আরও কত ছবি করতে পারতাম একসঙ্গে, ঋতুদার মতো গাইডের, বন্ধুর অভাববোধ করি

বড় চরিত্র হোক, ছোট চরিত্র হোক, গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স হোক- ঋতুদা জানতেন, কীভাবে আমার শ্রেষ্ঠ অভিনয়টা বের করে আনতে হয়।

ছোট ছিলাম যখন, মানে যখন স্কুলে পড়তাম, তখন থেকেই আমার খুব ইচ্ছে ছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবিতে কাজ করার। আমি তখন সিনেমা হলে যেতাম, শুধু ওঁর ছবি দেখব বলেই‌। আমার বারবার মনে হতো, এই পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতেই হবে। আমার মা মুনমুন সেন অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রথম ছবি 'হীরের আংটি'-তে। সেই সূত্রে ওঁকে কিছুটা চিনতামও। কিন্তু যেটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত, তা হলো, যেভাবে উনি মেয়েদের পোর্ট্রে করতেন, নারীচরিত্রকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলতেন। আমার মনে হয়, মেয়েদের মনটা ঋতুদা খুব ভালো বুঝতেন। 'উনিশে এপ্রিল' আর 'তিতলি'-তে অপর্ণা সেন, 'অসুখ'-এ বা 'উনিশে এপ্রিল'-এ দেবশ্রী রায়, 'দহন'-এ ইন্দ্রাণী হালদার, 'দহন' আর 'উৎসব'-এ ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত- এঁদের চরিত্রায়ণ আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

তারপর, অবশেষে যখন 'চোখের বালি' হলো, তখন একটা অনন্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল। অনেকগুলো ওয়ার্কশপ করেছি সেই সময়। অনেক কিছু শিখিয়েছিলেন আমাকে ঋতুদা। একটা পিরিয়ড পিস করার জন্য যে যে বিষয়গুলো জানা-বোঝা প্রয়োজন, সেগুলো সম্পর্কে ওঁর খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল। ধরা যাক, টিপটা কোথায় পরতে হবে বা ওই সময় কীভাবে টিপ পরা হত, সেসব খুঁটিনাটি দিকেও ওঁর সাংঘাতিক ভালো দৃষ্টি ছিল। কাকে মেক আপ করলে ভালো লাগবে, কাকে লাগবে না, এসব বিষয়ে রীতিমতো সজাগ থাকতেন। নারীচরিত্রগুলোকে উনি ভেতর থেকে, গভীরভাবে বুঝতেন বলেই ডিটেলের দিকে এতটা নজর দিতেন। পরিচালক হিসেবে নিজের ছবির নারীচরিত্রদের অনুধাবন না করতে পারলে তো এভাবে, এতদিকে নজর দেওয়া সম্ভব নয়। এগুলো আমার কাছেও একটা শিক্ষা হয়ে রয়ে গেছে।

'চোখের বালি'-র সময় আমি রীতিমতো ওই সময়ের মতো করে শাড়ি পরে ওঁর বাড়িতে যেতাম, চা-কফি পরিবেশন করতাম। একটি মেয়ে, যে বাড়ির কাজকর্ম করে, তার শরীরি ভাষা, আর যে কোনও কাজ করে না, তার শরীরি ভাষা আলাদা হবে। এগুলো যাতে হাতে-কলমে বুঝতে পারি, যাতে শাড়িটা পরে সেটাকে সবদিক মাথায় রেখে ক্যারি করতে পারি, তার জন্য এইজাতীয় নানা ওয়ার্কশপ করাতেন আমাকে দিয়ে। শাড়ি পরে কীভাবে হাঁটাচলা করতে হবে, সেগুলো শিখেছি। একটা অডিও রেকর্ড করে দিয়েছিলেন, সংলাপের টোন, ফ্লো এগুলো শেখানোর জন্য। সেটা হেডফোন কানে দিয়ে শুনতাম সবসময়।

 

