লক্ষ্মীমেয়ের প্রতিমূর্তিকে চ্যালেঞ্জ করেন অমৃতা শেরগিল

Amrita Sher-Gil: অমৃতা সেইযুগে নিজেকে ঘোষণা করলেন নিরীশ্বরবাদী হিসাবে। ফলে তাকে বহিষ্কার করা হয় ‘কনভেন্ট অব জিসাস এন্ড মেরি’ স্কুল থেকে। অমৃতা সবক’টি অর্থেই সেইযুগের ‘কেয়াবাৎ-মেয়ে’।

“I am an individualist, evolving a new technique, which, through not necessarily Indian in the traditional sense of the word, will yet be fundamentally Indian in spirit.”
Sher-Gill: Art and Life: A Reader, Yashodhara Dalmia

লক্ষ্মীপুজোয় নারীবাদী আখ্যান একেবারেই লিখব না, কথা দিয়েছিলাম। ভাগ্যিশ অমৃতা নিজেই নিজেকে ঘোষণা করেছেন ‘ব্যক্তিবাদী’ হিসাবে। যে যুগে অধিকাংশ মেয়েরা সাঁজ-সেঁজুতির ব্রত নিচ্ছে, ‘হাসতে হাসতে’মেনে নিচ্ছে সংসারের যাবতীয় অনাচার; অমৃতা সেইযুগে নিজেকে ঘোষণা করলেন নিরীশ্বরবাদী হিসাবে। ফলে তাকে বহিষ্কার করা হয় ‘কনভেন্ট অব জিসাস এন্ড মেরি’ স্কুল থেকে। অমৃতা সবক’টি অর্থেই সেইযুগের ‘কেয়াবাৎ-মেয়ে’।

শ্রীপান্থর কথায় “কেয়াবাৎ-মেয়ের সঙ্গে আমাদের প্রথম যখন দেখা হয় তখন সে সেজেগুজে দাওয়ায় মোড়ার উপর বসে আছে। হাতে একখানি চিঠি। বিড়বিড় করে সে বলছে– ‘আহা, বাগবাজারের রসগোল্লার ন্যায় তাঁর পত্রখানি রসে চোবানো, বোধহয় পত্রখানি নিংড়ালে টসটস রস পড়ে’।” 

Amrita Sher-Gil

অমৃতা শেরগিল

১৯১৩ সালে বুদাপেস্টে এক উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মান অমৃতা। তাঁর বাবা উমরাও সিং শের-গিল পাঞ্জাবি অভিজাত ও মা মারি আঁটোনেট হাঙ্গেরীয়-ইহুদি, পেশায় অপেরা গায়িকা। হাঙ্গেরিয়ান মা এবং শিখ পিতা– দুই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বেড়ে ওঠেন অমৃতা। তাঁর যে ছবিটি এখনও সবেচেয়ে অবাক করে তা হলো– ‘Bride’s Toilet’। নগ্ন নারী শরীরের এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তৎকালীন ভারতীয় সমাজরীতির জন্য গভীর চ্যালেঞ্জ। সতীলক্ষ্মী আদর্শ– যেখানে নারীকে ‘শরীরবিহীন’ বা ‘পবিত্র’ মনে করা হয়, সেখানে অমৃতা শরীরকে তার পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে তুলে ধরেন। যা লজ্জা বা গোপনীয়তার বস্তু হয়ে থাকে না।

Bride's Toilet, Painting by Amrita shergil

‘Bride's Toilet’ (অমৃতা শেরগিলের বিখ্যাত পেইন্টিং)

অমৃতার ছবির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো– নারীর ব্যক্তিগত মুহূর্তের স্বাভাবিক উদযাপন। তার আঁকা বেশিরভাগ ছবিই সেই সময়ের সমাজবোধ, নারীত্ববোধ ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের বিরুদ্ধে প্রতীকী আঘাতের চিহ্ন। ভারতীয় নারীত্বের প্রচলিত ছাঁচ, ‘লক্ষ্মী’ প্রতিমার আদর্শ নারী রূপ– যাকে সমাজ ‘শুদ্ধ’, ‘বিনয়ী’, ‘ত্যাগী’ ও ‘পরিপূর্ণ গৃহিণী’ হিসেবে কল্পনা করে– তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি পরাধীন ভারতেই গড়ে তোলেন এক শিল্পজীবি স্বাধীন সত্তা। 

