টলি কেলেঙ্কারি: বিস্ফোরক হিসাব খাতা ফাঁস! চরম দুর্নীতি সিনেমাপাড়াতেও?
Tollygunge Audit Scam: ফেডারেশনের জমা করা তিন বছরের (২০১৯ থেকে ২০২১) অডিট রিপোর্ট হাতে পেয়েছে ইনস্ক্রিপ্ট। ছত্রে ছত্রে আর্থিক তছরুপের চিহ্ন স্পষ্ট! এত টাকা যাচ্ছে কোথায়?
টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র জগতে নানা গিল্ডের সদস্য হতে গেলেই নিয়মের বাইরে গিয়ে চাঁদা দিতে হয়, যে চাঁদা বৈধ নয়, আগের দুই কিস্তিতেই তা নিয়ে নানা কথা হয়েছে। আর এই চাঁদার বড় অংশ ফেডারেশনের হাতে যায় যার আবার কোনও অডিটই হয় না বলে অভিযোগ। অডিট তো হয়, তবে তা কেমনভাবে হয় তা খতিয়ে দেখেছিল ইনস্ক্রিপ্ট। টালিগঞ্জের প্রবীণ সহকারী পরিচালক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় এই অডিটের অনিয়ম বিষয়ে আরটিআই করেছিলেন। সেই আরটিআইয়ের ভিত্তিতে পাওয়া ফেডারেশনের জমা করা তিন বছরের (২০১৯ থেকে ২০২১) অডিট রিপোর্ট হাতে পেয়েছে ইনস্ক্রিপ্ট। বেনিয়মের যে অভিযোগ উঠছে, তা এই রিপোর্টে সামান্য চোখ বুলালেই নজরে পড়বে। তিন বছরের অডিট রিপোর্টে যে সমস্ত অসঙ্গতি রয়েছে তা ভয়াবহ। এখানে আবারও উল্লেখ্য, সরকারিভাবে ফেডারেশনের সদস্য মাত্র ২৪ জন, বহুদিন ধরেই। তাহলে সমস্ত গিল্ড বা অ্যাসোসিয়েশন যাদের ফেডারেশন নিজেদের আওতায় দেখায়, তারা কারা? তারা আসলে ফেডারেশনের সদস্য নন, ফেডারেশনের অ্যাফিলিয়েশন প্রাপ্ত মাত্র।
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন, স্বরূপ বিশ্বাস দাবি করেন যে শেষ দশ বছরে ফেডারেশনের সদস্য হয়েছে নাকি ৮ থেকে ১০ হাজার জন! অথচ ফেডারেশন যে অ্যানুয়াল রিটার্ন জমা দেয় তাতে বলা আছে সদস্য সংখ্যা ২৪ জন। অর্থাৎ আইনত ৮০০০ বা ১০০০০ মেম্বারই নেই। তাঁর দাবি, ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকা দিতে হয় গিল্ডের নতুন সদস্য হতে গেলে। এই টাকার বড় অংশ যায় ফেডারেশনের ঘরে। যার কোনও হিসেব নেই।
ফেডারেশন চলচ্চিত্রজগতের কর্মীদের কল্যাণের জন্য কাজ করছে বলে দাবি করে। তাহলে এ কেমন কল্যাণের নমুনা অডিটে ফুটে উঠছে? ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ সদস্যরাও কি একবারও অডিট রিপোর্টে চোখ বুলিয়েছেন? এই অডিট রিপোর্ট বলে দিচ্ছে, টালিগঞ্জের আসল চিত্র। খোলস উন্মোচন হোক তবে ধীরে ধীরে?
পড়ুন প্রথম পর্ব- টলি কেলেঙ্কারি: সিনেমাপাড়ায় থ্রেট কালচারই শেষ কথা?
