আইন বইয়ের ফুটনোট হয়ে থেকে যাবেন ভাঁওরি দেবী?
Bhanwari Devi: প্রথমে রাজস্থান সরকার এবং কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে কর্মরতা নারীর সুরক্ষা দাবি করা হয় ভাঁওরি দেবীর ঘটনাকে সামনে রেখে। সেখান থেকেই ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলা, আর অবশেষে ‘বিশাখা...
১
The modern hero is not a Prometheus but a Prufrock.
-Harry Levin
‘হ্যালো, ভাঁওরি দেবী আপকে গাঁও মে রহতে হ্যায়? আপ উনহিকে গাঁও-সে হো না?’ (ভাঁওরি দেবী আপনার গাঁয়ে থাকেন? আপনি সেই গাঁয়েরই লোক তো?)
‘দো ইয়া তিন ভাঁওরি দেবী হ্যায় হামারে ইঁয়াহা। কৌন সি?’ (তিন চার জন ভাঁওরি দেবী আছেন এখানে। কোন জনকে চায়?)
অথচ আমি ভেবেছিলাম ভাঁওরি একমেবদ্বিতীয়ম। সেই যিনি প্রমিথিউস, ভগীরথ— আগুন আনেন, কিংবা গঙ্গা… নতুনের দূত ভাবতেই পুরাণ ফুঁড়ে ছেলেদের নাম মাথায় আসে যে কারণে, সে কারণেই ভাতেরি গাঁয়ের পঞ্চায়েত প্রধান আমায় শুধোলেন— ‘কোন ভাঁওরিকে চান?’
অবাক হই না, কারণ দু মিনিট আগে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। ফোন করেছিলাম রাজস্থান প্রেস ক্লাবে। ভাঁওরি দেবীকে নিয়ে বহু আগে স্টোরি করেছেন, কলকাতার এমন একজন সাংবাদিক বলেছিলেন, তিনি ফোন নম্বরটি হারিয়ে ফেলেছেন। তবে আমি চাইলে রাজস্থান প্রেস ক্লাবে একবার খোঁজ নিতে পারি। প্রেস ক্লাবের সেক্রেটারি বললেন, ‘উও কৌন হ্যায়?’ বিনীতভাবে ১৯৯২ সালের কুখ্যাত একটি ধর্ষণের ঘটনা মনে করাতে শুরু করি ভাঙা হিন্দিতে। আধেক শুনে তিনি থামান।
‘হাঁ, বহুত বড়া কান্ড্ হুয়া থা! পর্ নাম্বার তো আব নহি হ্যায়!’ (হ্যাঁ, বিরাট কান্ড হয়েছিল বটে। কিন্তু এখন তো নম্বর নেই।)
‘বহুত বড়া কান্ড্’-এর কথা যখন বলেন, তখন বোঝা যায়, ঘটনার কথা তাঁর আদৌ মনে পড়েনি। অতঃপর আন্তর্জালে ভাতেরি গাঁয়ের পঞ্চায়েতের নম্বর খোঁজা। সরাসরি প্রধানের সঙ্গে কথা।
আরও পড়ুন- ঘুরে ঘুরে সাবান বিক্রি থেকে বিবাহবিচ্ছেদ: মহাশ্বেতা দেবীর জীবনে ছিল নানা চড়াই-উতরাই
ভাঁওরি দেবী সংবাদপত্র থেকে সরে গেছেন অনেক দিন। ‘বিশাখা গাইডলাইনের’ নাম ‘ভাঁওরি গাইডলাইন’ হলে কি তাঁকে মনে রাখা হতো? বিশাখা-সহ নানা এনজিও তাঁকে খাড়া করেই কর্মক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষা দাবি করেছিল সুপ্রিম কোর্টের কাছে। রাজা ভেবে শুরু করেছিলাম, ক্রমশ ভাঁওরি দেবীকে দাবার বোর্ডের বোড়ে মাত্র মনে হয়। কিন্তু আধুনিক সময়ের হিরো অনন্য সাধারণ হবেনই বা কেন? বোড়েদের টিকে থাকার আশ্চর্য স্থৈর্য ও সাহস নিয়েই আধুনিক সব মহাকাব্য রচিত হয় না কি?
