লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর মধ্যাঞ্চলে ঘুরতে শেখান নবনীতা

Nabaneeta Dev Sen : নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়া খুব দরকার। আমার কী আছে, কী চাই, এসব বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট হওয়া চাই। এমন নয় যে এইসব চাওয়া পাওয়ার কোনো পরিবর্তন হবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবটাই পাল্টায়।

লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে হয়ে থাকার পাঠ আমরা পাই সেই শৈশবে। লক্ষ্মী হয়ে থাকলে কেউ বকে না, মারে না, স্কুলে বেশি নম্বর পাওয়া যায়, আদর বাড়ে। লক্ষ্মী হলে লেবেনচুষ, মিঠাই পাওয়া যায়। অর্থাৎ, সবটাই পাভলভের এক্সপেরিমেন্ট। লক্ষ্মী হওয়ার কন্ডিশানিং। 

লক্ষ্মী মানে যে সবার কথা মতো কাজ করা। লক্ষ্মী মানে, যে নিয়ম মেনে বাঁচে— সামাজিক নিয়ম, প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম, সমষ্টির নিয়ম অনুবর্তী হওয়ার আরেক নাম লক্ষ্মী। হাতেপায়ে বেড়ি দিয়ে দন্ডিকাটা সরু অঞ্চলের মধ্যে ঘোরাফেরা। স্বাভাবিকভাবেই, নিয়মের বিপরীত অবস্থান মানেই অলক্ষ্মী।  

মজার ব্যাপার হলো, শৈশব পেরলেই লক্ষ্মী হয়ে বাঁচার পথটা জেন্ডার রোল অনুযায়ী ভাগ হয়ে যায়— লক্ষ্মীছেলে হয়ে থাকার দায় ক্রমশ হালকা হতে থাকে, লক্ষ্মীমেয়ের পাল্লায় শাসন, কড়াকড়ি বাড়তে থাকে। গল্প উপন্যাস সিনেমায় দেখা যায়, সব বয়সের নারীচরিত্রই বেশ লক্ষ্মী। যারা অলক্ষ্মী তার জীবনে সব আছে, চাকরি আছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে, নামডাক সম্মান আছে, কিন্তু সুখ নেই। কেন? কারণ তার সংসার নেই, বা একদা সুখের সংসারে ভাঙন ধরছে। এই হচ্ছে বাঙালি মেয়ের প্রত্যক্ষ লক্ষ্মীর নিদর্শন। পরোক্ষে অলক্ষ্মীর  সাবধানবাণীও বটে। 

অথচ, বাঙালি লক্ষ্মীরা হুড়মুড় করে অলক্ষ্মী ছেলের প্রেমে পড়বে, তাদের আগলে রাখবে। ছেলেদের বরং একটু বাউন্ডুলেপনা ভালো! সংসারে সে থাকবে, সন্ন্যাসীর মতো, অর্থাৎ কোনো দায়িত্ব না নিয়ে। সংসার সুখের হবে লক্ষ্মী স্ত্রীর গুণে। 

 

এরকম একটা বৃহত্তর সমাজে বড় হতে হতে বুঝি, খুব বেশি নিয়ম মেনে কাজ করতে মন থেকে সায় পাচ্ছি না। বুঝতে শিখছি, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে, অপরকে খুশি করে লক্ষ্মী ঠিকই হওয়া যায়, সুখী হওয়া মোটেই যায় না। সে, লোকে যতই যাই বলুক! ওসব গল্প টিভিতে অর্ধসত্য দেখায়। উপন্যাস এক সময়ে শেষ হয়, সিনেমার নায়িকারা দু-আড়াই ঘণ্টা নিয়ম পালন করে পর্দা থেকে বিদায় নেয়। পাঠক বা দর্শকের পক্ষে একটা গোটা জীবনজুড়ে লক্ষ্মী হয়ে থাকা অসম্ভব।  