Rituparno Ghosh


এর পরের ছবিগুলোর জন্য কিন্তু এতটা প্রস্তুতি আমাকে নিতে হয়নি। ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে কাজ করতে করতে, ওঁর সঙ্গে ওয়ার্কশপ করা, পড়া, শোনা, জানা, উপলব্ধি করার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে, ওঁর সঙ্গে থাকতে থাকতে, আমার কাছে চরিত্র হয়ে ওঠাটা খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। আমি ওঁকে খুব ভালোভাবে বুঝতাম, উনিও জানতেন, কীভাবে আমার সেরাটা বের করে আনতে হবে। আমি জানতাম, উনি ঠিক কী চাইতেন, আমিও সেটাই আমার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতাম। ওঁর প্রায় সবক'টা ছবিতে আমি থেকেছি। বড় চরিত্র হোক, ছোট চরিত্র হোক, গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স হোক- ঋতুদা জানতেন, কীভাবে আমার শ্রেষ্ঠ অভিনয়টা বের করে আনতে হয়। তাছাড়া আমরা বন্ধুও হয়ে উঠেছিলাম, আমাদের মুম্বইয়ের বাড়িতে এসে উনি থাকতেন, কত গল্প করতাম আমরা! একজন মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে তাঁর মনটাও বোঝা যায় স্পষ্টভাবে। সেটা ঋতুদার ক্ষেত্রেও হয়েছিল।

 

Chokher bali

'চোখের বালি' ছবিতে ঐশ্বর্য রাইয়ের সঙ্গে

 

ওঁকে তো সহ-অভিনেতা হিসেবেও পেয়েছি আমি। মনে পড়ে, যখন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের 'আরেকটি প্রেমের গল্প'-তে অভিনেতা হিসেবে উনি ডেবিউ করলেন, তখন আমাকেই চেয়েছিলেন কো-স্টার হিসেবে। আমি তখন মুম্বইতে, ডেট নিয়ে একটু সমস্যা চলছিল। কিন্তু ঋতুদা বললেন, "আমার অভিনয় করা প্রথম ছবিতে আমি তোকেই চাই কো-অ্যাক্টর হিসেবে। ডেটের সমস্যা মেটা, কোনও পরিচালককে না বলতে হলে বলে দাও, কিন্তু তোকে করতেই হবে।" ঋতুদার কথা আমি ফেলতে পারিনি। খুবই সাহায্য করেছিলেন অভিনয়ের সময়। ঠিক কী প্রয়োজন, সেটা আমাকে সব দৃশ্যের আগে বুঝিয়ে দিতেন, অথচ ওই একই দৃশ্যে কিন্তু উনিও অভিনয় করতেন। আমার দিকে এতটা মনোযোগ দিতেন, বলে বোঝানো যাবে না। আমাকে রাজকন্যার মতো করে আগলে রাখতেন, শেখাতেন, পাশে থাকতেন।

'চিত্রাঙ্গদা', 'মেমোরিজ ইন মার্চ' ছবিতেও আমি ওঁর সঙ্গে অভিনয় করেছি। 'চিত্রাঙ্গদা'-র চরিত্রটাকে উনি সবচেয়ে ভালো বুঝেছিলেন, ওই চরিত্রে উনি ছাড়া আর কেউ অভিনয় করতে পারতেন কি না জানি না। আমি জানি না, ওই চরিত্রটা আসলে ওঁরই প্রতিচ্ছবি কি না, কিন্তু ওই চরিত্রটা ওঁর মনের মধ্যে থেকেই যেন উঠে এসেছিল, বাকি চরিত্রদের মতোই।

Raima Sen

'খেলা' ছবিতে

 

ঋতুদার শুটিংয়ে খুব মজা হতো। 'খেলা'-র কথা মনে আছে, আউটডোর শুটিংয়ে আমি, বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়), অভীকদা, আমাদের চিত্রগ্রাহক (অভীক মুখোপাধ্যায়), আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম প্যাক আপের পর, নানা ইন্ডোর গেম খেলতাম। সবক'টা ছবির শুটিংই খুব আনন্দ করে করেছি আমরা।

ওঁর মতো পড়াশোনা, রিসার্চ খুব কম মানুষেরই ছিল। উনি থাকলে কত ভালো ভালো ছবি পেতাম আমরা, পরিচালক হিসেবে আরও কত কিছু উপহার দিতে পারতেন আমাদের। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। আমি জানি না, শেষবেলায় কোনও ছবির পরিকল্পনা ক‍রছিলেন কি না, কিন্তু সেই ছবি হলে আমি থাকতাম, এটা জানি। ওঁকে মিস করি, একজন গাইড হিসেবে। একজন বন্ধু হিসেবে ওঁর অভাববোধ করি খুব। 'চোখের বালি' ছিল আমার কেরিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। আমি অভিনয়ের অনেক কিছু ওঁর কাছেই শিখেছি, আরও কত কী শেখা বাকি রয়ে গেল!

More Articles