এই ছবিটি ২০১৯ সালের অডিট রিপোর্টের একটি পাতা। বাঁদিকে যেখানে ‘আয়’ লেখা, সেই কলামটি খতিয়ে দেখা যাক। সেখানে অ্যাফিলিয়েশন ফিজ হিসেবে ৮২,২৫৫ টাকা দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে, যে ২৬টি ইউনিয়ন ফেডারেশনের অ্যাফিলিয়েশন প্রাপ্ত তারা বাৎসরিক চাঁদা হিসেবে এই টাকাটা দিয়েছে। কিন্তু এর পরেই লেখা আছে নতুন মেম্বারশিপ বাবদ ফেডারেশন ৮২,৩০০ টাকা আয় করেছে। ফেডারেশনের সদস্য সংখ্যা, আগেও উল্লিখিত, ২৪। বহু বছর ধরেই এই সংখ্যা অপরিবর্তিত। তাহলে নতুন সদস্যদের থেকে টাকাটা কীভাবে উঠে এল? এটা কি ‘উপহার’ বা অ্যাসোশিয়েশনের যে সমস্ত নতুন সদস্যরা কার্ড পেলেন তাদের ‘জয়েনিং ফি’-র একটা অংশ? আগের পর্বেও উল্লিখিত হয়েছে যে, গিল্ডগুলি নতুন সদস্যদের কার্ড দেয় চাঁদার বদলে, আর সেই টাকার একটা অংশ ফেডারেশনের কাছে চলে যায় বলেই অভিযোগ। ফেডারেশন এই টাকা আইনত নিতে পারে? এর থেকেও ভয়ানক তথ্য আছে এই রিপোর্টে একটু নীচেই।
FCTWEI (অর্থাৎ ফেডারেশন) লেভি বাবদ আয় দেখাচ্ছে ৩,৮৬,৩৫০ টাকা। লেভি মানে চাঁদা। এই প্রায় ৪ লক্ষ টাকা চাঁদা ফেডারেশনকে কে দিল? তার মাত্র ২৪ জন সদস্য? যেহেতু অ্যাসোশিয়েশন বা গিল্ড বাবদ যে রোজগার তারা দাবি করছে সেটা আগেই দেখিয়ে দেওয়া আছে, তাহলে নিয়মমতে এই ২৪জন সদস্য ছাড়া চাঁদা আর কেউ দিতে পারে না! কে দিল এই ৩,৮৬,৩৫০ টাকা? এর কোনও স্বীকৃতি নেই, প্রমাণও নেই। আরও এগোনো যাক। AIFEC থেকে ফেডারেশন ৩৮,৬৩৫ টাকা লেভি পেয়েছে বলে দাবি করছে। AIFEC হলো সর্বভারতীয় এক সংস্থা ফেডারেশন যার সঙ্গে অ্যাফিলিয়েটেড। ঠিক যেভাবে গিল্ডগুলিও ফেডারেশনের সঙ্গে অ্যাফিলিয়েটেড। অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী ফেডারেশনকে AIFEC টাকা দিচ্ছে! ফেডারেশন AIFEC থেকে স্বীকৃতি পায় বলে AIFEC তাকে চাঁদা দেয়? এমন অদ্ভুত নিয়ম অন্য কোনও দেশে ঘটে কি?
খুব সামান্য ভাবলেই এই হাস্যকর বিষয়টি ইন্ডাস্ট্রির মানুষদেরও চোখে পড়ার কথা। কলকাতায় বসে গিল্ডগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ফেডারেশন চাঁদা নিচ্ছে। আর সর্বভারতীয় স্তরে নিয়মটাকে ঠিক উল্টে দিয়ে AIFEC-র স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তার থেকেই টাকা নিচ্ছে ফেডারেশন? এখানে চাঁদার সংখ্যাটাও খুব মজার। কলকাতা থেকে পাওয়া চাঁদার অঙ্ক থেকে মাত্র একটা শূন্য তুলে দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এবার আসা যাক ডানদিকে খরচের কলামে। সেখানে ৩ লক্ষ ২৪ হাজার টাকার একটা খরচা দেখানো হয়েছে যা নাকি উকিলের খরচ। কীসের জন্য উকিল লাগছে? ‘Trade Dispute’ মেটানোর জন্য। প্রথম কথা, ফেডারেশন একটি ট্রেড ইউনিয়ন, ‘Trade dispute’ মেটানো তার কাজ নয়। তার আইনি এখতিয়ারের মধ্যেই কাজটা পড়ে না। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায় যে তারা সেটা করছে — অর্থাৎ কোনও প্রযোজক টেকনিশিয়ানদের টাকা বাকি রেখেছে এবং সেখানে ফেডারেশন হস্তক্ষেপ করছে এই জাতীয় কোনও ঘটনা — এইরকম কোনও বিষয়ে ফেডারেশন কি কোনও আদালতে মামলা করেছে? চলচ্চিত্র জগতের ওয়াকিবহাল মহল বলছে, এমন কোনও ঘটনা তাদের জানা নেই। তাহলে ফেডারেশন কীভাবে উকিলের খরচ বাবদ এই খরচাটা দেখাল? এবারে যাওয়া যাক পরের ছবিটিতে।
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- টলি কেলেঙ্কারি: স্বরূপ বিশ্বাসের উত্থান কখন, কীভাবে, কতটা?
