যন্ত্রণা, কান্নার ঊর্ধ্বে হাল না ছাড়ার লড়াই! বাংলাকে বেঁচে থাকার গান শিখিয়ে গেলেন ঐন্দ্রিলা
Aindrila Sharma Death: ঐন্দ্রিলার এই থেমে যাওয়া আসলে যুদ্ধবিরতি, যেখান থেকে ব্যাটন ধরবেন ফের কেউ। ফের এগোবে জীবনের দো পাইয়া। কঠিন রোগের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জমজমাট ম্যাচ দেখবে জীবন
মানুষের মৃত্যু হলে তবু তো মানব থেকে যায়, যোদ্ধার মৃত্যু হলে তবুও তো লড়াই থেকে যায়। সেই ময়দানের মাটিই আঁজলাভরে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে নেন ভীতু সৈন্যরা। যেভাবে এখন সার দিয়ে বসে থাকা যন্ত্রণা, নুইয়ে পড়া চুল কম মাথা, চোখের নীচে কালি, রুক্ষ চামড়ার দুর্বল দেহসমূহ চোখ স্থির করে রেখেছে ঐন্দ্রিলার দিকে, যোদ্ধা ঐন্দ্রিলার দিকে। এই ভালো, এই খারাপ, এই হাসি, এই যন্ত্রণা, এই জ্ঞান, এই নিঃসাড়- সমস্ত দোলাচল পেরিয়ে যে এখন স্থির। শনিবার রাতে অন্তত ১০ বার হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ঐন্দ্রিলা। ১০ বার! অথচ শনিবার সকালেই ঘটেছিল ‘মিরাকল’। শরীর গরম হয়ে উঠেছিল ভেন্টিলেশনের শীতের মধ্যে, নড়েছিল হাত। তারপর ফ্যাকাশে, মৃত্যুর রঙ যেমন হয়। তবু, শেষ নয়। ঐন্দ্রিলার এই থেমে যাওয়া আসলে যুদ্ধবিরতি, যেখান থেকে ব্যাটন ধরবেন ফের কেউ। ফের এগোবে জীবনের দো পাইয়া। কঠিন রোগের বিপরীতে দাঁড়িয়ে জমজমাট ম্যাচ দেখবে জীবন।
শনিবারের রাতে পর পর এতগুলো কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর ঐন্দ্রিলাকে সিপিআর দেওয়া হয়। ভেন্টিলেশন থেকে আর বেরনো হয়নি অভিনেত্রীর। জীবনের সমস্ত যান্ত্রিক সাপোর্টও তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতিকে ঠেকাতে পারেনি। মঙ্গলবার সন্ধেয় স্ট্রোক হওয়ার পরে হাসপাতালে এসেছিলেন ঐন্দ্রিলা। এর আগে দু’বার ক্যানসারকে গোল দিয়েছিলেন, সব্বাই জানতেন এবারও, এবারও ফিরবেন ঐন্দ্রিলা। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতেই চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন রক্তচাপ ব্যাপক ওঠানামা করছে, সংক্রমণের জন্য চলছে কড়া কড়া মাত্রার ওষুধ। বাড়ানো হয়েছিল অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা। চোখ খোলেননি ঐন্দ্রিলা, অসাড়। সন্ধ্যায় এক বার ফের ‘মাইল্ড কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয় ঐন্দ্রিলার। তার পরেও কিন্তু অবস্থা ছিল স্থিতিশীলই। শনিবার সকালে হঠাৎ ঐন্দ্রিলার প্রেমিক-বন্ধু সব্যসাচী জানান, হাত নড়ে উঠেছে, হৃদস্পন্দন এক লাফে অনেকটা বেড়ে গরম হচ্ছে শরীর।