আরও পড়ুন- গারদের ফাঁক থেকেই মুক্তির স্বপ্ন দেখান নার্গিসেরা

বঙ্গলক্ষ্মীর অবয়বে এক নারীকে চিত্রিত করা হয় গৃহকেন্দ্রিক, বিনয়ী ও ত্যাগের প্রতীক হিসেবে। এই নির্মাণ বহুযুগ ধরে এমন এক কাঠামো দাঁড় করায়, যেখানে নারীর স্বাধীন যৌনইচ্ছা, শিল্পচর্চা, ভিন্নমত বা আত্মপ্রকাশকে ‘বে-আচরণ’ হিসেবে দেখা হয়। নারীশরীর, একাকীত্ব ও ইচ্ছা– যা এতদিন পুরুষ শিল্পীদের চোখে হয় ছিল অনুপস্থিত বা ছিল মূর্ত যৌনতার মিডিয়ম হিসেবে, অমৃতার হাতে তা হয়ে উঠেছিল নারীর আত্মপ্রকাশের বলিষ্ঠ ভঙ্গি।

Amrita Shergil

অমৃতা শেরগিল

আট বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে শিমলায় চলে আসেন অমৃতা। এখানেই অমৃতার মা মেরির এক ইতালিয় ভাস্করের সঙ্গে আলাপ হয়। ষোলো বছর বয়সে আবার মায়ের সঙ্গে প্যারিসে যাওয়া। ছবি আঁকা শিখবেন বলে। প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ‘Académie de la Grande Chaumière’-এ, পিয়ের ভাইয়াঁ আর লুসিয়েন সিমনের অধীনে। সেখানেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয় শিল্পী-বন্ধু বরিস তাসলিৎসকির সঙ্গে। এর পরের পড়াশোনা ‘École des Beaux-Arts’-এ। এইসময়ই সেজান, গগাঁ, মদিলিয়নির আঁকার ভঙ্গিমা ও রঙের ব্যবহার তার মনে গভীর ছাপ ফেলে। তাঁর আঁকা প্রথম দিকের ছবিগুলোয় স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট স্টাইল। প্যারিসের বোহেমিয়ান শিল্পীমহলে তত্ত্বে ও তর্কে, রংতুলিতে সব মিলিয়ে যেন এক অন্য জগতে ডুবে থাকতেন অমৃতা। ১৯৩২ সালে অমৃতার আঁকা তৈলচিত্র– ‘Young Girls’ তাঁকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। এই ছবির জন্য তিনি স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন এবং প্যারিসের ‘Grand Salon’-এ অ্যাসোসিয়েট নির্বাচিত সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তিনি, এবং একমাত্র এশীয়, যিনি এই সম্মান পান। তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিগুলিতে তিনি নিজেকে মেলেছেন বহু রঙে, নানা মেজাজে। কখনও গম্ভীর, কখনও চিন্তাশীল, আবার কখনও আনন্দে।

আরও পড়ুন- বিচারের বাণী লেখে শাসকই! মনে পড়ে চুনী কোটালকে?

অমৃতার জীবনযাপন ছিল সব দিক থেকে প্রচলিত নারী আদর্শের বিপরীতে। ইউরোপীয় শিক্ষা, শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ, বহু পুরুষ ও নারীসঙ্গ– এই সবকিছুই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে চর্চার বিষয় করে তুলেছিল। সেসময়েই তিনি ‘সাহসী পোশাক’, বাচনভঙ্গি ও যৌনচিন্তার বলিষ্ঠ প্রকাশে বিশ্বাসী ছিলেন। লিখেছিলেন–

“It is only by becoming a slave to one’s art that one can be truly free.”

অমৃতা আসলে বোঝাতে চেয়েছিলেন, নারীর স্বরূপের প্রকাশ আসলে আত্মনির্মাণের চর্চায়, বাহ্যিক অনুমোদনে নয়। তাঁর আঁকা নারীসত্তাগুলি কখনও ক্লান্ত, কখনও বিমর্ষ, কখনও আত্মনিমগ্ন– সুঠাম-সুতন্বী অথচ পুরুষদৃষ্টির ভোগ্যবস্তু নয়। ‘Three Girls’ ছবিতে তিনজন গ্রামীণ তরুণীর মুখে যে নিঃশব্দ বেদনার ছাপ, তা কোনও সাজ-সজ্জার মাধ্যমে নয় বরং অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতার প্রকাশ। এই নারীরা ‘লক্ষ্মী’ রূপে গৃহে আবদ্ধ নয়, তারা বাইরে তাকিয়ে থাকা, নিজেদের চিন্তা করা এবং সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ করা নারীবিদেহ। সঙ্গিনী মারি লুইস’কে নিয়েও রয়েছে তাঁর বিখ্যাত চিত্র- ‘Two Women’। তিনি লিখেছিলেন–

“There is nothing reprehensible in the nude. It is a perfectly natural phenomenon, and if we consider it so in real life, why not in art”?