২০১৯-এর খরচের বাকি হিসাবই রয়েছে এই ছবিটিতে। একটু নীচের দিকেই একটা ভয়ানক তথ্য রয়েছে! এমার্জেন্সি মিটিং বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে, ৩০ লক্ষ ৬৬ হাজার ৯৫৭ টাকা! এমার্জেন্সি মিটিং-এ এত টাকা খরচা! ২০১৯ সালে ফেডারেশনের কী এমন এমারজেন্সি পড়ল যে তাকে সেই মিটিং বাবদ সাড়ে ৩০ লক্ষ টাকার বেশি খরচা করতে হলো? বছরের প্রত্যেকদিন তিনবেলা এমার্জেন্সি মিটিং করলেও এর অর্ধেকও খরচ হওয়ার কথা নয়। অ্যাকাউন্ট সামলাতে না পেরে গল্পের গরু গাছ থেকে সটান মহাকাশে তুলে দেওয়ার উদাহরণ নয় কি এটা? আসা যাক পরের ছবিতে।
২০২০ সালের অডিট রিপোর্ট, রোজগারের খাতায় অভাবনীয় সব তথ্য দেওয়া হয়েছে এখানে। শুরুতেই ২০১৯ সালের মতোই অসঙ্গতি চোখে পড়বে। অর্থাৎ অ্যাফিলিয়েশন ফিজ নেওয়ার পরেও লেভি বাবদ ফেডারেশন ৩ লক্ষ টাকারও বেশি আয় দেখাচ্ছে। এই লেভি কে দিচ্ছে তা অবশ্য কোথাও স্পষ্ট নয়। সর্বভারতীয় সংস্থা AIFEC ফেডারেশনকে তাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি নেওয়ার জন্য নাকি ৩০ হাজার ৭৪৫ টাকা দিচ্ছে! এগনো যাক।
কোভিডের সময় অনুদান বাবদ ফেডারেশন আয় দেখাচ্ছে ১ কোটি ২৫ লক্ষ ৪৮ হাজার ৮৫৭ টাকা! ২০২০ সালের অ্যাকাউন্ট, কোভিড মহামারী, লকডাউনের চক্রে এই বছর প্রায় কোনও শুটিংই কলকাতায় হয়নি। সেখানে ১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকার উপর ডোনেশন ফেডারেশনকে কে দিল? তার কোনও হিসেব ফেডারেশন দিয়েছে কি?
এখানেই শেষ নয়, কোভিডকালীন অনুদান ছাড়াও ১০ লক্ষ ৯৭ হাজার ৬২৫ টাকার আয় দেখানো হয়েছে যা নাকি ফেডারেশনের ওয়েলফেয়ারের জন্য কোনও সহৃদয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ ফেডারেশনকে দিয়েছেন। এরা কারা? যে বছর কোনও কাজই হয়নি হঠাৎ সেই বছরেই ফেডারেশনের আয় এইভাবে বেড়ে যাচ্ছে কীভাবে?