আরও পড়ুন- পরপর দশবার হার্ট অ্যাটাক ঐন্দ্রিলার! শেষরক্ষা কি হবে না
কয়েক ঘণ্টার আশা। ঐন্দ্রিলাকে ফের জিতিয়ে দিয়েছিল সময়, জিতিয়ে দিয়েছিল হাজার মানুষের শুভচিন্তা। শনিবার রাতে দেখা যায় সব্যসাচী ফেসবুক থেকে ঐন্দ্রিলা সংক্রান্ত সব পোস্ট মুছে দিয়েছেন। অথচ গত কয়েক দিন ধরেই ঐন্দ্রিলার শারীরিক অবস্থা নিয়ে লাগাতার পোস্ট করেছিলেন তিনি। সব্যসাচীকে পোস্ট মুছে ফেলতে দেখে আশঙ্কা ঘনীভূত হয়, উৎকণ্ঠা একসময় স্তিমিত হয়। যুদ্ধে বিরতি টানেন ঐন্দ্রিলা। বিরতি, ইতি নয়।
২০১৫ সালে যখন স্কুলপড়ুয়া ঐন্দ্রিলা প্রথম জানতে পারেন তাঁর অস্থিমজ্জার ক্যান্সারের কথা। তারপর দিল্লিতে চিকিৎসা, একাধিক কেমোথেরাপির পর ২০১৬ সালে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন ঐন্দ্রিলা। কাজে ফেরেন, প্রেমে পড়েন, যোদ্ধার সুসময় খিলখিলিয়ে ওঠে জীবনবৃক্ষে। ২০২১ সালে আবার ডান দিকের ফুসফুসে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার ধরা পড়ে। ফের কেমোথেরাপি, ফের অবিশ্বাস্য যন্ত্রণার, ডুকরে ওঠা, শরীর ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া ব্যথা, মরে যেতে পারলে বেঁচে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি। জীবন তবু তো আলোর মতো শক্তিমান, আবারও জিতলেন ঐন্দ্রিলা। ক্যান্সারকে কিস্তিমাত করে ফিরলেন। সব্যসাচীর হাত ধরলেন। এবছর আবার স্ট্রোক! তবে এবারের স্ট্রোক আর ফেরাল না ঐন্দ্রিলাকে।
যখন ক্যান্সারকে হারিয়ে শুটিং ফ্লোরে ফিরেছিলেন ঐন্দ্রিলা ঝলমলিয়ে উঠেছিলেন সতীর্থরা। সদ্য টিন-এজ পেরনো মেয়ে জানিয়েছিলেন, কাজ করতেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন। বলেছিলেন, “আসলে কেমো নেওয়ার পর যে আবার কাজ করতে পারব, সেটা ভাবিনি। সেটা করতে পারছি। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।” ঐন্দ্রিলা জানিয়েছিলেন, লড়তে তাঁকে হবেই। হাসতে হাসতে লড়বেন না কি কাঁদতে কাঁদতে এই নির্বাচনটা তাঁর। ঐন্দ্রিলা, এমন এক যোদ্ধা, যাঁর নির্বাচন পালটে দিয়েছে বহু আগামী যোদ্ধার সিদ্ধান্ত। ঐন্দ্রিলা জানতেন, তরঙ্গ মিলায়ে যায়, কুসুম ঝরিয়া পড়ে, আর ঐন্দ্রিলা বুঝতেন, ফের ফুল ফোটে, ফের ঢেউ আসে, কেবল অনন্তই সত্য, কেবল বেঁচে থাকাটাই লড়াই। “আমি শুধু জানি আমাকে লড়তে হবে, আমি লড়ছি,” ঐন্দ্রিলার ফেলে যাওয়া কথামালা একদিন কুড়িয়ে নেবেনই কোনও পথিক।
আরও পড়ুন- ‘মিরাকল’ না কি বিজ্ঞান, ঐন্দ্রিলা ফিরে এলেন মানুষের ইচ্ছাশক্তিতেই?
