শেষ পর্যন্ত বাঁচার গল্প বলে রুশদির ‘নাইফ’
Knife by Salman Rushdie: আততায়ী এবং তার ছুরি, এই দু'য়ের যুগলবন্দি সেদিনের সেই বক্তৃতায় শুধু যে ছেদ ফেলেছিল তা নয়, সামগ্রিক ভাবে একটি অসহিষ্ণু ও উন্মত্ত পৃথিবীর মুখোশ খুলে দিয়েছিল।
প্রকাশিত হল সলমন রুশদি’র ‘নাইফ’। ২০২২ সালের ১২ অগাস্ট নিউ ইয়র্কে একটি বক্তৃতা সভায় রুশদির উপরে হামলা এবং তার গুরুতর আঘাতের কথা সংবাদমাধ্যমের সূত্রে আমরা সকলেই শুনেছি। সেই ভয়ঙ্কর প্রাণসংশয়ের মুহূর্ত থেকে দীর্ঘ বারো সপ্তাহ পর ওঁর নিউ ইয়র্কের বাড়িতে ফেরা: বাঁচা-মরা নিয়ে যাবতীয় চিন্তা, আততায়ীর সঙ্গে কাল্পনিক কথপোকথন, শরীর-মনের যন্ত্রনা এবং সর্বোপরি প্রেম আর শিল্পসত্ত্বার স্বাধীনতা— এই সব বিষয় নিয়ে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা একজন মানুষের অনুচিন্তন এই ‘নাইফ’। ২০৯ পাতার এই বই পড়তে মাঝেমধ্যে একটু অস্বস্তিই হয়। আহত শরীর এর চিত্রানুগ বিবরণের মধ্যে দিয়ে লেখক তার যোঝার কষ্ট ও সংগ্রাম দু'টোই বেশ নির্মম ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু বিগত ৩০ বছরে তার লেখকসত্ত্বাকে যে নির্মমতা ও বিসংবাদের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তার তুলনায় এ বিবরণ হয়তো খানিকটা সাধারণ।
সব মিলিয়ে মাত্র সাতাশ সেকেন্ডের সংযোগ স্থাপন। অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় রুশদির খুব কাছে এগিয়ে এসেছে আততায়ী তাঁর অন্তিম মুহূর্তের দূত হয়ে। আচমকা এই হিংস্রতায় তখন চারদিকে সবাই হতবাক। কেউ কেউ ভাবছেন, এটা হয়তো কোনও পারফর্ম্যান্স আর্ট স্ট্যান্ট। সেই সাতাশটি সেকেন্ড আর ১৩-১৪ বারের ছুরির কোপের পর এক ধাক্কায় দু'জন মানুষের জীবনের গতিপথ বদলে যাওয়া। আততায়ী এবং আহত এই দু'জনের কেউ-ই কাউকে চেনে না। চেনার কথাও নয়, তাঁদের দু'জনের পৃথিবী এবং পরিসর আলাদা। আততায়ী খানিকটা যদিও বা চেনে, তা খুবই বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ভাবে। ঘৃণা করতে এবং সেই ঘৃণা জিইয়ে রাখতে যতটুকু চিনতে লাগে, ততটুকুই। অগস্টের ১২ তারিখে ওই বক্তৃতা সভায় রুশদির বক্তব্যের বিষয় ছিল, মার্কিন সমাজকে লেখক ও শিল্পীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে তুলে ধরা (Creation of America as a safe space for writers)।
আরও পড়ুন: ফতোয়া, হুমকি, আক্রমণ! কী ছিল সলমন রুশদির সেই বিস্ফোরক বইতে? সত্যিটা জানলে চমকে উঠতে হবে
আততায়ী এবং তার ছুরি: এই দু'য়ের যুগলবন্দি সেদিনের সেই বক্তৃতায় শুধু যে ছেদ ফেলেছিল তা নয়, সামগ্রিক ভাবে একটি অসহিষ্ণু ও উন্মত্ত পৃথিবীর মুখোশ খুলে দিয়েছিল। হিসেবটা সোজা। বেশি সময় খরচ করার দরকার নেই। শুধু তথ্য নির্বাচন করতে জানতে হবে। কোনটা, কতটুকু জানলে মনের আদিম হিংস্রতাকে নেতৃত্ব দেওয়া যায়! তারপর শত্রু বানিয়ে নিয়ে ছুরি-বন্দুক হাতে সমাজ সংস্কারে নেমে পড়া। রুশদি লিখেছেন, ঘাতক দু-একপাতা লেখাপত্র পড়েছে তাঁর। ইউটিউবে ভিডিও দেখেছে। আর সেটুকুই তার প্রয়োজন ছিল। ফলে এই আক্রমণ আর যার জন্যই হোক না কেন, 'দ্য স্যাটানিক ভার্সেস'-এর জন্য নয়।
