আফগানিস্থানের ক্ষমতার পালাবদল ঘিরে বিপুল আশঙ্কা

গত ১৫ই আগস্ট,২০২১ যেদিন আমরা দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৪ বছর পূর্ত্তির উদযাপন করছিলাম, সেদিনই ভয়ার্ত ৬৪০ জন আফগান একটি আমেরিকান সৈন্যবাহিনীর বিমানে গাদাগাদি করে উঠে 'কাতার'- পালালেন | বিমানটি ছিল C-17 Globemaster - III মডেলের একটি পণ্যবাহী বিমান আর তার যাত্রী পরিবহনের ক্ষমতা মাত্র ১৩৪জন।আমেরিকার প্রতিরক্ষা ও সংবাদসংস্থার ওয়েবসাইট 'Defense -One' এমনি এক সংবাদ ও চিত্র প্রকাশ করেছে। আর যে সমস্ত আফগান এইভাবে পালাতে পারলেন না, তারা কেউ বিমানের ডানা ধরে,কেউ উড়ন্ত বিমানের চাকার সঙ্গে নিজেকে বেঁধে দেশ ছাড়ার মরিয়া চেষ্টা করে মর্মান্তিক ভাবে ব্যর্থ হলেন।বিমান টেক অফ করার পর শূন্যে উঠতেই খসে পড়লেন একক করে পাঁচ জন। কয়েকশো ফুট উপর থেকে মাটিতে পরে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল তাদের দেহ। এইরকম হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সাক্ষী আজ সারা বিশ্ব,(ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে)। তালিবান ধর্মান্ধদের হাতে জীবন,জীবিকা,অধিকার, সন্মান ইত্যাদি সবকিছু লুঠ হয়ে যাওয়ার ভয় আজ আফগানিস্থানের মানুষদের এমনভাবেই তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

গত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেছিলেন যে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে। এইরকম ঘোষণা করার সময় আমেরিকা হয়তো ভেবেছিল যে তারা সৈন্যদের সরালেও আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির সরকার ও তার সৈন্যবাহিনী আরো কিছুদিন দেশে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে।কিন্তু সমস্ত আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করে ৬ই থেকে ১৫ই আগস্টের মধ্যে তালিবান শক্তি দ্রুত কাবুল পর্যন্ত দখল করে নেবে।দেশ তথা প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ 'অর্গ' দখল করে নিজেদের শাসন কায়েম করবে এবং দেশের নাম পাল্টে 'ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তান' করবে তা হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি মার্কিন প্রশাসন |

ওদিকে দেশটাকে দখল করার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কারাগার থেকে এযাবৎ বন্দী তালিবান জঙ্গিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে | তারা Assault Rifle আর AK -47 হাতে রাজধানী কাবুলের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে |

বস্তুত তালিবান শক্তিকে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির সৈন্যবাহিনীর জোরালো প্রতিরোধের মুখেই পড়তে হয়নি | অথচ এই সৈন্যবাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত করতে, সামরিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করতে আমেরিকা বিগত ২০বছর ধরে ২ ট্রিলিয়ান আমেরিকান ডলার খরচ করেছে এবং ২৫০০ আমেরিকান সৈন্যের মৃত্যুও স্বীকার করেছে | আশরাফ গণির সরকার আসলে আমেরিকার পুতুল সরকার হয়ে দাঁড়িয়েছিল |

কাবুলে অবস্থিত রাশিয়ার দূতাবাসের মুখপাত্র নিকিতা ইশচেঙ্কো মারফত জানা গেছে যে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি চারখানি গাড়ি এবং একটি হেলিকপ্টার ভর্তি কারেন্সি (টাকা) নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন | হেলিকপ্টারে সব টাকা ভরাতে না পারার জন্য বিমানবন্দরের টারম্যাকে অনেক টাকা পড়েছিল | সম্ভবত তিনি তাজিকিস্তানে পলায়ন করেছেন | যাত্রাকালে তিনি বলেছেন ..... "রক্তপাত এড়ানোর জন্য আমি দেশ ছেড়ে চললাম" |

