উপন্যাসের নামে রাস্তার নাম! কলকাতাই করে দেখিয়েছে!

স্বর্ণলতা স্ট্রিট। কলকাতার এক অল্পচেনা রাস্তার নাম। না কোনো উনিশ শতকীয় মনীষার নামে নয়। এই রাস্তার নাম হয়েছিল এক উপন্যাসের নামে। উপন্যাসের লেখক তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আজ এক বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়। আসুন সেই পথ খুঁজতে খুঁজতেই নির্মাণ করা যাক তারকনাথের লেখাজীবনের এক ছবি।

মধ্যবিত্ত জীবনের রোজনামচা, সংসার সীমান্তে তাদের প্রতিদিনের লড়াই, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের জীবনচরিতকে তারকনাথ সাহিত্যের মূল উপজীব্য করে তুলেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র যখন বাংলার সাহিত্যাকাশে একপ্রকার সূর্যের ন্যায় বিরাজ করছেন ঠিক তখনই তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সচেতন দূরত্ব বজায় রেখেছেন বঙ্কিমি শৈলী থেকে। এমনকী তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের অতিরিক্ত রোমান্টিকতার বিরোধিতাও করেছিলেন সরাসরি। তারকনাথের মনে হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস যেন প্রকৃত অর্থে বাংলা ও বাঙালির মননকে ছুঁয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে শুধুমাত্র সাহিত্যিক নন, তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রকৃত অর্থেই ছিলেন একজন সব্যসাচী। তৎকালীন সময়ে সার্জেন্ট হিসেবেও যথেষ্ট পরিচিত পেয়েছিলেন বর্তমান সময়ে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাওয়া তারকনাথ।

১৮৪৩ সালের ৩১ অক্টোবর। নদিয়া জেলার বাগআঁচড়া গ্রামের আকাশের মুখ সেদিন গম্ভীর। সারাদিন অবিশ্রান্ত কান্নার পরেও রেহাই মেলেনি তার, এখনও একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে সে। পথের দু'পাশের গাছগুলো আকাশের বুকে মাথা ঠুকে মরতে চাই যেন। এমনই এক বৃষ্টিমুখর দিনে জন্ম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের । পিতা মহানন্দ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন প্রকৃতঅর্থেই একজন ধার্মিক ব্যক্তি। সেদিনের সেই একরত্তি দুরন্ত শিশুটিকে দেখে কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন পরবর্তী সময়ে এই শিশুই হয়ে উঠবে একাধারে সাহিত্যিক আবার অন্যদিকে চিকিৎসক? অথচ মহাকালের অমোঘ নিয়মে সেটাই একসময় সত্যি হলো।

নদিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম বাগআঁচড়ায় জন্ম হলেও সেখানে বেশিদিন থাকা হয়ে ওঠেনি তারকনাথের। বাবা মহানন্দ চাইতেন ছেলে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে উঠুক। সেই আশাতেই মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি তারকনাথকে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায়। না, কল্লোলিনী তিলোত্তমার ডাককে উপেক্ষা করতে পারেননি তারকনাথও। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই কলকাতা আপন করে নিয়েছিল তাকে। খুড়তুতো ভাই অম্বিকাচরনের কাছে থেকে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলেন তারকনাথ। শিক্ষাজীবন শুরুর প্রথম দিন থেকেই তিনি ছিলেন যথেষ্ট মেধাবী, যার স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন আজীবন। সালটা ১৮৬৩, কলকাতার ভবানীপুর মিশনারি সোসাইটির স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তারকনাথ ভর্তি হলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে। লক্ষ্য দেশের মানুষের সেবা করা।১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে এল. এম. এস পাশ করেন তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। এভাবেই ছাত্রজীবন শেষ হলো নদিয়ার একরত্তি তারকনাথের।

এরপর তারকনাথের জীবনের উত্তরণের দিন এল। হ্যাঁ, ছাত্রজীবন শেষের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তারকনাথকে। একাধারে চিকিৎসক অন্যদিকে সাহিত্যিক দুই শাখাতেই তিনি হয়ে উঠেন অপরাজেয়।১৮৬৯ সাল নাগাদ এল. এম. এস পাশ করার পর তারকনাথ তার কর্মজীবন শুরু করলেন সহকারী অ্যাসিসটেন্ট সার্জেন হিসাবে। কর্মসূত্রে একসময় বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে চরকিবাজি করেছেন তারকনাথ, কাজ করেছেন ভ্যাকসিন সুপারিনটেনডেন্ট রূপে। সেই সময় খুব কাছ থেকে দেখেছেন বাংলার মানুষের জীবন প্রণালী। আট থেকে আশির প্রাণের সুর শুনেছেন তারকনাথ, যা থাকে পরবর্তী জীবনে দিয়েছে সাহিত্য সৃষ্টির রসদ। তারকনাথের উপন্যাসের প্রতি পাতায় পাতায় যেন খোঁজ মেলে গ্রামবাংলার হৃদস্পন্দনের।

