এই মৃত্যু উপত্যকা
শ্যামবাজার এর পাঁচ মাথার মোড়-এর একটু আগে, সকাল বেলা ৮:৩০ হবে ,৭৮ রুট এর বাস, হুট করে ফাঁকা হওয়া প্রতিবন্ধীর সিট, আমি চেয়ে আছি, সিট ও চেয়ে আছে, আর চেয়ে আছে আমার পাশের ছোঁড়াটি ও। অতঃপর বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার মনবৃত্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে এভারেস্ট জয় করার মত হাসি নিয়ে জানলার ধারে বসে, নেতাজির ঘোড়া, গোলবাড়ি এইসব দেখতে দেখতেই বাস টা চলে গেলো রাজপথ দিয়ে সোজাসুজি শিয়ালদা। ট্রাম লাইন-ভালোবাসা-ঠেলা গাড়ি....তারপর সোজাসুজি শিয়ালদা।
গতানুগতিক নিয়ন্ত্রিত সু-পরিকল্পিত ভালো মানুষটির মত অফিস করে ঘরে ফেরা ছেলে, মা থালা ভরে ভাত দিয়েছে, বউ আদর করে টিফিন। এই ভাবেই জীবনটা পেনশন-এর টাকায় চলে যাবে এই ভেবে বোকা বোকা সময় কাটিয়ে দেওয়া বাবা। এই নিয়েই চলছিল ভালোই আবেগ হীন জীবন।তারপর একদিন হঠাৎ করে সেই শ্যাম বাজার, পাঁচ মাথার মোড়,নেতাজি। দুম করে কি যেন মনে হলো একটা,আবেগ টা নাড়া দিয়ে উঠলো।
আবার বছর পাঁচেক বাদে, ব্যারাকপুর-বারাসাত রোড,বারাসাতের একটি ইউনিভার্সিটির কাজে যাচ্ছি। এইবারে বাহনটা আর পাবলিক বাস নয়।আমারই এক সহকর্মী দাদা অতনু মিত্র-র দুই চাকা, ঠিক যেন জয় আর বীরু । যেতে যেতে নীলগঞ্জ এর ঠিক আগে সাহেব বাগান এর জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউট , বিশাল বড়মাপের জায়গা।দেখে বেশ ভালই লাগলো, যদিও মফস্বলের ছেলে,তাই গ্রামের ফাঁকা জায়গা দেখলে ভালই লাগে। তারপর হঠাৎ করে ডান দিকে চোখ পড়তে দেখি একটি শহীদ বেদী গোছের ।
বাইকটা আস্তে হওয়াতে লক্ষ করলাম লেখা "একতা-বিশ্বাস-বলিদান " আরো ছোটো করে দু এক লাইন সেটা পড়তে পারলাম না। দাদার কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, "ব্যাপার টা সম্পর্কে কিছু জানো ?"
দাদা বললেন-"ভারতবর্ষের সবথেকে বড় হত্যা কাণ্ড কি জানো?"
আমি বললাম- "জালিয়ানওয়ালাবাগ"
দাদা - "ঠিকই বলেছো"
আমি বললাম- "কেন ? কোনো সন্দেহ আছে ?"
দাদা বললো-" হ্যাঁ,সময় টা ১৯৪৫ সাল,২৫ সে সেপ্টেম্বর, 'মেনন' নামক মাদ্রাস রেজিমেন্ট-এর একজন ক্যাপ্টেন,যিনি নীলগঞ্জ ক্যাম্প-এর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি রাত ১০টা নাগাদ,বন্দীদের ক্যাম্প এ ঢোকেন ও নিয়ম মাফিক রোল কল করার চেষ্টা করেন।বন্দীরা তার বিরোধিতা করেন।তখন ক্যাপ্টেন মেনন গারদের বাইরে এসে বিপদ সংকেত (সাইরেন) বাজান ও তৎকালীন কুখ্যাত গুলি ভর্তি টমিগান নিয়ে ভেতরে ঢোকেন, তার সাথে সাথে ঢোকে ক্যাম্পের পাহারায় থাকা সৈনিকরা।
ব্রিটিশদের মতানুযায়ী বন্দীরা বাঁশ ও পাথর নিয়ে গার্ড দের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারপর তারা গুলি চালাতে বাধ্য হন।
আর তাতে মারা যান প্রায় ২২০০ সৈনিক।
ইতিহাস ঘাঁটলে শুধু এইটুকুই পাওয়া যায়।
প্রশ্ন জাগলো... কোন সৈনিক ? কারাই বা বন্দি ?
