগ্রাসে গিলছেন। আত্মজীবনীর পাতায় পাতায় তাঁর সেই সময়ের বর্ণনা পড়লে বোঝা যায়, বরিশালে বসেই সেই কিশোরী বিশ্বের যাবতীয় দর্শন, আলো-হাওয়া-ঝড়কে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অন্তরে প্রবেশ করতে দিয়েছিল অবাধে। মণিকুন্তলা লিখছেন নজরুলের ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’ গানটি তাঁকে অদ্ভুতভাবে স্পর্শ করছে,

“যেন মনে হত ওই নারী আমি নিজেই, ‘ধর্ষিতা নাগিনী’ শুনলে মনে হত আমি যেন খাড়া হয়ে ফণা তুলছি।”

রবীন্দ্রনাথের গান, চিন্তাভাবনাও নাড়াচাড়া করে দেখা চলছিল। কলকাতায় আসার পর দেখাও হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।

একদিকে ব্রাহ্মসমাজ, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী আদর্শ, কংগ্রেসের রাজনীতি বুঝতে শুরু করার পরপরই যাতায়াত শুরু করলেন স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের শঙ্করমঠে। আশ্চর্যজনকভাবে এই শঙ্করমঠ-টি ছিল তখনকার যুগান্তর পার্টির গোপন ডেরা। তাঁর শান্তিদি অর্থাৎ শান্তিসুধা ঘোষের হাত ধরেই সেখানে আনাগোনা শুরু। সেই প্রথম তাঁর মার্কস-লেনিন পড়ে ফেলা। এসব করতে গিয়ে হলো আরেক ঝামেলা। মণির মনের ভেতর ধর্ম এবং রাজনীতির টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব তৈরি হলো। ধর্মকে অবলম্বন করে বড় হয়ে উঠেছিল যে কিশোরী, তাঁর কাছে নিরীশ্বরবাদ মেনে নেওয়া অসম্ভব। দ্বন্দ্ব শুধুমাত্র ধর্ম আর রাজনীতির নয়। মণিকুন্তলার লেখা থেকে ধরে নেওয়া যায় এই দ্বন্দ্ব জগত সংসারে বেঁচে থাকার। এবং এই দ্বন্দই তাঁকে ক্রমশ ঠেলে দিয়েছে কমিউনিস্ট বীক্ষার দিকে।

পুলিশ হানা দিচ্ছে শঙ্করমঠের গোপন ডেরায়। শান্তিদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ছেন। থানাদারের জেরা থেকে তাঁরও মুক্তি নেই। প্রীতিলতা-দীনেশ গুপ্তের ফাঁসির খবর পৌঁছেছে বাড়িতে। প্রবল উত্তেজনার দিনগুলোতেই এ.বি.সি.অব কমিউনিজম বইটি পড়ছেন। ধর্মেরবোধ ও রাজনৈতিক বোধকে মিলিয়ে দেখতে চাইছেন। “নির্যাতিত মানুষের সেবা ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম”-ই হয়ে উঠেছে তাঁর রাজনীতি। এটাই তো হওয়ার কথা ছিল জৈবিকভাবে— দ্বন্দ্বকে চেনা-জানা এবং অজস্র ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যে দিয়ে আমাদের চেতনা, চর্চা ও রাজনৈতিক অনুশীলন ক্ষেত্রটির নির্মাণ। এই প্রস্তুতি না থাকলে মণিকুন্তলার পক্ষে সম্ভব হতো না আজীবন নিজের রাজনীতির কাছে দায়বদ্ধ থাকা। তৈরি হত না তাঁর (এবং পার্টির) রাজনৈতিক ভুল-ত্রুটি স্বীকার করতে পারার ঔদামুক্ত মনের ভাব।