বাংলাদেশের রাজশাহী। এই রাজশাহী দেখেছে বাংলায় পুন্দ্র সাম্রাজ্যের বিস্তারকে, রাজশাহীর বুকেই বেড়ে উঠেছেন বাংলার সেন বংশের রাজা বিজয় সেন। পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহর সাক্ষী সেন বংশের বহু গৌরবগাথার। ইতিহাসকে যেন বুকে করে আগলে রেখেছে পদ্মাপারের রাজশাহী। সেন বংশের রাজত্বের পর পদ্মা দিয়ে গড়িয়ে গিয়েছে বহু জল। এই শহরের কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যেই একদিন রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। রাজশাহী পুলিশ লাইনে মুক্তিযোদ্ধাদের সেই হার না মানা লড়াই আজও অনেকে স্মৃতিতে অমলিন। কিন্তু তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে এই লেখায় হঠাৎ রাজশাহীর নাম কেন? হ্যাঁ তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজশাহী শহর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আসলে সাহিত্যে তো কোনো সীমারেখা হয় না, সে কাঁটাতার মানতে শেখেনি। তাই নদিয়ার সেই দামাল ছেলেটা একসময় জড়িয়ে পড়েছে পদ্মাপারের রাজশাহীর সঙ্গে।

তারকনাথের সাহিত্যিক জীবনের হাতেখড়ি হয় বাংলাদেশের রাজশাহী শহর থেকেই। বলতে গেলে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্যের অ-আ-ক-খ শিখেছিলেন এই রাজশাহীর মাটি থেকেই। 'জ্ঞানাঙ্কুর' পত্রিকা তারকনাথকে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রথম সুযোগ করে দেয়।১৮৮২-৭৩ সালে ' স্বর্ণলতা' নামক একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় 'জ্ঞানাঙ্কুর' পত্রিকায়। তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই পাঠকমহলের কাছে অজানা। অথচ এমন এক নব্য লেখক এর উপন্যাস পাঠকদের চমৎকৃত করল। আর করবে নাই বা কেন? 'স্বর্ণলতা' উপন্যাসটির পাতায় পাতায় গ্রাম বাংলার কাঁচা মাটির গন্ধ। বাংলার মানুষের প্রাণের সুরকে তারকনাথ তুলে এনেছিলেন দুই মলাটের মধ্যে। তারকনাথের পায়ের তলায় ছিল সরষে, চিকিৎসক রূপে তিনি সমগ্র উত্তরবঙ্গকে চষে ফেলেছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। এমনকি পরবর্তীকালে তারকনাথ সেন্ট্রাল জেলের চিকিৎসক পদে অভিষিক্ত হন।

চিকিৎসক হিসেবে সমগ্র উত্তরবঙ্গকে যে তিনি রীতিমতো ' রেইকি' করে ফেলেছিলেন তার প্রমাণ মেলে তার সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে।১৮৭৪ সাল নাগাদ ' স্বর্ণলতা' বইটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়, যদিও লেখকের নাম ছিল না তাতে। বইটি প্রকাশ করেছিলেন যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখকের  নাম না থাকলেও প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তারকনাথের জীবদ্দশাতেই বইটির প্রায় সাতটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তৃতীয় সংস্করণ পর্যন্ত তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম প্রকাশিত হয়নি। পরিস্থিতি এমন বিপদজনক জায়গায় পৌঁছেছিল যে বহু স্বনামধন্য লেখক 'স্বর্ণলতা' বইটিকে নিজের বলে দাবি করেন।

অবশেষে পাঠকমহলের সব জল্পনা-কল্পনার অবসান শেষে চতুর্থ সংস্করণে প্রকাশিত হলো লেখকের নাম - তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তবে সামগ্রিকভাবে ঘটনাটাকে যতটা সহজ বলে মনে হচ্ছে গোটা ব্যাপারটা তত সহজ ছিল না। কারণ মিতভাষী তারকনাথ ছিলেন বরাবরের জন্য প্রচারবিমুখ। সাহিত্যিক ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তারকনাথকে রাজি করান চতুর্থ সংস্করণে  লেখকের নাম প্রকাশের বিষয়ে।' স্বর্ণলতা ' উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ করেন দক্ষিণাচরণ রায়। এখানেই থেমে থাকেনি উপন্যাসটির বিজয়রথ। স্টার থিয়েটারে উপন্যাসটির নাট্যরূপ ' সরলা' দীর্ঘদিন ধরে দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছিল, যার মূল কান্ডারী ছিলেন অমৃতলাল বসু।

অবশ্য শুধু ' স্বর্ণলতা' উপন্যাস নয়, তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন ' হরিষে বিষাদ' ' অদৃষ্ট' - এর মত উপন্যাস। 'স্বর্ণলতা' উপন্যাসটি পাঠক সমালোচক মহলে সমাদৃত হলেও অন্যান্য উপন্যাসগুলির ভাগ্যে সেই অর্থে শিকে ছেঁড়েনি। স্বয়ং সুকুমার সেন ' স্বর্ণলতা' উপন্যাসটি সম্পর্কে বলেছিলেন - " প্রণয়মূলক রোমান্টিক আবেদনের বাইরে সাংসারিক সুখ দুঃখময় প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা পরায়ণ নর-নারীকে অহরহ যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সেরূপ একটি সমস্যা অবলম্বন করে লেখা সর্বপ্রথম বাঙালি গার্হস্থ্য উপন্যাস হলো তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ' স্বর্ণলতা।' এই স্বর্ণলতার নামেই পরবর্তীকালে ম্যাডক্স স্কোয়ারের কাছে একটি রাস্তা তৈরি হয়।

অবশেষে বাংলাসাহিত্যের বুকে আরো একবার নেমে এলো কালবেলা।২২এ সেপ্টেম্বর ১৮৯১ সালে মৃত্যু হয় তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের। বাংলা সাহিত্যের একটি অধ্যায় যেন সমাপ্ত হল ' স্বর্ণলতা' - র স্রষ্টার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

 

তথ্যসূত্র:-

১. wikisource.org

৩.https://pagefournews.com/archives/31595

More Articles