এই বছর নতুন সদস্যপদ বাবদ ফেডারেশন রোজগার করেছে ৫ লক্ষ ২৫ হাজার ৪১০ টাকা। টালিগঞ্জের অন্দরের ওয়াকিবহাল মানুষরা নিশ্চিত করেছেন যে, ফেডারেশনের কোনও নতুন ‘সদস্য’ হয়নি। যদি হয়েই থাকে তাহলে সেগুলো গিল্ড বা অ্যাসোশিয়েশনের নতুন সদস্য। যার টাকা এমনিতেই ফেডারেশনের পাওয়ার কথা নয়। তারপরেও, যে বছরে প্রায় কোনও শুটিংই হলো না সে বছরে অ্যাসোশিয়েশনগুলি এত মেম্বারশিপ ইস্যু করলই বা কীভাবে যে তার থেকে ফেডারেশন পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি রোজগার করল?
এরপর আরও একটা পরিসংখ্যানে চোখ আটকাতে বাধ্য। ‘ডিসপিউট’ মিটিয়ে ফেডারেশন আয় দেখাচ্ছে ৭ লক্ষ টাকা। ২০১৯ সালেই ফেডারেশন এই কাজের জন্য মোটা অঙ্কের উকিলের খরচা দেখিয়েছিল। ২০২০ সালে সেখান থেকে ফেডারেশন ৭ লক্ষ টাকা রোজগার কীভাবে করল? ফেডারেশন কি ঝামেলা মেটানোর জন্য কমিশন নিচ্ছে?
আয় যত আজগুবি, ব্যয় ততোধিক বিচিত্র! ডানদিকে ব্যয়ের খাতায় ফেডারেশন আবার আগের বছরের মতোই ‘ডিসপিউট’ মেটাতে উকিলের খরচা দেখিয়েছে ৩ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা (আগের বছরের সঙ্গে সংখ্যাটা হুবহু মিলে যাচ্ছে)। উকিল ছাড়াও ডিসপিউট মেটাতে ফেডারেশন নাকি খরচা করেছে ৫ লক্ষ ৫৯ হাজার ৯৫৬ টাকা। একটু আগেই হিসেবে দেখা গেছে সেই বছরই ডিসপিউট মিটিয়ে ফেডারেশন রোজগার করেছে ৭ লক্ষ টাকা। হিসেবের উদো-বুধোর পিণ্ডি চটকে গিয়েছে তা অনুমেয়! এত খরচ আছে অথচ কোভিডের বছরে দাহকার্য, চিকিৎসার খরচা, বার্ধক্যভাতা ইত্যাদি খাতে ফেডারেশন খরচ দেখাচ্ছে শূন্য!
পরের ছবিতে আসা যাক, এটিও ২০২০ সালের খরচেরই হিসাব।
এই ছবিটার একটু নীচের দিকে কিছু অবিশ্বাস্য খরচের তালিকা চোখে পড়বে। কোভিডের বছরে ফেডারেশন বিভিন্ন গিল্ডের সদস্যদের হাতে নাকি নগদ ৭২ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা তুলে দিয়েছে। আমরা এই প্রতিবেদন লেখার সময় ইন্ডাস্ট্রির বহু সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছি। এই পরিমাণ নগদ তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হলে তা কারও অজানা থাকার কথা নয়। প্রশ্ন উঠছে, যারা কিশোর কুমারের জন্মদিনে বড় ইভেন্ট করে, তারা চলচ্চিত্র কর্মীদের হাতে ৭২ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা কোভিডের বছরে তুলে দিল কোনও প্রচার বা প্রকাশ ছাড়াই? চুপি চুপি কাউকে না জানিয়ে ৭২ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা কর্মীদের দেওয়া হল অথচ সংবাদমাধ্যম বা সমাজমাধ্যমেও তার কোনও প্রচার নেই কেন? এর বাইরেও নাকি শুধুমাত্র স্যানিটাইজার এবং মাস্ক বাবদ ফেডারেশন খরচা করেছে ৩২ লক্ষ ১৪ হাজার ৫৪৬ টাকা।
আরও পড়ুন- মালয়ালম সিনেজগতে মহিলারা কতটা নিরাপদ? প্রকাশ্যে রিপোর্ট! টালিগঞ্জ কবে মুখ খুলবে?