পঞ্চায়েত-প্রধান দুটো নম্বর দেন। ভাতেরির দুই ভাঁওরির। প্রথম জনের বয়স পঁয়ত্রিশ। বোঝা যায়, তিনি সেই ঐতিহাসিক ভাঁওরি নয়। দ্বিতীয় নম্বরটি গিয়ে পৌঁছয় জনৈক অংশুলের কাছে। অংশুলের বয়স কুড়ির কোঠায়। সে বিশাখা গাউডলাইন-খ্যাত ভাঁওরি দেবীর নাতি। এখন জয়পুরে থাকে। সে যখন আমায় ভাঁওরির নম্বর পাঠায়, দেখি ভাঁওরির নয়, অংশুলের ফোনে সেভ করা ছিল তার আদরের ‘বড়ি মাম্মি'-র নাম্বার। ‘বড়ি মাম্মির’ শরীর ভেঙে পড়েছে। তবু গ্রামেই থাকেন জেদ ধরে। অংশুল স্বাস্থ্যকর্মী মায়ের সঙ্গে জয়পুরে থাকে। বাবা যাতায়াত করেন ভাতেরি-জয়পুর।
মিথ আর বাস্তবের মধ্যে দোল খাই। সেই ভাঁওরি, যিনি নীরজা ভানোত মেমোরিয়াল পুরস্কার পেয়েছেন অদম্য সাহসের স্বীকৃতি হিসেবে। যিনি এককালে রাষ্ট্রসংঘের চতুর্থ নারী সম্মেলনে ডাক পেয়েছিলেন বেজিং-এ। তিনি পেট খারাপে ভুগছেন। হবেই তো, ভাতেরি গ্রামে ফের জলের সমস্যা দেখা দিয়েছে, অংশুল বলে। অংশুলের বাবা মুকেশ গেছেন অংশুলের বড়ি আম্মিকে দেখতে। ভাতেরিতেই আছেন। ফোন করতে মুকেশই ধরেন। অশক্ত, রোগক্লান্ত বৃদ্ধা ঘুমিয়ে পড়েছেন।
আরও পড়ুন- পরিসংখ্যান বনাম বাস্তব: মেয়েদের জন্য কতটা নিরাপদ কলকাতা শহর?
২
A slut is someone, usually a woman, who’s stepped outside of the very narrow lane that good girls are supposed to stay within. Sluts are loud. We’re messy. We don’t behave.
-Jaclyn Friedman
উইলিয়াম ডালরিম্পল যখন ভাঁওরি দেবীর গ্রামে ঢুকছিলেন, তখন স্থানীয় লোকজন বলেছিল, ‘ও একটা বেশ্যা (ডালরিম্পিলের অনুবাদে ‘স্লাট’), একটা মিথ্যুক, ওর কোনো কথায় বিশ্বাস করবেন না।’ যারা বলেছিল, তারা হুঁকো হাতে বয়স্ক গুজ্জর। লেখক আশা করেছিলেন, হয়তো ভাঁওরির নিজের জাতভাইরা তাঁর পক্ষে আছে। ভুল ভেবেছিলেন। নিজের পাড়ায় ‘কুমহার’(কুমোর) জাতও তাঁদের একঘরে করেছিল। (সূত্র: ‘দ্য স্যাড টেইল অফ ভাঁওরি দেবী’ অধ্যায়, ‘দ্য এজ অফ কালী’ বই থেকে)
ভাঁওরি কি চিরকালই অসমসাহসী? ভীষণ প্রতিবাদী? ডালরিম্পলকে ভাঁওরি বলেন, সে'বছর রাজস্থান বাল্যবিবাহে পয়লা নম্বরে উঠে এসেছিল। সরকার ক্ষেপে উঠেছিল। গোপনে সাথিনদের খবর দিতে বলা হয়েছিল বাল্যবিবাহের খবর পেলে। ভাঁওরি আর কী করত? ভাঁওরির উপায় ছিল না।