বি.এ. পাস করে কলকাতায় চলে আসছেন ইউনিভার্সিটিতে এম. এ. পড়তে। বরিশালের ঘেরাটোপ থেকে ক্রমশ উন্মুক্ত হচ্ছে মানচিত্র। স্টিমারে আসতে আসতে এতদিনের নিষিদ্ধ খাবার মুরগির ঝোল খাচ্ছেন তৃপ্তি করে। কলকাতার কথা বলতে গিয়ে বলছেন, ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন এবং ডোভার লেন-ফার্নরোডে থাকা অবস্থায় রাস্তাঘাটে মেয়েদের সঙ্গে কীভাবে ইভটিজিং হত। এই সমস্যাকে তিনি আখ্যা দিয়েছেন ‘বিড়বিড় সমস্যা’ নামে। বরিশাল থেকে তরুণী মেয়েটি কলকাতায় কেবলমাত্র এম এ পড়তে আসেনি। এসেছিল শান্তিদিদের সেই পার্টির খোঁজে, যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছিল বারবার। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ, গোপন। জোড়াসাঁকোর সৌমেন ঠাকুরের পার্টিতেই প্রাথমিকভাবে যুক্ত হলেন। পরে জানতে পারলেন এ-পার্টি সে-পার্টি নয়। বেরিয়ে এলেন। ধীরে ধীরে যোগাযোগ তৈরি হলো কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। স্কুল চাকরি করতে করতেই  জড়িয়ে পড়লেন পার্টির কর্মকাণ্ডে। তৎকালীন মহিলা সংগঠনগুলির অন্যতম, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হয়ে উঠেছিলেন মণিকুন্তলা সেন। এ.আই.ডব্লিউ.সি মঞ্চ, মহিলা ফেডারেশন এবং কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে গেছেন ১৯৪০-এর উত্তাল সময় জুড়ে। অথচ, ভিতরের সেই দ্বন্দ্ব আজীবন তাড়া করে বেরিয়েছে তাঁকে। ভগবান এবং কমিউনিজমের বোঝাপড়া ছেড়ে, সেই দ্বন্দ্ব কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ কাজ নিয়ে, তো কখনও নিজের পার্টির ভিতরের। তাঁর আত্মজীবনী অন্তর্দ্বন্দ্বের নীরব সাক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

জাতপাত, হিন্দুয়ানি, ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং তার সাথে জড়িয়ে থাকা মেয়েদের শোষণ, ক্রমাগত ঘরবন্দি হওয়ার বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেছেন, লিখেছেন। কখনও তিনি বলছেন, আইনের অধিকার দিয়েও সমাজের কুসংস্কার দূর করতে পারা যায়নি।  কোথাও প্রশ্ন তুলেছেন,

“কমিউনিজম ও স্বাধীনতার সংগ্রাম দুটো কী আলাদা?”

মনে হয়, আত্মজীবনীর পাতা জুড়ে তাঁর এই বাড়তে থাকা প্রশ্নমালা, নিজের সঙ্গে নিজের বিতর্ক অযথা, অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু এহেন আত্ম-সংলাপের জেরেই বারবার মানুষের কাছে, সমাজের কাছে তিনি ফিরে গেছেন।

কলকাতায় মন্বন্তর চলাকালীন বস্তিতে কাজ, হাওড়া, হুগলি, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি— জেলায় জেলায় সংগঠন তৈরি করা, সেবামূলক কাজ করায় উজার করে দিয়েছিলেন শরীর, মন ও মেধা। জেলবন্দি হচ্ছেন একাধিকবার। জেলের ভেতরেও কাজ থামছে না। বিনিময়ে পাচ্ছেন আঘাত। বাইরের শক্তির কাছে তো বটেই; ব্যক্তিগত আক্রমন সইতে হয়েছে স্কুলের সহকর্মীদের কাছ থেকে। সাংগঠনিক কাজ করতে গিয়ে গ্রামাঞ্চল এবং মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের কাছ থেকেও বাধা এসেছে। কংগ্রেসের দিক থেকে, এমনকি নিজের পার্টির ভেতর থেকেও নানান লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ধেয়ে এসেছিল। ইটালির কমিউনিস্ট মহিলা সংগঠন নিয়ে পার্টির ভেতরে কথা বলতে গিয়ে তিনি দেখছেন, সেসব নিয়ে মেয়েদের আলোচনা পার্টি পাত্তা দেয় না। সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির তখনকার অবস্থানকে মেনে না নিতে পারার কথা লিখেছেন। তাঁদের আত্মরক্ষা সমিতির সেবামূলক ও গঠনমূলক কাজ, বস্তিতে বস্তিতে মেয়েদের সঙ্গে কাজ, পার্টি পরিসরে একটু নিচু চোখেই দেখা হয়েছে। তাঁর কথায়,

“কেউ কেউ বলতেন— এ তো রামকৃষ্ণ মিশনের কাজ। এতে কি বিপ্লব আসবে? …… আজও বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনোতোষিনী মাসিমা সমিতির নানা কাজের জন্য টাকা তুলে দেন। এসব কি শুধুই রামকৃষ্ণ মিশনের কাজ বলে মনে হয়? ওইসব মেয়েরা কমিউনিস্ট পার্টির বাহিনীভুক্ত তবে হলো কী করে?”