কিশোরীবেলার এই দোটানার মুহূর্তে এমন কাউকে আমাদের প্রয়োজন ছিল, যে অভয় দিয়ে বলবে, ঠিক! ঠিক! একদম ঠিক ভেবেছ। লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী বাদ দাও, এসো পা ছড়িয়ে বসে গল্প করি, ঘুরে বেড়াই, উড়ে বেড়াই, থিতু হওয়ার সময়ে জিড়িয়ে নিই, আবার উড়ি, ঘুরি! এমন কোনো নারীকে আমরা খুঁজেছি, যার ছন্নছাড়া উড়নচণ্ডী জীবন সত্ত্বেও তাকে সমাদরে গ্রহণ করেছে বাঙালি। পুরোপুরি গ্রহণ করতে না পারলেও,  উপেক্ষা করার সাহস পায়নি। বিদেশি চরিত্র দিয়ে আর মন ভরছিল না। এমন কাউকে চাই যে আমারই নিজের জলমাটিতে লালিত। আমি যে সমাজের চোখরাঙানির মধ্যে বড় হচ্ছি, সেই সব শাসন সত্ত্বেও নিয়মের ফাঁক গলে নিজের মতো সুন্দর সে নিত্যনতুন পথে হেঁটেছে, এমন এক বাঙালি নারী আমাদের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। 

এমন সময়ে একদিন দেখি, নবনীতা দেবসেন লিখছেন,

"যত গল্পের বই পড়েছি জীবনে সর্বত্রই আমি দেখেছি, যে পুরুষমানুষ যত উড়নচণ্ডে কাছাখোলা হয়, মেয়েরা তাকে তত ভালবাসে। কত আহা-উহু করে, কত যত্ন আত্তি করে…. কোনো বাংলা নভেলে কোনো উড়নচণ্ডী নায়িকা নেই।"

এই তো পেয়েছি যে আমার মনের কথাটা লিখেছে। আমার মতো আরও নবীনা-প্রাচীনার মনের মতো কত কথা লিখে রেখেছেন নবানীতা দেবসেন! নবানীতা দেবসেন-এর লেখার সঙ্গে যখন আমার পরিচয়, ততদিনে আমি মন স্থির করেছি যে বড় হয়ে বনবাসী হব। জলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো যায়, এ রকম কোনো বিষয়ে পড়াশোনা ও কাজ করব ভবিষ্যতে। মা-বাবার দেখলাম এতে কোনো আপত্তি নেই, তবে বাদ সাধল সমাজ। "এ আবার কেমন অদ্ভুত ইচ্ছে? ডাক্তারের মেয়ে, সেই পথেই চললে হত না? বন্য জীবজন্তু নিয়ে তোমার কী কারবার?" এসব প্রশ্নের কোনো যুতসই জবাব কিছুতেই খুঁজে পেতাম না, যদিও জানি, উত্তর আমার ভেতরেই আছে, তাকে ভাষায় সাজিয়ে উঠতে পারছি না।    

আরও পড়ুন

মাতৃত্বের মিথ ভেঙেছেন মহাশ্বেতা

আমার অস্তিত্বসংকট দূর করার উপায় হিসেবে আমার মা একটা নিপুণ চালাকি করত— কোনো জ্ঞানগর্ভ ভাষণ না দিয়ে, যুক্তিতর্কের মধ্যে না গিয়ে মা আমার হাতে বিশেষ বিশেষ বই ধরিয়ে দিত। সে'সময়, মা পড়তে বলল নবনীতা দেবসেন-এর ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে। ততদিনে আমি ঘুরে এসেছি অরুণাচল প্রদেশের ছবির মতো সব গ্রাম, রূপকথার গল্পের মতো তাঁদের নাম: দিরাং, কামেঙ তাওয়াং, শুনলেই মনে হয় পাহাড়ি ঝোড়ার টুংটাং বয়ে চলে সুর! বমডিলা, ভলুকপং, যেন মিয়াজাকির গল্পের কল্পনিক চরিত্র। বেরিয়ে এসে বন্ধুদের গল্প করেছিলাম, কিন্তু তাঁরা অনেকেই  ভাবে বানানো গল্প। বাঙালির ভ্রমণসঙ্গীতে তখনও পর্যন্ত অরুণাচল প্রদেশ ঢোকেনি। আমার চেনা সে সব গ্রামে একা ঘুরে বেড়িয়ে তারই গল্প লিখেছেন এক বাঙালি মহিলা, শুনে একটানে পড়লাম নবানীতার গল্প। দু-জন অসম বয়সি ‘বাইরে দূরে যায়রে উড়ে’ মনের মেয়ে আমি আর নবনীতা বন্ধু হয়ে উঠছিলাম।    

অ্যাডভেঞ্চার পিপাসু নবনীতা অসম থেকে  তাওয়াং যাওয়ার সম্ভাবনায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলে  তাঁকে শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রশ্নবাণে অতিষ্ট করে, "ওখানে  কেন যাবেন? গবেষণা? তাওয়াং-এর বৌদ্ধ মঠের পুঁথি পড়তে?",  যেমন আমায় সবাই জিজ্ঞেস করত, " জঙ্গলে কী কাজ?" 