ঘটনাটা ১৯৯২ সালের। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ভাঁওরি দেবী রাজস্থান সরকারের নারী উন্নয়ন প্রকল্পে আড়াইশো টাকা মাসমাইনের ‘সাথিন’। তাঁর কাজ ছিল গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে মহিলাদের (সেই সূত্রে পুরুষদেরও) বোঝানো যে বাল্যবিবাহ মন্দ, গ্রামে উপযুক্ত শৌচ-ব্যবস্থা চাই, মেয়েদের অধিকারটুকু বুঝে নিতে হবে ইত্যাদি। প্রথম দিকে তাঁদের গৃহস্থরা খাতির করত। পরে সাথিন-রাই গ্রামবাসীর চোখে হয়ে গেল সরকারের চর। ঐ যে সরকার মুখ বাঁচাতে ‘ধর তক্তা মার পেরেক নীতি’ শুরু করেছিল— জোরাজুরি, ধরপাকড় চলছিল— তার ফল ভুগছিল সম্মুখ সমরের সৈনিকরা। ভাঁওরিরা আপত্তি করেছিলেন। বলেছিলেন, এসব দীর্ঘমেয়াদি সচেতনতা প্রসারের কাজ এত তাড়াহুড়ো করে হয় না। তাতে উল্টে বিপদ হতে পারে। তখনও ভাঁওরি ‘সমাজ’ বুঝতেন। রীতি-রেওয়াজ, গণ্ডির তাৎপর্য জানতেন। তখনও তিনি মোহনলালের লক্ষ্মীমন্ত বউ। নিজের দেওরের বিয়ে আটকাতে গিয়ে গঞ্জনা শোনেন, তবু তো বাড়ির বউ! তারপর কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল!
আরও পড়ুন- সংবিধানের দলিত, দলিতের সংবিধান: একটি বোঝাপড়া
‘আখা তিজ’, মানে অক্ষয়তৃতীয়া তিথিতে রাজস্থানের গ্রামে গ্রামে সে সময় ব্যাপক হারে বাল্যবিবাহ হতো। খবর এল, ভাতেরির বদ্রি গুজ্জরের বাড়িতে হবে জোড়া বিয়ে। এক মেয়ের বয়স চোদ্দ, অন্যজনের মাত্র এক। ভাঁওরি ঘোড়া ছুটিয়ে নাবালিকা উদ্ধারে যাননি। বরং দু-দুবার বদ্রি গুজ্জরের কাছে কাকুতি-মিনতি করেছিলেন। বলেছিলেন, এক বছরের মেয়ের বিয়েটা অন্তত বন্ধ থাকুক। একে মেয়েমানুষ, তার উপর নিচুজাত। বদ্রি গুজ্জর প্রথমবার ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলেনি। মণ্ডপ বাঁধা শুরু হতে যখন ভাঁওরি দ্বিতীয়বার অনুরোধ করতে গেলেন, তখন বদ্রি বলেছিল, ‘বিয়ে আটকানো আর সম্ভব নয়। আমার কথার দাম আছে। কথা দিয়েছি মানে বিয়ে হবেই।’ গুজ্জররা আরও বলেছিল, মেয়েদের সব আলাদা আলাদা করে বিয়ে দেওয়ার অনেক খরচ। এক মণ্ডপে যতজনের বিয়ে হয়ে যায়, তত ভাল, তত সাশ্রয়।
অগত্যা ভাঁওরি দফতরে খবর দেন। খবর যায় জেলা আধিকারিকের কাছে। তিনি পুলিশ পাঠান বিয়ে আটকাতে। গুজ্জর জাতিরই দুই পুলিশ। শিশুর বিয়ে সাময়িক ভাবে থামল, তারপর সেই বিয়ে হল পুলিশের সামনেই। পুলিশ লাড্ডুও খেল। কিন্তু এই যে বিবাহ বাসরে অক্ষয় তৃতীয়ার শুভ লগ্নে পুলিশ এল, এতে বদ্রি গুজ্জর ও তার আত্মীয়-স্বজন ভারি বে-ইজ্জত বোধ করল। সেদিন ভরা সভায় বদ্রি গুজ্জর ঘোষণা করেছিল, নিচু জাতের মেয়ের এই স্পর্ধার বদলা সে নেবে।
১৯৯২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। ওরা পাঁচজন এসেছিল। পশুর খাবার সংগ্রহ করে ভাঁওরি বাড়ি ফিরতেই দেখেছিলেন, এক ব্রাহ্মণ আর চার গুজ্জর মিলে তাঁর বর মোহনকে বেধড়ক পিটছে। তিনি চেঁচিয়ে বলেছিলেন তাঁর ঝাল তাঁর বরের উপর না ঝাড়তে। তাছাড়া তিনি-ই বা কী করতেন? তিনি তো পুলিশ নিয়ে যাননি! পুলিশ পাঠিয়েছিলেন জেলা আধিকারিক। তাঁর কাছে গুজ্জররা জবাবদিহি চাইছে না কেন?