চিকিৎসকরা বলছেন, ক্যান্সার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে গেলে স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকেই। ক্যানসার ছাড়াও অবশ্য স্ট্রোক হয় নানা কারণে। ঐন্দ্রিলার দেহের ক্যান্সার আক্রান্ত বিষাক্ত কোশ কি তবে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে গিয়েছিল? চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, ধাপে ধাপে মারণরোগ এভাবেই এগোয়। শেষমেশ মাথায় গিয়ে আঘাত করলে যদি স্ট্রোক হয়, তা ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ের লক্ষণ। রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি যেখানে চলে, অদ্ভুত নীরবতা। সুস্থ মানুষ সেখানে গেলে মুখ ঢেকে যেতে বলা হয়। বাইরে সার দিয়ে অপেক্ষমান মানুষ। জীবনের শেষ পাড়ানির কড়ি দিয়েও যারা সেরে উঠতে চাইছেন। ধুঁকতে থাকা, কেমোর লিক্যুইড সমেত ঝোলানো বোতল, গলা ফুটো করে নল ঢোকানো, রেডিয়েশনের চড়চড়ে ঘা নিয়ে রোগী, রোগীর পরিজন নীরবে চলতে থাকা টিভিতে চোখ রাখেন, শব্দ নেই শুধু দৃশ্য। শুধু দৃশ্য, শুধু আনাগোনা, শুধু কখন ছুটি হবে হাসপাতাল থেকে জিজ্ঞাসা, কখন এই পৃথিবীর আয়োজনে ফিরে যাওয়া যাবে, কখন নিজস্ব ঘরে, নিজস্ব ছাদে বসে মানুষ বাজারের ফর্দ লিখবে, জমানো ছুটি থেকে দিঘা ঘুরে আসবে, জমানো কাজ সেরে একে একে তালিকা কমাবে- এসব ওই নীরব টিভির দৃশ্যের মতো আনাগোনা করে মাথায়। সেখানে ঐন্দ্রিলার মুখ ফুটে ওঠে, হাসি ফুটে ওঠে। এমন হাসিমুখের কাছে সময় রাজার মতো এসেও হিসেব চাইতে ডরায়। জীবনের কাছে, ইচ্ছাশক্তির কাছে কী হিসেব চাইবে সময়?
কেমোথেরাপির জন্য স্ট্রোক হয় না। তবে স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়েও। ২/৩ খানা কেমোথেরাপির পর এসব কথা এই রোগাক্রান্তদের কাছে জলভাতের মতোই শোনায়। সমস্ত বমি বমি ভাব, খিদে না পাওয়া, চরম দুর্বলতা, চুল উঠে যাওয়া, সারা দেহের ঘা, পেটের সমস্যা, রক্তাল্পতা, জীবনের অনীহা পেরিয়ে যখন একজন ঐন্দ্রিলার মুখের দিকে তাকান মনে হয়, এত আনন্দ আয়োজনে সামিল না হতে পারাটা কোনও কাজের কথাই নয়। ঐন্দ্রিলার থেমে যাওয়া আসলে একটা লড়াইয়ের শুরু, সারা বাংলার মানুষের ইচ্ছাশক্তির এখানেই জয়। এখানেই জয় ময়দান না ছেড়ে যাওয়ার জোরের। ঐন্দ্রিলা হাল ছাড়েননি বলেই, লাখে লাখে ঐন্দ্রিলারা হাল ছাড়ার আগে লড়বেন। যতক্ষণ এক কণা প্রাণবায়ু দেহে আছে ঐন্দ্রিলারা কাজে থেকে যাবেন। মৃত্যুর রঙ ফ্যাকাশে হতে পারে, জীবনের রঙ সবসময়ই উজ্জ্বল। জীবনের শব্দ আইসিইউ, ভেন্টিলেশন, হাজারো নল, মনিটরের বিপ বিপের চেয়ে তীব্র।
ঐন্দ্রিলারা প্রাণময়, তাই আমরা বাঁচি।