আসা যাক পরের ছবিতে।
২০২১ সালের হিসাব। এও কোভিডেরই বছর। এই বছরও ফেডারেশন কোভিড বাবদ অনুদান পেয়েছে ১ লক্ষ টাকারও বেশি। ‘ওয়েলফেয়ার’ বাবদ ডোনেশনও আছে। সেটার পরিমাণ ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। আর নতুন মেম্বারশিপ বাবদ ফেডারেশন পেয়েছে ৮ লক্ষ ১৩ হাজার টাকার একটু বেশি। আবারও উল্লেখ্য, ফেডারেশনের মেম্বারশিপ সংখ্যা খাতায়-কলমে কিন্তু মাত্র ২৪ জন। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিতে হয় যে গিল্ডের নতুন মেম্বারদের থেকে ফেডারেশন টাকা তুলছে (যা সম্পূর্ণ বেআইনি), তাও সেই সংখ্যা ৮ লক্ষ টাকায় গিয়ে কীভাবে দাঁড়ায়? ২০২১ সালে কতজন নতুন সদস্য ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছেন যে গিল্ডগুলো তার সদস্যপদের টাকা রেখে দেওয়ার পরেও ফেডারেশনের ঘরে ৮ লক্ষের বেশি টাকা জমা পড়ল?
নতুন মেম্বারশিপ বাবদ ৮ লক্ষ টাকা রোজগার করেও ফেডারেশন ক্ষান্ত দেয়নি। লেভি, অর্থাৎ তাদের সদস্যদের থেকে চাঁদা তুলেছে ৩ লক্ষ ২৮ হাজার ৬৫০ টাকা। গিল্ডের সাধারণ সদস্যরা কি এই তথ্যগুলো জানেন? তাঁদের সঙ্গে কথা বলে অবশ্য আমরা এই বিষয়ে অন্ধকারেই থেকেছি। AIFEC-র সদস্য থাকার জন্য ফেডারেশন আবারও AIFEC থেকে টাকা নিয়েছে! পৃথিবীতে কোনও সংস্থা অন্য সংস্থাকে তাদের মেম্বার হওয়ার জন্য টাকা দেয় বলে জানা নেই। আবারও সংখ্যাটা মজার। সদস্যদের থেকে পাওয়া লেভির অঙ্ক থেকে একটা শূন্য তুলে দিয়ে সংখ্যাটা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথমটা ৩,২৮,৬৫০ আর দ্বিতীয়টা ৩২,৮৬৫!
খরচের বিষয়ে আসা যাক, ২০২১ সালেও ফেডারেশন ডিসপিউট মেটাতে উকিলের খরচ বাবদ ১ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা খরচা দেখিয়েছে। সেই ডিসপিউট আসলে কী, এর পরিণতি কী হলো তার কথাও আমরা চলচ্চিত্রজগতের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারিনি। ২০১৯ সালের মতোই ২০২১ সালেও ঘটা করে ফেডারেশন কিশোর কুমারের জন্মদিন পালন করেছে। কোভিড তখনও সম্পূর্ণ বিদায় নেয়নি। অথচ খরচ আগের বছর থেকেও অনেকটা বেড়ে গিয়ে প্রায় ১ লক্ষ টাকার কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন টেকনিশিয়ান ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন, এই অনুষ্ঠান করার জন্য ফেডারেশন ইন্ডাস্ট্রিতে ছুটি ঘোষণা করে দেয়। সাধারণ মানুষের একদিনের কাজ বন্ধ করে লক্ষ টাকা খরচা করে কিশোর কুমারের জন্মদিন পালন করা কি ফেডারেশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? পরের এবং শেষ ছবিতে আসা যাক।
২০২১ সালেরই খরচের হিসেব রয়েছে এখানে, যেখানে দেখা যাচ্ছে গত বছরের মতোই ২০২১ সালেও ফেডারেশন স্যানিটাইজার ও মাস্ক বাবদ ১০ লক্ষ ৪২ হাজার ৮৮৫ টাকা খরচা করেছে। ‘প্রোটেস্ট র্যালি’ করে নাকি ফেডারেশন খরচ করেছে ৫ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার বেশি! ২০২১ সালে কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় ফেডারেশন কার বিরুদ্ধে এত প্রতিবাদ করে ৫ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার বেশি খরচা করল কোনও সদস্যই আমাদের জানাতে পারেননি। তাঁরা বলছেন, এরকম কোনও প্রতিবাদ মিছিলের কথা তাঁরা জানেনই না।