উত্তরে বদ্রি গুজ্জর তাঁর দিকে এগিয়ে এসেছিল। অন্য দুজন তাঁর বরকে দুই দিক থেকে চেপে ধরেছিল, যাতে তিনি ভাঁওরির ধর্ষণে বাধা না দিতে পারেন, কিন্তু তা দেখতে বাধ্য হন।
বদ্রি, বদ্রির ছেলে, বদ্রির ভাইপো, বদ্রির শ্যালক, এবং গ্রামের পুরোহিত— এই পাঁচ আগন্তুকের মধ্যে অন্তত তিনজন ভাঁওরিকে ধর্ষণ করেছিল বলে অভিযোগ। ভাঁওরির ভীরু লক্ষ্মীজীবনের এইখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। পরের কাহিনী ভারি অ-লক্ষ্মীমন্ত।
৩
Leaving behind nights of terror and fear
I rise
Into a daybreak that's wondrously clear
I rise
Bringing the gifts that my ancestors gave,
I am the dream and the hope of the slave. I rise
I rise
I rise.-Maya Angelou
চেপে যেতে পারতেন ভাঁওরি। মেনে নিতে পারতেন। বর্ণবাদ-অধ্যুষিত গ্রামে এমন ঘটনা আকছার ঘটে। কিন্তু লজ্জা লুকিয়ে রাখার, কান্না গিলে ফেলার আখ্যান উলটে দেন তিনি। পরদিন জয়পুরে দৌড়ে যান নারী উন্নয়ন প্রকল্পের দিদিদের সাহায্য নিতে। থানা তাঁকে ঘোরাতে থাকে বারবার। পরে অবশ্য বোঝা গিয়েছিল, তারা ঠিক সময়ে মেডিক্যাল টেস্ট সম্পন্ন করা আটকাতে চেয়েছিল। সে কারণেই রিপোর্ট নিতে দেরি করছিল। ভাঁওরি বলেন, ছোট জাতের মেয়ের কথা শোনা হবে না, এমনটা তিনি আশাই করেছিলেন। কিন্তু যতটা অপদস্থ বাস্তবে থানায় হতে হয়েছিল, ততটা ভাবেননি। এমন অপমান করাই হয় যাতে লজ্জায় নিগৃহীতা অভিযোগ না করে, স্রেফ পালায়। কিন্তু যত বেড়েছে অপমানের মাত্রা, তত বেড়েছে তাঁর জেদ। সমুদ্র মন্থনে লক্ষ্মী উঠেছিলেন। আর লজ্জা-পোড়া ছাইয়ের গাদা মন্থন করলে, অলক্ষ্মী উঠে আসেন।
অভিযোগ দায়ের হলো শেষ পর্যন্ত। থানা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র সহযোগিতা করছে না দেখে এরপর তিনি গেলেন আদালতে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশের চার্জশিট দিতে এক বছর লেগেছিল। জেলা ও দায়রা আদালতেও একই পিতৃতান্ত্রিক ঘিনঘিনে প্রশ্নমালা। তিন বছর ধরে চলা মামলায় বিচারক পাল্টেছিল ছ’বার। প্রথম বিচারক মেনে নিয়েছিলেন, গণধর্ষণ হয়েছিল। ১৯৯৫-এর ২৫ নভেম্বর ষষ্ঠ বিচারকেরর রায়ে প্রমাণহীনতার কারণে খালাস পেয়েছিল পাঁচ অভিযুক্তের প্রত্যেকে। ভাঁওরি এর পরেও হাই কোর্টে গেছেন। এতগুলো বছর পেরিয়েছে তারপর। তাঁর হাইকোর্টের মামলার শুনানি হয়েছে মাত্র একবার।