তারপরেও মণিকুন্তলা, রেনু চক্রবর্তী লতিকা সেন, অমিয়া সেন, এলা রীড ও আরও নানান মেয়েরা তাঁদের কাজ চালিয়ে গেছেন। গড়ে উঠছিল ঘরে-বাইরে পত্রিকা গোষ্ঠী। গড়ে উঠছিল সমবায় সমিতি।

মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির এই ব্যাপক কাজকর্ম বিপ্লবের স্বার্থে কতটা কাজে লেগেছিলো, বলা যাচ্ছে না। কিন্তু, ফিরে দেখার মধ্যে একটুকু বোঝা যায়, তথাকথিত পার্টি ধাঁচের বাইরের কাজগুলো গণ-আন্দোলনের ভাবনায় অনেক বেশি জারিত। মেয়েদের পরিবারের সঙ্গে সংঘাত, খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার লড়াই, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই, জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই, মুসলিম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই জড়িয়ে-মড়িয়ে ছিল সেখানে। আর এতগুলো লড়াইকে একসঙ্গে ধরে রেখেছিল কমিউনিজমের ভাবনা। যেহেতু সে সময় ভারতের একটি মাত্র রাষ্ট্রপরিচয় ছিলো না, এবং পরে, সবেমাত্র ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ায়, রাষ্ট্রীয় পরিচিতি সেভাবে গেঁড়ে বসতে পারেনি। সুতরাং, বৃহত্তর পরিসরে কমিউনিজম, সোশ্যালিজম এবং মেয়েদের আত্মরক্ষা সমিতির আঙিনায় চলতে থাকা দৈনন্দিন সংঘর্ষ রাষ্ট্রমুখরতায় পরিপূর্ণ  হয়ে ওঠেনি। আন্দোলনের ক্ষেত্রটিতে, স্ব-শাসনের এক ভাবনা ছিল। সংগঠিত মেয়েদের মধ্যে স্ব-এর নির্মাণ ঘটেছিল। 

সংগঠিত করার পদ্ধতিতে রাজনৈতিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন মণিকুন্তলা ও সাথী মেয়েরা। পাশাপাশি, উচ্চকোটির মেয়েদের সঙ্গে নিম্নবর্গের মেয়েদের, মুসলমান মেয়েদের সঙ্গে হিন্দু মেয়েদের, কৃষক মেয়েদের সঙ্গে শ্রমিক মেয়েদের এক বৃহৎ রাজনৈতিক মিলনের আশা ছিল তাঁর ভাবনায়। কমিউনিজমের ভাবনায় নিহিত এক গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক প্রশ্নকে চল্লিশের দশকেই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। লিঙ্গ-ধর্ম-জাতপাত, পার্টি, পার্টির ভেতরের আমলাতন্ত্র— সর্বত্র তিনি চৌকাঠ ভাঙতে চেয়ছেন। বা বলা ভালো, চৌকাঠ-কে চিরতরে সমাজ-বাড়ি-জীবনের ভিতর থেকে সমূলে উপড়ে ফেলার আকাঙ্খা সযত্নে লালন করেছেন।

দেশভাগের যন্ত্রণা আর কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা তাঁর কাছে এক হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুতভাবে, যে ক্ষোভ নিয়ে পার্টি ছাড়লেন তা বাম-রাজনীতির আঙিনায় তাঁর মতো আরও বহু মহিলা সংগঠক, কর্মীদের। পার্টি ভাগ হলো, ষাট-সত্তরের দশক পেরিয়ে বামপন্থার বহু বিভক্ত রাজনীতির আঙ্গিনায় আরও পার্টি এল। তারা কেউ সংসদে গেল, কেউ গেল না। বহু গণআন্দোলন তৈরি হল, ভাঙল। নকশালবাড়ি থেকে নন্দীগ্রামের সাক্ষী থাকল বাম-রাজনীতি। এ সবের ভিতর রাজনৈতিক কাজকর্মে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু মণিকুন্তলা-র ক্ষোভ আজকের দিনেও ততটাই প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে।

আরও পড়ুন

ফুলন দেবীর খুনিই ভারতে আনেন পৃথ্বীরাজ চৌহানের অস্থি! জানেন, কে তিনি?