এই পরিস্থিতিতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ যে ভয়াৰ্ত্ত হবেন সেটাই স্বাভাবিক। তালিবানদের হাতে সদ্য ক্ষমতাচ্যু্ত আফগান সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীর এক অফিসার (নাম-আসিফ) চোখের জল ফেলতে ফেলতে এক সাংবাদিককে বলেছেন ..... "তালিবান-রা আমাদের ধরে ধরে মারছে | নোটিশ পাঠিয়ে বলেছিল, সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে। নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকশো অফিসার ইতিমধ্যেই উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তানের মত দেশে পালিয়ে গিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পালাতেই বুঝেছিলাম সব আশা শেষ।" এর পাশাপাশি ওদেশের মেয়েদের অবস্থা ভয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার মত | 'তালিবান ফতোয়া'-কি বস্তু তা তারা জানেন | শিক্ষা-দীক্ষার চর্চা, স্কুলে যাওয়া,স্বাধীন ভাবে চাকরি করা,সর্বাঙ্গ ঢাকা বোরখা পরেও একা পথে বেরোনো ইত্যাদি অধিকার তাদের খোয়াতে হয়েছে | নিয়ম না মানার শাস্তি .....প্রকাশ্য রাস্তায় পাথর ছুড়ে হত্যা, হাত-পা কেটে নেওয়া, নয়তো ফাঁসি কাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া। এলাকা ধরে মেয়েদের নামের তালিকা চেয়েছে তালিবান বাহিনী। ১৫ বছরের উপরে কিশোরী থেকে ৪৫ বছরের নিচে বিধবা মেয়েদের সন্ধান চাই।তালিবান যোদ্ধাদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে তাদের। আসলে তাদের দিয়ে দাসীবৃত্তি করানো হবে।

রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস বলেছেন....... "এত কষ্ট করে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলেন আফগান মহিলারা,তা স্রেফ গুড়িয়ে দেওয়া হলো।"

সৌভাগ্য বসত অথবা দুর্ভাগ্য বসত প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ 'অর্গ'-এর দখল খুব শান্তিপূর্ণ ভাবে নিয়েছে তালিবানরা | প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান,যিনি বিগত ২দশক ধরে প্রাসাদটিকে রক্ষা করেছেন,একজন তালিবান সেনাপ্রধানের সঙ্গে করমর্দন করেছেন এবং প্রাসাদ নিয়ন্ত্রণ - ব্যবস্থার হস্তান্তর ঘোষণা করেছেন। আফগান সরকারের তরফে যিনি তালিবান শক্তির সঙ্গে প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করেছিলেন,তার নির্দেশে মোহাম্মদ উল্লাহ আমিন নামে এক সরকারি অফিসার সেই তালিবান সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাকে প্রাসাদে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এসেছেন। এই প্রকার প্রাসাদ -নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার হস্তান্তর পর্ব আল-জাজিরা টেলিভিশন চ্যানেলে রবিবার রাতেই সম্প্রচার করা হয়েছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় (গণমাধ্যমে) ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে |

এইরকম শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা - হস্তান্তর পর্ব কিন্তু আফগানিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তরের অতীত দৃষ্টান্তগুলির থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির ছিল। কারণ সেই সব পরিস্থিতিতে প্রাসাদটি হিংসা ও দাঙ্গা - হাঙ্গামায় দীর্ণ হয়েছে |

১৯৭৮ সালে প্রাসাদের ভিতর বিদ্রোহী সৈন্যেরা হত্যা করল প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দায়ূদকে |

১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট নূর মোহাম্মদ তারাকি প্রাসাদের ভিতর গুলিযুদ্ধে নিহত হলেন।

১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সোভিয়েত সাইন আফগানিস্তান আক্রমণ করে, প্রাসাদ দখল করে এবং প্রেসিডেন্ট হাফিজুল্লা আমিনকে হত্যা করে |

১৯৮০ সালে আফগান মুজাহিদিন বাহিনী সোভিয়েত কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।

১৯৮৯ তে সোভিয়েত বাহিনীর প্রস্থানের পরে মস্কো - ঘনিষ্ঠ আফগান সরকার অন্তত কয়েক বছর তালিবান - বিরোধী লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল |

১৯৯২ সালে মুজাহিনদিন বাহিনী সোভিয়েত মদত-পুষ্ট সেনাদের বিতাড়িত করল | কিন্তু দেশে গৃহ যুদ্ধ শুরু হলো।

১৯৯৬ সালে আব্দুল গণি বোরাদর এবং মোহাম্মদ ওমরের নেতৃত্বে তৈরী তালিবান-আন্দোলনের সেইমুখ 'তালিবান বাহিনী' ক্ষমতায় এলো | এদের কর্তৃত্ব চললো পাঁচ বছর | এই তালিবান আন্দোলনে শক্তি জুগিয়েছিল বেশ কিছু ইসলামিক ভাবনায় শিক্ষিত তরুনের দল | যারা দেশটির মানুষের ধর্মীয় শুদ্ধিকরণের প্রবক্তা হতে উঠে পড়ে লেগেছিল | এই তালিবানি শক্তিকে মদত জুগিয়েছিল পাকিস্তানের Inter Services Intelligence (ISI ) |