নব্বইয়ের দশক জুড়ে ভাঁওরি পাশে পেয়েছেন জয়পুর ও দিল্লির নারী সংগঠনগুলিকে। তাঁর মামলার সূত্রেই ১৯৯৭-এ তৈরি হয়েছে যৌন হয়রানির মোকাবিলায় ‘বিশাখা গাইডলাইনস’। প্রথমে রাজস্থান সরকার এবং কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে কর্মরতা নারীর সুরক্ষা দাবি করা হয় ভাঁওরি দেবীর ঘটনাকে সামনে রেখে। সেখান থেকেই ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে মামলা, আর অবশেষে ‘বিশাখা গাইডলাইন’-এর যুগান্তকারী রায়। পরে ২০১৩ সালে তা থেকে হয়েছে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি বিরোধী আইন (পশ আইন, POSH Act)।
কী আছে এই গাইড লাইনে? তিনটি বিষয়ের উপর স্পষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে। নিষেধ (প্রহিবিশন), প্রতিরোধ (প্রিভেনশন) এবং প্রতিকার (রিড্রেস)। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকায় বলা রয়েছে, অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে। যৌন হেনস্থার আওতায় কী কী পড়বে তাও বলা হয়েছে এই নির্দেশিকায়। শারীরিক ছোঁয়া এবং তার থেকে বেশি অবাঞ্ছিত আচরণ, যৌনতার দাবি, যৌন মন্তব্য, পর্নোগ্রাফি দেখতে বাধ্য করা, যে কোনও মৌখিক, শারীরিক, আচরণগত যৌন হেনস্থা, মহিলার যৌন জীবন নিয়ে বারবার প্রশ্ন বা মন্তব্য করা, আপত্তিজনক যৌনতাপূর্ণ এমএমএস, ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ছবি কিংবা পোস্টার দেখানো, যৌন পক্ষপাত দাবি করে কোনো মন্তব্য করা, হুমকি দেওয়া, প্রতিবাদ করলে তার উদ্দেশ্যে যৌন মন্তব্য করা ইত্যাদির পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রের পরিসরে ফ্লার্টিং বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে। কেবল শারীরিক নয়, মানসিকভাবে নির্যাতিত হলেও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব।
২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী দশ কিংবা তার বেশি সংখ্যক কর্মী রয়েছে এমন সংস্থায় নিয়োগকর্তার ইন্টার্নাল কমপ্লেইন্টস কমিটি বা আইসিসি গঠন করা বাধ্যতামূলক। এই আইনের আওতায় পড়বে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ। একসময় বিশাখা গাইডলাইনে শুধুমাত্র চাকুরিরতা মহিলাদেরই উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির লড়াইয়ের মাধ্যমে যুক্ত হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মহিলাদের সমস্যাও। সুতরাং যাঁরা মাঠে-ঘাটে, ইটভাটায় বা নির্মাণ শিল্পে, রাস্তা তৈরিতে কাজ করে থাকেন, দিনমজুরি করেন, তাঁরাও বিশাখা গাইডলাইনের আওতায়। তাঁদের জন্য গঠন করার কথা এলসিসি। শুধু মহিলা কর্মীরাই নন, বিশেষ কোনও কাজে সংস্থায় এসেছেন এমন মহিলাও এই আইনের আওতায় পড়েন।
৪
The individual is at once the focus and the fragment: consciousness is broken into moments, into voices, into quotations.