তদানিন্তন ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপের সবথেকে বড় আসন টা যাঁর প্রাপ্য সেই নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস তার তৈরি করে যান "ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি" বা "আজাদ হিন্দ ফৌজ" ।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ব্রিটিশ বিরোধী আজাদ হিন্দ বাহিনী যাদের সাহায্যে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল তাদের ভরাডুবি হয়। বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব পড়ে, আজাদ হিন্দ বাহিনীর ওপর । যে লক্ষ্য নিয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী বা ' INA ' তৈরী হয় তার পুরোটাই নস্যাৎ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এর মিত্র বাহিনীর জয়ের পর।বন্দী বানিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার করা হয় এই তরুণ আগুন দের।
প্রায় ৩০০০ এর ও বেশী INA সদস্য,কে এনে রাখা হয় নীলগঞ্জ ক্যাম্পে, বর্তমানে যেটা 'ইন্ডিয়ান নেশানাল জুট ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টর' নামে বারাসাত-ব্যারাকপুর রোডের সাহেব বাগান এলাকার কাছে অবস্থিত।
৩০০০ এর কিছু বেশি INA সৈনিক দের মধ্যে কিছু সৈনিক দের নিয়ে যাওয়া হয়"ফোর্ট উইলিয়াম"এর কারাগারে বন্দি করার জন্য, আর বাকি সৈনিকদের যুদ্ধ বন্দী হিসেবে রাখা হয় নীলগঞ্জ-এ ।
এলাকার তদানীন্তন সময়ের মানুষ শিব শংকর ঘোষ বলেন, তিনি দেখেছিলেন লরি করে লাশ গুলো কে নিয়ে যেতে , আর রক্তে ভেসে যেতে সারা রাস্তা ।
২২০০ মানুষ কে এক রাতের মধ্যে মেরে ফেলার ঘটনা বোধ করি ভারত তথা পৃথিবীতে আর কখনো হয়নি, ('জার্মান কনসেন্ট্রেশন' ক্যাম্প বাদে)।
এই বার দেখা যাক তাদের মৃতদেহ গুলির কি পরিনতি হলো।
এই বিষয় কথিত আছে বহু মৃতদেহ পার্শ্ববতী "নোয়াই " খালে ফেলে দেওয়া হয়, আর ক্যাম্প এর ভিতরে সাতটি তালগাছের এর গোড়ায় মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়।
( তথ্য : ন্যাশনাল্ আর্কাইভ )
অতনু দার সাথে পরিচয় টা এখন দাদা-ভাই এর সম্পর্কে পরিণত হয়েছে।আসলে আবেগ টা দুজনেরই এক ই ছিলো এবং আছেও। আমার মত হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ভারতীয়র আবেগ অন্তরালে ই
থেকে যায়।
আমাদের আবেগ গুলো কে আমরা বড্ডো চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছি প্রতিদিন, আমাদের আবেগ গুলো কে খেলো ভাবছি প্রতিনিয়ত ।
..........আর কি অদ্ভুত ব্যাপার এই আবেগ গুলোই হলো 'ভিত', যাকে পাথেও করে চলছে পুরো দেশ।
এই আবেগ এর ফল 'এই মৃত্যু', চিরকাল এই মৃত্যুর খেলা চলেছে।
তাই বার বার মাথায় আসে, হাজার বার মাথায় আসে নবারুণ ভট্টাচার্য এর লেখা টি ....."এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়"