২৫ বছর বয়সে অমৃতা বিবাহ করেন তুতো হাঙ্গেরিয়ান ভাই ভিক্টর ইগান’কে এবং ভারতে ফিরে এসে গোরখপুরে তাঁদের পৈতৃক বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। এ'সময় তিনি বিশেষভাবে পরিচিত হন ‘বেঙ্গল স্কুল অব আর্টের’ সঙ্গে। অনেকেই অমৃতার আঁকার সঙ্গে তুলনা টানেন অবনীন্দ্রনাথের কাজে ‘কিয়ারোস্কিউরো’ অর্থাৎ আলো এবং অন্ধকারের ব্যবহারের, কিংবা রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীপ্রতিকৃতি-র সঙ্গে।

Amrita Sher-Gil

অমৃতা শেরগিল

এই পর্বে অমৃতা আঁকেন ‘Village Scene’, ‘In the Ladies Enclosure’ আর ‘Siesta’– এই তিনটি বিখ্যাত ছবি যেখানে দেখা যায় ভারতের গ্রাম্যজীবনের ধীর-মন্থর ছন্দ। পরিবার ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকলেও, অমৃতা ছিলেন কংগ্রেসপন্থী। তাঁর রূপ ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুও। ১৯৪০ সালে নেহরু যখন গোরখপুরে যান, অমৃতার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। দু’জনের মধ্যে চলেছিল চিঠিপত্র চালাচালিও। পরবর্তীতে সেই চিঠি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অমৃতা নেহরুর কোনো পোর্ট্রেট আঁকেননি কখনোই, কারণ তাঁর মতে নেহরু ছিলেন ‘অত্যন্ত বেশি সুদর্শন’!

যদিও অমৃতার শিল্প প্রশিক্ষণ হয়েছিল ইউরোপীয় ঘরানায়, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীলতা শিকড় খুঁজে পায় ভারতীয় গ্রামীণ সমাজে, সেখানকার মানুষের মুখাবয়বে, নারীর নিঃশব্দ দৃষ্টিতে। পশ্চিমা রীতির অন্ধ অনুকরণ তিনি করেননি, বরং ভারতীয় বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে এক নতুন শিল্পভাষা গড়ে তোলেন। তাঁর শিল্পে বিভিন্ন ইউরোপীয় শিল্পীর প্রভাব থাকলেও, ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’-এর পর যে চিত্রভাষা গড়ে ওঠে, তা ভারতীয় চিত্রশিল্পে এক আধুনিকবোধের প্রকাশ। এই দ্বৈত সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রশ্নে অবিচল এক সেতু। কেবল শিল্পেই নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে এক লক্ষ্মী মেয়ের প্রতিমূর্তিকে বারবার প্রশ্ন করেছেন তিনি।

বঙ্গদেশে লক্ষ্মীদেবী আসলে ‘শ্রী-লক্ষ্মী’ বা ‘ধান্যলক্ষ্মী’ রূপে পূজিতা হন। নিরন্তর সারস্বত সাধনায় যে ‘শ্রী’ লাভ হয়, সেই ‘লক্ষ্য’-জাত ফল। কিন্তু আবার ভালো মেয়ের নিগড় ডিঙিয়ে 'মা লক্ষ্মী' নিজে নিশাচরী। উত্তরভারতীয় কনক-মোহর সজ্জিত ঘটের ওপর আসীন না হয়ে তাঁর প্রকাশ হয় ধানের ছড়ায়, পটের কাজে, গৃহস্থ বাড়ির দাওয়ায়। পদ্মপত্রে সুধালাভ হয়নি অমৃতার কিন্তু তাঁর সুঠাম নারী অবয়বের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন স্বয়ং আনন্দ। জলভিক্ষায়। সেই জীবনবারির জন্যই প্রতিনিয়ত ছাঁচ ভেঙেছেন অমৃতা। তাই তিনি শুধুমাত্র একজন প্রতিভাবান শিল্পী নন, বরং এক সাংস্কৃতিক ও লিঙ্গ-রাজনীতির বিপ্লবের প্রতীক। তাঁর শিল্প ‘মেয়েমানুষের’ অভ্যন্তরীণ দুনিয়া, নিঃসঙ্গতা, ক্লান্তি ও বাসনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। অমৃতাময়ী নারী সুধা বেলাতে পৃথিবীতে আসেননি; আত্মপ্রেমে তাঁর সর্বাঙ্গ ভাস্বর। নিওলিব্যারাল ‘সেল্ফ-কেয়ার’-এর গিমিক আসার বহু পূর্বেই অমৃতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নারীর আত্মপ্রেম। এই অসামান্য অবস্থানই তাঁকে করে তুলেছিল নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির এক অবিছেদ্য অঙ্গ, যাঁর শিল্প আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তার ছবির নারীচরিত্ররা কখনোই পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকা ‘সাজানো লক্ষ্মী’ নয়। তারা গাঢ়, আত্মবিশ্বাসী, এবং প্রায়শই একা– তাদের কোনো পুরুষ রক্ষক নেই, কিংবা প্রয়োজনও পড়েনি। অমৃতা বুঝিয়ে গিয়েছিলেন– “I paint because I must.”

More Articles