‘নাইফ’ আমার দেখা সাম্প্রতিকতম কালের শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদ। মৃত্যুর মতোই আড়ম্বরহীন অথচ তীক্ষ্ণ। খুনের অস্ত্র হিসেবে ছুরি নিয়ে রুশদির এই বইয়ের খানিকটা বক্তব্য উল্লেখ না করলেই নয়। ঘাতক এবং আহতের মধ্যে ওই যে কিছু মুহূর্তের নাটকীয় অন্তরঙ্গতা, তারই অবলম্ব এই ছুরি। রুশদি ব্যক্তিগত পরিসরে তাঁর পছন্দের চলচ্চিত্র ও বইয়ে ছুরির অস্তিত্ব এবং তার ব্যবহার নিয়ে লিখেছেন। রোমান পোলানস্কি, ফিলিপ পুলমান, ফ্রানৎজ কাফকা এবং নিজের পরিচালিত ও অভিনীত এডওয়ার্ড অ্যালবির একাঙ্ক নাটক ‘দ্য জু স্টোরি’-র কথা উঠে এসেছে। তবে সব থেকে অদ্ভুত উপলক্ষণ হল, ২০ বছর আগে রুশদির লেখা ‘শালিমার দ্য ক্লাউন’ বইয়ের উৎপত্তির মূলে থাকা একটি মানসচিত্রে দেখা যাচ্ছে, একজন মৃত মানুষ মাটিতে পড়ে রয়েছেন। রক্ত মাখা ছুরি হাতে সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর আততায়ী। রুশদি নিজের বইকে ‘প্রফেসি’ বলতে নারাজ, কারণ উনি ‘প্রফেট’ নন। হওয়ার কোনও ইচ্ছেও তাঁর নেই। কিন্তু এই বিষয়টি তাঁর বইয়ে বারবার ঘুরেফিরে আসে। রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটারে তাঁকে বর্শার ফালায় গেঁথে মারার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং দর্শক উল্লাসে মত্ত — এই দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তির কথা তিনি লিখেছেন। এমনকী নিউ ইয়র্কের বক্তৃতা দিতে যাওয়ার দু'দিন আগেও তাঁর ঘুম ভেঙেছিল এই দুঃস্বপ্নে। আয়াতোল্লাহ খামেনেইয়ের জারি করা ফতোয়া যে লেখকের অবচেতনে থেকে গিয়েছিল, সেটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই অবচেতনে বারবার ছুরির প্রবেশ পাঠককে ভাবায়।
‘নাইফ’ যতটা রুশদির মন নিয়ে, তার চেয়ে অনেকটা বেশি তার শরীর নিয়ে। হামলার পর থেকে মোটামুটি সেরে ওঠা পর্যন্ত পুরো সময়টার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে এই বইয়ে। তার বেশ কিছুটা অংশই পড়তে হয় রীতিমতো কষ্ট করে। ছুরির আঘাতে ওঁর একটা চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই আঘাতকে সব থেকে নিষ্ঠুর আঘাত বলেছেন রুশদি। এই এক চোখের দৃষ্টি নিয়ে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলার যে কসরতের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা পড়ে দুশ্চিন্তা হয়। লেখক-মনকে আততায়ী কাবু করতে পারে না। কিন্তু শরীরের উপরে যে অভিঘাত রেখে যায়, সেই পুরনো অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া শরীরকে যে আবার নতুন করে হাঁটা-চলা, খাওয়া, লেখা, দেখা— সব কিছু শেখাতে হয়, তার ধকল শরীর এবং মন সহ্য করে কীভাবে? যে এই নতুন শরীর দিয়ে গেল, তাকেই বা লেখক কী বলবেন?