"কোনও রেকর্ড ভাঙতে বা রেকর্ড গড়তে যাচ্ছি না। কারুর কোনও উপকারেও লাগতে যাচ্ছি না। কেবল আপন মনের খেয়াল খুশিতে, কেবলই জীবনের স্বাভাবিক কৌতূহলে, বেঁচে থাকার আহ্লাদে যেতে চাইছি— এটা কি ভ্যালিড নয়, কারণ হিসেবে? সব কিছুর জন্যেই কারণ লাগবে কেন রে বাবা! এক্সপ্ল্যানেশন লাগবে কেন! …স্রেফ উড়নচণ্ডেপনা! স্রেফ খামখেয়াল।"

ব্যাস! এই ছিল নবনীতার উত্তর, ঠিক যে উত্তরটা আমার ভিতরে দলা পাকিয়ে ছিল, কিন্তু ভাষায় প্রকাশ ছিল না, তা আমি পেয়ে এলাম!  

ওঁর লেখা বেঁচে থাকার আনন্দে ভরপুর—  সবকিছুর মধ্যে অনাবিল খুশি দেখতে পাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। নইলে কে লিখতে পারে,

"আমার জীবনে কুম্ভমেলায় যাওয়া যেমন। আবার এই তাওয়াং যাওয়াও তেমনি। পরম আশ্চর্যের, পরম পরিতৃপ্তির।"

দেখার নেশায়, নতুনকে জানার নেশায় ঘুরে বেড়াতেন নবনীতা। যার মধ্যে কিছু জাহির করার দায় নেই, কোনো উন্মাদনা নেই। কাজিরাঙার জঙ্গলে ঘাসজমির আড়ালে গণ্ডার দেখার ফাঁকে তাঁর মনে পড়ত দক্ষিণ ফ্রান্সের কামার্গ অঞ্চলে লম্বা ঘাসের আড়ালে সাদা ঘোড়ার চড়ে বেড়ানোর দৃশ্যও। অরুণাচল প্রদেশের পাহাড়ি বনাঞ্চলে হেমন্তের পাতা ঝরার রং দেখে নবানীতার মনে পড়ে মার্কিন দেশে fall colours দেখার উত্তেজনা। পেশায় তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক নবনীতা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার তুলনামূলক বিচার করে সামগ্রিক সুখের নির্যাস আস্বাদন করতে পারতেন অনায়াসে। আমি ওঁর থেকে বরাবর শিখতে চেয়েছি এমন সার্বিকভাবে ভালো থাকা।

উড়নচণ্ডী মেয়েদের জীবনে যে কোনো সিদ্ধান্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ কারণ দেখাতে হয়। (উড়নচণ্ডী না হলেও হয়, সে কথা থাক) "এমন মেয়ে কি আছে, যার পায়ের তলায় চাকা বাঁধা? যে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু বোষ্টুমী নয়। সন্ন্যাসিনী নয়, তবু অস্থির? নেহাত মধ্যবিত্ত ঘরের চাকুরে ভদ্রমহিলা, অথচ যার অস্থির বুকের ভেতরে অন্য এক বোধ কাজ করে? এক যাযাবর প্রাণবায়ু যাকে ঠেলে নিয়ে বেড়ায় অরণ্যে প্রান্তরে?" বোষ্টুমী বা সন্ন্যাসিনীর পায়ের তলায় সর্ষে মানায়, তার পেশার সঙ্গে চলনসই। এর বাইরে, মেয়েদের মধ্যে কোনো অস্থিরতা বা বাউণ্ডুলেপনা ক্ষমার অযোগ্য। অথচ, "সভ্যসমাজে ভ্যালিড হবে এমন রিজন খুঁজে বের করা" আমাদের মতো যাদের "অর্ধেক কাজকর্মের জন্যেই বেশ দুঃসাধ্য", তারা তো পড়বে ঘোর মুশকিলে। সেইসব অসন্ন্যাসী, অবোষ্টুমি ভবঘুরে মেয়েদের সহজ পথ দেখিয়েছেন নবানীতার জীবনবোধ। আপন মনের খেয়াল খুশিতে ঘুরতে ঘুরতে বলতে শিখিয়েছেন, ‘পাহাড়টা আছে, তাই উঠেছি’, তাওয়াং-টা আছে, তাই যেতে চাইছি।” এর চেয়ে সরল, অকাট্য কোনো যুক্তি আর পাওয়া যাবে না।   