-T.S. Eliot
নব্বই দশকের পর ভাঁওরি আস্তে আস্তে বিস্মৃতিতে তলিয়েছেন। দ্রুতগামী সময় খুঁড়ে আমরা ভাঁওরি দেবীকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করেছি মাঝে মাঝে। যেমন, পশ আইন পাশ হওয়ার পর (২০১৩) আবার ভাঁওরি খবর হলেন এই মর্মে— এই সেই অনিন্দ্যসুন্দর সাহসিনী, যিনি রুখে দাঁড়ানোয় আমরা আজ এই আইন পেলাম। আবার ২০১৭-২০১৮ সালে যখন উঠল #মি-টু ঝড়, তখন ভাঁওরি দেবীর স্মৃতিচারণ করলেন কেউ কেউ। তারপর আবার চুপচাপ।
২০২৪ সালে যখন কলকাতায় রাতদখল আন্দোলন শুরু হলো, তখন আমরা আবার মুখর হলাম কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের, প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষদের নিরাপত্তা নিয়ে। তখন আমাদের আলাপচারিতায় আবার উঠে এলেন ভাঁওরি। সেই সূত্রেই আমার তাঁকে ফোন করা।
আরও পড়ুন- গারদের ফাঁক থেকেই মুক্তির স্বপ্ন দেখান নার্গিসেরা
কিন্তু ভাঁওরি তো একটা গোটা মানুষ। তিনি নারীবাদ বা আইন ক্লাসের পাঠক্রমের কতগুলো পাতা নন। ভাঁওরি যেমন তা নন, তেমনই মথুরাও তা নন। দুজনেই তাঁরা পরিপূর্ণ মানবী। দুজনেই প্রান্তিক, দুজনেই তথাকথিত শিক্ষিত নন, নারীবাদে তথাকথিত দীক্ষা তাঁদের নেই, ইংরেজি জানেন না। দুজনেই নির্যাতিত। দুজনের দুর্ভাগ্যই নারীদের অধিকার আন্দোলনকে মজবুত করেছে। (কী আয়রনি!) এঁরা হলেন সেরকম নির্যাতিতা, যাঁদের হয় ভুলে যাওয়াই দস্তুর, নয় যাঁরা আইন বইয়ের ফুটনোট হয়ে যান।
আজ আমরা ধর্ষিতার নাম উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকি। কিন্তু সত্তরের দশকে মথুরাকে ‘মথুরা’ নামেই ডাকা হত সংবাদমাধ্যমে। সেই আদিবাসী মেয়ে মথুরা, যাঁর ধর্ষণ ও পুনঃধর্ষণ দেশের বিবেককে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তিনি, যদ্দূর জানি, ২০২২ সালেও বেঁচে ছিলেন— কিন্তু এফিডেফিট-সিদ্ধ এক অন্য নামে। ‘দ্য প্রিন্ট’-এর যে প্রতিবেদনে তাঁর কথা পড়েছিলাম, সেখানে সেই অন্য নামটি ছাপা হয়নি। তিনি বলেছিলেন, তাঁর মৃত স্বামী বা পুত্ররা তাঁর ধর্ষণের কথা জানেনই না। সেই প্রখ্যাত মথুরা! ভাঁওরি দেবী অন্তত ভাঁওরি নামেই পরিচিত থেকেছেন আজীবন। এ-ও কি কম দুঃসাহস?
ভাঁওরি দেবীর সঙ্গে কথা হয়েছিল কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা, পশ আইন এবং আর জি কর— নানা বিষয়ে। তিনি বলেছিলেন, আর জি করের কথা তিনি শুনেছেন। টিভি-তে দেখেছেন। বলেছিলেন, ‘কানুন আ তো গয়া। জিন্দগি নিকল গয়ি। আব লাগু নহি হো রহা হ্যায়। তো অউর আন্দোলন করো। লাগু করনেওয়ালি আন্দোলন।’ (আইন তো এল। পুরো জীবন কেটে গেল। কিন্তু আইন লাগু হচ্ছে না। তাহলে আরও আন্দোলন করো। আইন লাগু করার আন্দোলন।) বয়স সত্তর। বাঙালির পক্ষে প্রায় দুর্বোধ্য আঞ্চলিক রাজস্থানি ভাষায় বলছেন এসব। ক্লান্ত স্বর। কিন্তু লড়ে যাওয়া ছাড়া সাধারণ মেয়ের আর কোনো পথ জানা নেই।
ভাঁওরি যখন আন্দোলনের কথা বলেন, তখন ভাল থাকেন। বাকি সময় তিনি ভারি বঞ্চিত বোধ করেন। আজও গুজ্জরদের সঙ্গে জলের সমস্যা। আজও জমি অধিগ্রহণ করে নিচ্ছে তারা কাঁটাগাছ লাগিয়ে। আজও তারা প্রতিশোধপরায়ণ। কই, শহরের দিদিরা তো তার হিল্লে করছে না? সবাই কি তাঁকে ভুলে গেল?