আততায়ীর কোনও নাম রুশদি তাঁর বইয়ে ব্যবহার করেননি। 'দ্য এ.' বলে সম্বোধন করে গিয়েছেন তিনি গোটা লেখায়। নাম দিলেই পরিচয় দেওয়া হয়, বৈশিষ্ট্য দেওয়া হয় — লেখক সেটা চাননি। বইয়ের একটি অধ্যায়ে চার বার তিনি আততায়ীর সঙ্গে মুখোমুখি বসে দীর্ঘ আলোচনা পর্বের কল্পনা করেছেন। জানতে চেয়েছেন কীসের তাড়নায় এই অহেতুক হিংসা? আততায়ীকে ‘ইনসেল’ আখ্যা দিয়েছেন রুশদি। ‘ইনভলেন্টারি সিলেবেট’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ ‘ইনসেল’ । যার মানে, চেষ্টা-চরিত্র করেও যারা প্রেম বা যৌনসঙ্গী পায় না এবং এই অপ্রাপ্তির তিক্ততায় অন্যকে দোষারোপ করে। রুশদির ২৪ বছর বয়সি আততায়ীও সঙ্গীহীন। সেই নিঃসঙ্গতাকে রুশদি করুণা করেছেন। বলেছেন, প্রেমহীন এই জীবন আততায়ীদের হিংসায় উদ্বুদ্ধ করে। ধর্ম নিয়ে আলোচনা রয়েছে এই অধ্যায়ে। রয়েছে এই বইয়ের অন্যতম প্রয়োজনীয় উক্তি: ‘শিল্প বিলাসিতা নয়, মনুষ্যত্বের নির্যাস এবং শিল্প কোনও বিশেষ আশ্রয় দাবি করে না। শুধু আজন্ম বাঁচতে চায়। শিল্প তর্ক, সমালোচনা এমনকী প্রত্যাখ্যানও মেনে নয়। যেটা মেনে নেয় না, সেটা হিংসা। এবং দমনকারীর থেকেই শিল্প অনেক বেশি দীর্ঘায়ু হয়।’ এই বইয়ে লেখকের শিল্পসত্ত্বার সঙ্গে তাঁর প্রেমিকসত্ত্বাও শান্ত হয়ে স্মিত হাসি নিয়ে বসে আছে। প্রখ্যাত কবি ও সঙ্গী রাচেল এলিজা গ্রিফিথসের সঙ্গে লেখকের প্রেম, রুশদির সব চেয়ে কষ্টের দিনে তাঁকে পাশে পাওয়ার যে বিবরণ এ বই জুড়ে আছে, তা যেন এই হিংসা ও যন্ত্রনার সব বর্ণনায় ঠান্ডা প্রলেপের কাজ করে। আর আছে রুশদির পরিবারের কথা। তাঁদের আশঙ্কা, উদ্বেগ ও ভালোবাসার বিবরণ— যা লেখককে বাঁচিয়ে রাখে, সারিয়ে তোলে।
আরও পড়ুন: রাগে ফেটে পড়তে যার কাছে যাওয়া যায় তিনিই কুন্দেরা
নাইজেরিয়ান লেখক চিমামান্ডা নগোজি আদিচির একটি বহুল প্রচারিত বক্তৃতা আছে। বিষয় ‘ডেঞ্জার অফ এ সিঙ্গল স্টোরি’। একক আখ্যানের বিপদ। আমাদের জীবনও ঘিরে রয়েছে গল্প এবং অনবরত নতুন নতুন গল্প তৈরি হয়ে চলেছে। যে ন্যারেটিভ, যে ডিসকোর্স আমাদের অন্যকে চিনতে ও নির্ধারণ করতে শেখায়। এই শেখানোর নেপথ্যে আসলে যে গল্প বলছেন, তাঁর নানা উদ্দেশ্য কাজ করে। দমন করা, দাগিয়ে দেওয়া, নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া— আরও কতো কী! অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বিভাজন সৃষ্টি করার প্রয়োজনে যে গল্প তৈরি হয়, তাকে চিনে নেওয়া দরকার। একক গল্প মনুষ্যত্বের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে। রুশদি বলছেন, আমাদের কাজ, এই মিথ্যে গল্পগুলিকে উল্টে আরও ভালো গল্প বলা। যে গল্পে মানুষ বাঁচতে চায়। ‘নাইফ’ আসলে আমাদের সেই বাঁচার গল্পই বলে।