আসলে, এতকিছুর জেরাজুরির কারণ সমাজ একটা বিদঘুটে বাইনারি সৃষ্টি করে রেখেছে। সংসার, অর্থাৎ ঘরে থাকবে লক্ষ্মী। এর বাইরে রয়েছে পার, যেখানে সব অলক্ষ্মীর বসবাস। "তাই ‘ঘর’ ব্যাপারটায় এত মায়া, আর পার-এর এত টান।" এই লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর বাইনারি ভেঙে নবনীতা   দেখাতে চেয়েছেন, দুয়ের মাঝখানে বসবাসকারী আরেক গোত্রের মানুষ "যারা ঘরেও নহে পারেও নহে, তাদের জন্যেই সারাটা পৃথিবী খোলা পড়ে আছে। এই ছিলুম ঘরে, এই বসেছি পারে। আর ভেতরে ভেতরে? না ঘরের, না পারের, স্রেফ পারাপারের সওয়ারি।"

আরও পড়ুন

অরুন্ধতীর অক্ষরের সরোবরে আমাদের ছায়া পড়ে

পথিকদের দেবতায় বিশ্বাস করতেন নবনীতা। সেই বিশ্বাস ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হয়েছে আমার মধ্যে। দেবতা রূপে নয়, অনেক পরে বুঝেছি নবনীতা কেন লিখেছিলেন,

"কিন্তু পথে পথে যখনই ঘুরি আমার সঙ্গে থাকেন এক পথিকদের দেবতা, যিনি সবরকমে আমাকে রক্ষা করে চলেন।"

দেশ দেখা, নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়— এসবের মধ্য দিয়ে  আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়। যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয়। বিপত্তির মুখে পড়লে প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ঝলক দেখা যায়। থাকার জায়গা নেই, নবনীতা সহজেই খুলিয়ে নিতে পারেন ইন্সপেকশান বাংলো, বিছানাপত্র জোগাড় করে সেখানে আরামে নিদ্রা যান। তাওয়াং যাওয়ার গাড়ি নেই? ট্রাকে চেপে যাত্রার ব্যবস্থা করেন। লক্ষে স্থির থাকলে লক্ষ্মী হওয়ার তোয়াক্কা না করে বুদ্ধি দিয়ে পথ চলার আনন্দ উপভোগ করা যায়। এই বিশেষ পথের খোঁজ আমি পেয়েছি নবনীতা দেবসেনের স্বভাবগত সাবলীল ভ্রমণবৃত্তান্তে। এমন নিয়ম বহির্ভূত পথচলায় কোনো যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নেই। নেই কোনো আড়ম্বর। সবটাই চলছে চিরাচরিত নিয়মের সমান্তরাল বয়ে চলা ব্যক্তিগত নিয়মে।

যেখানে অনেকগুলো নিয়মের তিরতিরে স্রোত নির্বিঘ্নে সহাবস্থান করতে পারে, নবনীতা সেই জীবনের কথা বলেন, যেমন যে কোনো পাহাড়ি পথের পাশ দিয়ে সবসময় বয়ে চলে কোনো নদী। কোন স্রোতে গা ভাসাবে তুমি, তা তোমার অন্তরের বাসনা বলে দেবে। নিজের গতিপথ বেছে নেওয়ার মধ্যে অপরের জীবনধারাকে অপমান বা ছোটো করা অপ্র‍য়োজনীয়। অপরকে সম্মান করেও, নিজের পথে চলা যায়, নিয়ম ভাঙতে নিয়মকে অবজ্ঞা করার দরকার নেই,  তাই নবনীতার বক্তব্য,