ব্যক্তিগত পরিসরে অনেক-কেই জানি, তথাকথিত রাজনৈতিক কাজকর্মে না থাকা সত্ত্বেও, বেঁচে থাকার উচ্চারণে প্রতিরোধ ও সমাজবদলের স্বপ্ন ধারণ করেছেন। আজ ভাবা দরকার সমাজের গভীরে প্রতিরোধ ও বদলের এই ইচ্ছা কীভাবে জন্ম নেয়, বেঁচে থাকে। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিতে যেভাবে মণিকুন্তলা ও অন্য মেয়েরা সংগঠিত হচ্ছিলেন, সংগঠিত করছিলেন, এবং পার্টির বাইরেও সংগঠিত হবার যে বৃহত্তর ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছিল তা কাটাছেঁড়া করা আজ অত্যন্ত জরুরী রাজনৈতিক কাজ; বিশেষত লিঙ্গ রাজনীতির প্রসঙ্গে। সেই প্রয়োজনীয়তার কারণ শুধুই আত্মরক্ষা সমিতির আন্দোলনের ঐতিহাসিক মূল্য নয়। নির্দ্বিধায় বলা যায়, এতটা সময় পরেও পার্টি বা পার্টি বহির্ভূত গণ-আন্দোলনে বরাবর ‘রাজনৈতিক মস্তিষ্ক’ হয়ে থেকেছে, থাকছে, পুরুষেরা। একটু খোঁজ নিলেই দেখা যায়, আন্দোলনের পরিসরে তাঁরাই ঠিক করেন রাজনীতি এবং রণনীতি। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া, আন্দোলনে মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ খুব যে বেড়েছে, তা নয়। মেয়েরা আজ অবধি দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর কর্মী এবং সংগঠক। স্বদেশী আন্দোলন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত হরতাল, মিছিলের ভিড় করেন তাঁরা। পার্টি এবং তথাকথিত ভ্যানগার্ডরা তাঁদের সংখ্যায় চেনে, প্রতিনিধিত্বে চেনে।

এই অবস্থাকে যারা ভাঙতে চায়, তাদের প্রচুর হোঁচট খেতে হয়। কোণঠাসা হতে হয়। একসময় কেউ কেউ সরে যান এবং ব্যক্তিগত জীবনচর্চার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। আজকের সময়ে কখনও কখনও পার্টি বহির্ভূত গণ-আন্দোলনে মেয়েরা বেরিয়ে আসছে নিজেদের দাবি নিয়ে। কিন্তু ওই যে; যে চৌকাঠ ভাঙার কথা ছিল, সেই চৌকাঠের নকশা বদলে গেছে একবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালেই। ঘরের সব মেঝে এক করে দিয়ে চৌকাঠহীন মায়া-দুনিয়ায় সমস্ত কিছুকে ঘিরে রাখছে চকচকে বাজার আর ফাটকা পুঁজি। পার্টি ব্যতিরেকে সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া আসলে না-সংগঠন হয়ে ওঠারও। অথচ ঠিকভাবে দেখলে, বুঝলে, সেই না-সংগঠনের জমিও নতুন এক রাজনীতি কিংবা প্রকৃত গণআন্দোলনের বীজতলা হয়ে উঠতে পারে।পারে, নিচুতলার বা প্রান্তের নতুন রাজনৈতিক নির্মাণ ক্ষেত্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকেও ধরে রাখতে।

উপমহাদেশ জুড়ে গত দু-বছরে আন্দোলনের নতুন নতুন চেহারা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। যা শুরু হয়েছিল তাহরির স্কয়ারের ‘সাইবার ডিসিডেন্ট’দের তৈরি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এ জাতীয় স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান, অভ্যুত্থান-পরবর্তী  আন্দোলনে সংগঠিত হওয়া, সংগঠন থাকা না থাকার আলোচনা জরুরি। শুধুমাত্র রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতের নিরিখে নয়। সেখানে মহিলাদের সংগঠিত হওয়ার, এবং সাধারণভাবে সংগঠনের পদ্ধতি নিয়ে। সংগঠক মেয়েদের পার্টি ও গণ-আন্দোলনের ভিতরে-বাইরে ভূমিকা, সংগঠিত করার পদ্ধতির অজস্র উদাহরণ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির ইতিহাসে ধরা রয়েছে। মণিকুন্তলার মতো একই দ্বন্দ্ব আজকের বাংলার মেয়েদের চেতনায়। সে দ্বন্দ্ব কতটা রাজনীতিলগ্ন ও সমস্যায়িত করা যাবে তার উত্তর আন্দোলনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে ঝাঁপ না দিলে জানা সম্ভব নয়। ঝাঁপ দিতে গেলে তৈরি হতে, প্রস্তুত হতে হয়। মণিকুন্তলা বা ওঁর মতো মেয়েদের কাজ ফিরে দেখা, তাঁদের কথা আবার শোনা সেই তৈরি হবার, প্রস্তুতির অঙ্গ।

More Articles