২০০১ সালে আমেরিকান সৈন্যবাহিনী এবং তাদের আফগান সহযোগীদের মোকাবিলার সামনে তালিবান শাসন ক্ষমতাচ্যুত হলো |

পরবর্তী বিশ(২০) বছর তালিবানবাহিনী বিদেশে আশ্রয় নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছিল | এই নির্বাসন পর্বে আব্দুল গণি বোরাদর একজন ধুরন্দর সামরিক নেতা এবং একজন কুট রাজনৈতিক কৌশলী হিসাবে পাশ্চাত্যের কূটনৈতিক নেতাদের সমীহ আদায় করতে সমর্থ হন | আমেরিকার চাপে তিনি একসময় পাকিস্তানের জেলে বন্দীও হয়েছিলেন | এই বোরাদরই সম্ভবত নতুন ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবেন |

আমেরিকা এবং নেটোর অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমী দেশগুলি আশা করেছিল যে তালিবানি সন্ত্রাসবাদী শক্তিকে যুদ্ধে পরাজিত করে আফগানিস্তানের ওপর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। কিন্তু এই অভিযান যে পায়ের বেড়ি হয়ে দাঁড়াবে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি। যুদ্ধের কারণে অগণিত মানুষের মৃত্যু, অর্থনীতির উপর ক্রমবর্ধমান চাপ এবং করোনা অতিমারীকে কেন্দ্র করে আমেরিকার ব্যতিব্যস্ত অবস্থা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে বাধ্য করেছিল 'কাতার'-এর রাজধানী "দোহা"-তে তালিবান নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতা শুরু করতে। কিন্তু পরিস্থিতি দিনে দিনে এতই অবনতির দিকে গেল যে মার্কিন প্রশাসন বুঝতে পারল যে মান-সন্মান থাকতে থাকতে আফগানিস্থান থেকে সেনা প্রত্যাহার করা জরুরি হয়ে পড়েছে | কিন্তু সেই সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ হওয়ার ১০দিনের মধ্যে এমন বিপর্যয় নেমে আসবে তা কল্পনারও অতীত ছিল | আমেরিকার প্রাক্তন কূটনৈতিক সঙ্গী পাকিস্তান যে এতটা মার্কিন - বিরোধী মনোভাব নিয়েছে এবং চীন-ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তা নিঃসন্দেহে আমেরিকার দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে।

চীন সরাসরি নতুন তালিবানি সরকারকে স্বীকৃতি জানিয়েছে।পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নতুন তালিবানি সরকারকে 'দাসত্ব-শৃঙ্খল-ভাঙা' বিপ্লবীর মর্যাদা দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এদিকে আফগানিস্থানের সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন যে তাদের দেশে ইসলামের শাসনের নাম ইসলামাবাদের শাসন চালু হলো। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে তারা সেই মর্মে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, এভাবে পাকিস্তানের কাছে তাদের নতুন করে দাসত্বে বাঁধা পড়তে হবে,তারা তা ভাবেননি।

আমাদের ভারত সরকার সঙ্গত ভাবেই এ ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান নিয়ে চলেছেন। ইতিমধ্যে কাবুল থেকে সমস্ত ভারতীয় কূটনীতিক, ITBP জওয়ান ও সাংবাদিকদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।


এমনিতেই পাঁচ দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধে আফগানিস্থানের হাজার হাজার মানুষের জীবন বলি হয়েছে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন, তাদের ৮০ শতাংশই মহিলা ও শিশু | করোনার প্রাদুর্ভাবের পাশাপাশি, এইরকম চরম বিপর্যয় প্রকৃতই সহ্যের অতীত। এবার সংযুক্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।


সাম্প্রতিকতম খবর অনুযায়ী, ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণি সংযুক্ত আরব আমিরশাহী-তে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। সেখান থেকে তিনি ঘোষণা করেছেন যে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হয়নি বলেই তিনি দেশত্যাগ করেছেন। টাকা নিয়ে তয় পালানোর অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।

ইতিমধ্যে তালিবান শক্তি ঘোষণা করেছে যে ভারতের সঙ্গে সমস্ত রকমের আমদানি রফতানির বাণিজ্য তারা বন্ধ করে দিয়েছে।

গত ১৮ই আগস্ট, আফগানিস্তানের জালালাবাদ শহরের রাস্তায় শয়ে শয়ে মানুষ তালিবানি শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেন। অবিলম্বে গুলি চালিয়ে তালিবানরা সে মিছিল দমন করে দেয়।

 

তথ্য সূত্র : সংবাদপত্র

More Articles