" ‘প্ল্যান’ এই শব্দটিকে আমি খুবই মান্য করি। খুব সম্ভ্রম করি। কিন্তু হায় আমার জীবনে তার ঠাঁই প্রায় নেই বললেই চলে।"

নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়া খুব দরকার। আমার কী আছে, কী চাই, এসব বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট হওয়া চাই। এমন নয় যে এইসব চাওয়া পাওয়ার কোনো পরিবর্তন হবে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবটাই পাল্টায়। যা জরুরি, তা হলো নিজের ইচ্ছে এবং তার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে স্থানকালপাত্র বিচারে পছন্দের পথ বেছে নেওয়া।

পাশাপাশি, নিজের অপারগতা সম্পর্কেও অবগতি প্রয়োজনীয়।  সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হলে যাতে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় "দি স্পিরিট ইজ উইলিং বাট দি ফ্লেশ ইজ উইক।" সবাইকে সব পারতেই হবে তার কোনো কারণ নেই, যা পারি না তা স্বীকার করতে নেই কোনো লজ্জা।

 

অপারগতা আসে গভীরের দোলাচল থেকে। ঘরের সুখ আর পারের টান, দুইই থাকে সবার মধ্যে। লক্ষ্মী হওয়ার প্রত্যাশা আর অলক্ষ্মীর হাতছানি আসে হাত ধরাধরি করে। কোনো একটাকে বেছে নেওয়া যখন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তখন জীবনতরী চেপে ঘর আর পারের মধ্যে নিরন্তর যাতায়াতই জীবনের একমাত্র নিয়ম। সত্যি সত্যি বনের পাখি কেউই নয়। নবনীতা-ও ছিলেন না। শেকল হয়ত ছিল না তাঁর পায়ে, খাঁচার পাখি তিনি নন, তবু ফিরে আসতে ভালোবাসতেন ভালোবাসার বারান্দায়, যেখানে দানাপানি বাধা আছে।   

সেই বারান্দায় একবার মুখোমুখি বসার সুযোগ হয়েছিল নবনীতা দেবসেন-এর সঙ্গে। নিজেই নিজেকে উড়নচণ্ডী বাঁউন্ডুলে বলা মানুষটি যে একই অঙ্গে কী সাবলীল লক্ষ্মী মাতৃরূপা, তা দেখেছি নিজের চোখে। একবার বলছেন কেমব্রিজ-এর গল্প, তারপরেই বলছেন দুপুরে রান্না কী হয়েছে, আজ যেন ওর কাছেই খেয়ে যাই। ফল মিষ্টি নিয়ে গেছি দেখে কপট রাগ দেখিয়ে বলছেন, খুব তো ধিঙিপনা করে বেড়াও শুনেছি, এদিকে আবার পাকা গিন্নির মতো তত্ত্ব নিয়ে উপস্থিত হয়েছ যে! লক্ষ্মী অলক্ষ্মীর সমস্ত সংজ্ঞাকে তুচ্ছ করে আমার প্রিয় সাহিত্যিক সেদিন আমার সামনে ফুটে উঠছেন একজন পরিপূর্ণা হয়ে। বনের পাখি আর খাঁচার পাখির দোটানা তো আপেক্ষিক, এই দ্বিচারিতায় বহিরঙ্গে। অন্তরে সবাই জানে, বনের পাখিরাও বাসা বাঁধে। অলক্ষ্মীও লক্ষ্মীমন্ত মায়ায় জড়ায়। এক এক করে ঘরের মায়া ছেড়ে পারের দিকে বসতে গিয়ে দেখে, ছাড়তে আর পারল কই! ক্রমশই জড়িয়ে পড়েছে বাইরে দূরের মায়ায়। পার-ই তখন তার ঘর, ঘর হয়ে গেছে দূরের কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আসা পার। 

লক্ষ্মী- অলক্ষ্মী, এই বৈপরিত্যের মধ্যাঞ্চলে পালা করে পরিক্রমণ চলতেই থাকে। অপরাধবোধহীন, অনন্ত এই পারাপারের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন নবনীতা দেবসেন।

More Articles