নাটকের আয়োজন করতে গিয়ে শাসক আশ্রিত দাদার হাতে মার! প্রতিবাদে খোলা চিঠি অনির্বাণ ভট্টাচার্যের

Anirban Bhattacharya Open Letter : ফুলবাগানে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছে। তার আগে অনির্বাণ একটি চিঠি সামনে রাখলেন।

মাত্র কয়েকদিন আগেই কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উদ্বোধনী উৎসব অনুষ্ঠিত হল। সিনেমার নানা আয়োজনে সেজে উঠল কল্লোলিনী তিলোত্তমা। এদিকে যাত্রা, নাটক, পথ নাটকের সঙ্গে আগামী দিনের বইমেলা – বাংলা যেন সংস্কৃতির উদযাপনে তৈরি। 

সাম্প্রতিক একটি ঘটনা সেই উদযাপনের খাতায় কালো দাগ দিয়ে রাখল। নাটক করতে বাধা দেওয়া, তারপর নাট্যকর্মীদের মার – এমন ছবিই দেখল এই বাংলা। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের পক্ষ থেকে এমন আক্রমণে খুব একটা সরব হতে দেখা যায়নি সামাজিক মাধ্যমকে। কিন্তু নাট্যকর্মীদের ওপর এমন আঘাত, তাঁদের গায়ে হাত তোলার প্রতিবাদ করেছেন বেশ কয়েকজন। তাঁদের মধ্যেই অন্যতম অনির্বাণ ভট্টাচার্য। সিনেমা, নাটকের মঞ্চের অন্যতম বিখ্যাত ও পরিচিত মুখ। শাসকদলের এই অন্যায়ের প্রতিবাদে ২৮ ডিসেম্বর ফুলবাগানে একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছে। তার আগে অনির্বাণ একটি চিঠি সামনে রাখলেন। সেটিই তুলে ধরল ইনস্ক্রিপ্ট।

নমস্কার।

আমার নাম অনির্বাণ। আমি বাংলা থিয়েটারে ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করি। ইদানীং পরিচালনার কাজও করেছি। আমি আজ বেলেঘাটাতেই শুটিং করছি, কিন্তু খুবই টাইট শিডিউল থাকায় সভাতে উপস্থিত থাকতে পারছি না। কিন্তু আমি এই সভায় উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলাম, কারণ গায়ে হাত উঠেছে।

নিশ্চয়ই আগেও উঠেছে, অভিনেতার গায়ে, নাট্যকর্মীর গায়ে। সুদূর বা অদূর ইতিহাসে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমার জানার মধ্যে এই প্রথম হাত উঠেছে। আমি প্রতিবাদ করছি, আরো অনেকের সঙ্গে, এটা জেনেই, যে এই প্রতিবাদ ব্যর্থ হবে।

যার গায়ে হাত উঠেছে, তার গায়ে আবার হাত উঠতে পারে শীঘ্রই, এবং যিনি হাত তুলেছে, তিনি তার সাহসে বলীয়ান হয়ে বাংলা মায়ের সুযোগ্য সন্তানের অনেকগুলো সার্টিফিকেট ঘরে বাঁধিয়ে রাখবেন। কে জানে হয়তো কালের অদ্ভুত নিয়মে একদিন বাংলার সংস্কৃতি মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন, দল বদলালে হয়তো ভারতেরও। এটা বা এরকম কিছুই হয়তো হবে।

আমি এই ঘটনাকে বুঝে নিতে চাইছি রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে।

আজ থেকে ১২ দিন আগে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে অমিতাভ বচ্চন বাক স্বাধীনতার সপক্ষে বক্তৃতা করে গেছেন। শাহরুখ খান সোশ্যাল মিডিয়ার ঘৃণা বাহিনীকে এক হাত নিয়েছেন, সারা ভারতে মুক্তমনা মানুষ হাততালি দিয়ে উঠেছেন। সেদিন যারা মঞ্চে ছিলেন, তারাও দিয়েছেন।

তার কিছুদিন পরেই অমিত সাহা ও অরূপ খাঁড়া মার খেয়ে গেলেন, নাট্য উৎসব আয়োজন করার জন্য। একই রাজ্যে! কেন? কারণ অমিত সাহা ও অরূপ খাঁড়া পশ্চিমবঙ্গের বোধ করি একটি ভোটকেও ডিস্টার্ব বা পেট্রনাইজ করতে পারেন না।

অমিতাভ বচ্চন বা শাহরুখ খান পারেন।

তাই, চলুন, আমরা নাটক ছেড়ে একটা মার খাওয়ার উৎসবের দিকে এগিয়ে যাই।

আমরা রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়াই। প্রতিটি অঞ্চলের পার্টি অফিসে আমরা আবেদন পত্র জমা দিই আমাদের নাটক অভিনয়ের দিন ও স্থান সমেত, আমাদের যেন এসে বেদম মার দেওয়া হয়, যেন বুঝিয়ে দেওয়া হয় হাড়ে হাড়ে যে ভোটকেন্দ্রিক গণতন্ত্রে অমিতাভ বচ্চন বা শাহরুখ খান না হলে বেশি লাফাতে নেই।

সারা ভারতবর্ষের সিনেমা ও থিয়েটার অভিনেতারা যেন জানতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গে এক অভূতপূর্ব আনন্দযজ্ঞ শুরু হয়েছে, ভোট রাজনীতিতে কাজে আসে না, এমন শিল্পীদের মেরে ঠান্ডা করে দেওয়া হচ্ছে।

এই শিক্ষা সারা দেশ আমাদের রাজ্য থেকেই পাক।

চলুন, অভিনয় চর্চা, গানবাজনা ছেড়ে আমরা আগে আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বটা বুঝে নিই আমাদের আজকের বাস্তবতায়। আবেদন পত্র জমা দেওয়া শুরু হোক। অখ্যাত, বিখ্যাত, নামী, অনামী সমস্ত অভিনেতারা চলুন এক যোগে মার খাওয়ার আবেদন জানাই।

আমি অনির্বাণ। আমার এর পরের অভিনয় ১৫ই জানুয়ারি রবীন্দ্র সদন মঞ্চে। এসে মেরে যান। কারণ এই দিন এর অভিনয়ে ভোট রাজনীতির কোনো মুনাফা নেই, এমন ফালতু ঘটনা রাজ্যে প্লিজ একটাও ঘটতে দেবেন না, অনুরোধ।

সবশেষে কেক উৎসবের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি।

অনির্বাণ।

ঠিক কী ঘটেছিল? বিদূষক নাট্য গোষ্ঠীর তরফ থেকে ছোট পরিসরে দু’দিন ব্যাপী নাটকের উৎসব করার কথা ছিল। ২৪-২৫ ডিসেম্বর বেলেঘাটা রাসমেলা মাঠে এই অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। ২৩ ডিসেম্বর তার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে যান অভিনেতা অমিত সাহা ও অরূপ খাঁড়া। তখনই তাঁদের ওপর চড়াও হয় শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্ব। সেই সময় বেলেঘাটার কেক উৎসবের প্রস্তুতির জন্য এই নাট্য উৎসব বন্ধের তোড়জোড় শুরু হয়। তারপরই অমিত সাহা ও অরূপ খাঁড়াকে মারধর করে মাঠের বাইরে আনা হয়, উৎসবের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়। শেষমেশ একপ্রকার বাধ্য হয়েই নাট্য উৎসব মুলতুবি রাখতে বাধ্য হয় বিদূষক গোষ্ঠী। ২৮ ডিসেম্বর এই হামলার প্রতিবাদেই ফুলবাগানে সভার আয়োজন করা হয়েছে। 

More Articles