এজিএম অর্থাৎ অ্যানুয়াল জেনারেল মিটিং বাবদ ফেডারেশন ২০২১ সালে খরচা দেখিয়েছে ৪ লক্ষ ৬৩ হাজার ৬০৮ টাকা। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে এই একই মিটিংয়ের জন্য ২ লক্ষ ৬০ হাজার ৬৮০ টাকা খরচা হয়েছিল। ২০২১ সালে প্রায় দ্বিগুণ খরচা হলো কেন? এছাড়াও ফেডারেশন ওই বছর বিজ্ঞাপন খাতে ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা খরচা দেখিয়েছে। ফেডারেশন বাণিজ্য করে না, জনসেবাও করে না। তাহলে ফেডারেশন কোন বিজ্ঞাপন খাতে কেন খরচা করল?
এই অসঙ্গতিগুলি বুঝতে ইনস্ক্রিপ্ট পরিচিত বেশ কয়েকজন ইনকাম ট্যাক্স আইনজীবী এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সকলেই এই অডিট রিপোর্ট দেখে হেসে বলেছেন, এই অ্যাকাউন্টে প্রতি ছত্রে আর্থিক তছরুপের চিহ্ন প্রবল!এই অডিট রিপোর্ট কি ফেডারেশন তার সদস্যদের এবং ইন্ডাস্ট্রির কলাকুশলীদের সঙ্গে শেয়ার করে? করলেও কি কোনও আলোচনা বা প্রশ্ন করা হয়? আলোচনা বা প্রশ্ন করার অবকাশও কি এই বিনোদন জগতে আছে?
আরও পড়ুন- যারা ফিতে কাটছে পারিশ্রমিক নিয়ে, বেশ করছে! শিল্পীদের সময়ের দাম আছে বইকি
প্রবীণ সহকারী পরিচালক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ইনস্ক্রিপ্টকে আরও একটি ঘটনা জানিয়েছেন। তিনি বলছেন, কিছু বছর আগে ইলেকট্রিশিয়ান গিল্ডের প্রাক্তন একজন অফিস-বেয়ারার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। নিরাপত্তার কারণেই নাম এখানে অনুল্লিখিত। সেই সময় ইলেকট্রিশিয়ান গিল্ড তাঁকে দেড় বছরের জন্য সাসপেন্ড করে রেখেছিল। এই ব্যক্তি ছিলেন স্বরূপ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠজনদের বিরোধী গোষ্ঠী। নির্বাচনের পরে এদের হাত থেকে স্বরূপ গোষ্ঠীর লোকজন ইলেকট্রিশিয়ান গিল্ড দখল করে। সেই সময় এই ব্যক্তিকে বলা হয় যে, তাঁর সময়কালে ইলেকট্রিশিয়ান গিল্ডে ৭ লক্ষ টাকার অনিয়ম হয়েছে। সেই কারণেই তাঁকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সাসপেন্ড করা হচ্ছে। তিনি আর ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে পারবেন না। এই ব্যক্তি পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান। তাঁর পক্ষে অডিটের গণ্ডগোল বোঝা অসম্ভব। ততদিনে প্রায় দেড় বছর কেটেও গিয়েছে। একটি কারখানায় দুশো টাকা দিনমজুরিতে তিনি কাজ করেন। গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন তিনি এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে আত্মহত্যার করার কথা ভাবছেন। এখানে উল্লেখ্য, প্রথম পর্বেই আমরা বহিষ্কার ও তার ফলে আত্মহত্যার চেষ্টার কথা লিখেছি। একইরকমভাবে বেআইনি বহিষ্কারের কারণে কেশসজ্জাশিল্পী তনুশ্রী দাস আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় আইনের বিষয়ে কিঞ্চিৎ পারদর্শী, এই খবর পেয়েই নিরুপায় হয়ে এই ইলেকট্রিশিয়ান ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বিগত বছরের অডিট রিপোর্ট নিয়ে আসতে বলেন, যা খুঁটিয়ে পড়ে তিনি বুঝতে পারেন সেখানে কোথাও এক পয়সারও কোনও গণ্ডগোল নেই। ওই ব্যক্তির অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সাসপেন্ড করেছে স্বরূপ বিশ্বাসে ঘনিষ্ঠ লোকজনদের দ্বারা পরিচালিত ইলেকট্রিশিয়ান গিল্ড।
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ই ওই ব্যক্তির হয়ে বিস্তারিত চিঠি ইলেকট্রিশিয়ান গিল্ডকে লেখেন। পরবর্তীতে তাঁকে ইলেকট্রিশিয়ান গিল্ডের অফিসে ডেকে পাঠানো হয়। গিল্ডের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে তিন ঘণ্টার বৈঠক হয়। সেখানে আলোচনা হয় যদি এই ইলেকট্রিশিয়ান ভদ্রলোক আদালতে মামলা করেন তাঁদের বিরুদ্ধে, তাহলে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ভয়ানক বিপদে পড়বেন। হিসেবে যে কোনও গণ্ডগোলই ছিল না তাও ফাঁস হয়ে যাবে, আর যে অডিটরকে দিয়ে পূর্বতন এক্সিকিউটিভ কমিটি অডিট রিপোর্ট তৈরি করেছিল, হিসাবে গণ্ডগোল থাকলে আইনত তার দায় বর্তাবে অডিটরের উপরে। যে অভিযোগে ইলেকট্রিশিয়ানকে সাসপেন্ড করা হলো, সেই একই অভিযোগে অভিযুক্ত অডিটরকে দিয়ে আবারও কেন অডিট করানো হলো তা কোর্টে ব্যাখ্যা করা সমস্যার হয়ে দাঁড়াবে। বেগতিক বুঝে স্বরূপ ঘনিষ্ঠ সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি তড়িঘড়ি সাসপেনশন তুলে নেন।
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন,
"সামান্য বিরোধিতা আছে এমন বহু লোককেই স্বরূপ-ঘনিষ্ঠ লোকজন দ্বারা পরিচালিত গিল্ডগুলি সাসপেন্ড করে রেখেছে। ভয়ে এই নিয়ে কেউ কোনও কথাই বলে না। এই ছেলেটি আমার কাছে এসেছিল এবং এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল তা সহজেই খণ্ডন করা যেত। সেই কারণে ও বেঁচে যায় কিন্তু বহু লোকের সেই সৌভাগ্য হয় না। অনেক বয়সে পেশা পাল্টে অনেক কম মজুরিতে তাদের জীবন কাটাতে হয়।"
বহিষ্কারের জুজু দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে বহু টেকনিশিয়ানেরই, জানিয়েছেন ইন্ডাস্ট্রির এক দীর্ঘদিনের কর্মী-অভিনেতাও। এই ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রেখেই কি যথেচ্ছ আর্থিক দুর্নীতি চালানো হচ্ছে? অডিট রিপোর্টের অসঙ্গতি তো তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই লক্ষ লক্ষ টাকা, যার সঠিক হিসেব মিলছে না, তা আসলে কীসে ব্যবহৃত হচ্ছে? টেকনিশিয়ানদের উন্নতিতে যে হচ্ছে না তা জানিয়েছেন প্রবীণ থেকে নবীন বহু কর্মীই। তাহলে এই টাকা যাচ্ছে কোথায়? অভিযোগ, শাসকের কাছেই যাচ্ছে দুর্নীতির বকেয়া। টালিগঞ্জও কি তবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-রেশনের মতো আর্থিক দুর্নীতির পাঁকে ডুবে গেল?
(বাকি, আগামী কিস্তিতে)