অনেকে হয়ত ভুলেছেন। আবার আমাদের মতো যারা নারীসুরক্ষা নিয়ে মাথা ঘামাই, তাঁরা হয়তো ভুলিনি এই পূর্বজাকে। কিন্তু কীভাবে মনে রেখেছি? একটি একমাত্রিক নাম, যিনি সাহস দেখয়েছিলেন বলে আমরা একটি আইন পেয়েছি— এটুকুই? তাঁর কান্না কি ধারণ করেছি সহনারী হিসেবে? তাঁর অসহায়তা? যদি না করি, তবে আমরাও হয়তো পিতৃতান্ত্রিক কায়দায় মানবীকে দেবীই বানিয়ে ফেলতে চলেছি। বেশ্যা /দেবীর বাইনারিকে ভাঙাই লক্ষ্য ছিল যে!
৫
The modern hero is typically the anti-hero… baffled, troubled, and in search of order.
-Cleanth Brooks
ভাঁওরির অপরাধীর মধ্যে দুজন বৃদ্ধ বয়সে, কেস চলতে চলতেই, মারা গেছে। গোটা জীবন তারা বেঁচে নিল প্রমাণহীন অপরাধের দায় ঝেড়ে। প্রমাণ পাওয়া যায়নি কারণ, আগেই বলা হয়েছে, মেডিক্যাল টেস্টে ইচ্ছে করে দেরি করা হয়েছিল। ভাঁওরি যে ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছিলেন, শোনা যায় তাও নাকি নিজের বাপের বাড়িতে দিতে হয়েছিল। ভাঁওরির দুঃসাহসের খেসারত তাদেরও পোহাতে হচ্ছিল ভিন গাঁয়ে। সেই টাকা দিয়ে জাতি-পঞ্চায়েত ডেকে ভাইয়েরা প্রায়শ্চিত্ত করেছিল। ভাঁওরির অপরাধ ছিল, তিনি ধর্ষিতা হয়েও শান্ত হননি। চুপ থাকেননি। তার উপর, যাদের নামে নালিশ ঠুকেছেন, তারা উচ্চজাত। রাজস্থানের অজ পাড়াগাঁয়ে এরপর এক অলক্ষ্মী ধর্ষিতা কী ভাবে বেঁচে আছেন ত্রিশ বছর ধরে গঞ্জনা মাথায় নিয়ে? এই টিকে থাকা কি মহাকাব্যিক নয়?
ভাঁওরি দেবী বলেন, ‘শরম নহি আওবে। আকেলে-কে লিয়ে না লড়ি থি।’ (লজ্জা পাই না। শুধু নিজের জন্য তো লড়িনি)।
প্রতিজন অলক্ষ্মী, যিনি ন্যায়ের জন্য লড়েন, তিনি শুধু নিজের জন্য লড়েন না। অযুত মেয়ের ক্রোধকে তিনি ভাষা দেন। লক্ষ মেয়ের মুখে বুলি ফোটান। প্রতিজন লক্ষ্মী মেয়ে, যিনি কুঁকড়ে যাচ্ছেন লজ্জায় তবু মুখ খুলছেন না, তিনিও শুধু নিজের যন্ত্রণা দীর্ঘায়িত করছেন না, প্রজন্মের পর প্রজন্মের মেয়েদের জন্য রাত্রিকে করছেন গাঢ়তর।
‘বল কোন দিক সাথী কোন দিক বল
কোন দিক বেছে নিবি তুই?’
Whatsapp
