তপন সিংহ বলতেন, 'চারুলতার থেকেও তোমার আরতিকে আমার বেশি ভালো লাগে'
প্রথম 'মহানগর'-এর আরতির জন্য ডাক পাওয়াটা মনে পড়ে। সত্যজিৎ রায়ের তরফ থেকে দূর্গা সেন এবং অনিল চৌধুরী এসে বলেন, সত্যজিৎ রায় ডেকে পাঠিয়েছেন, বাড়ির ঠিকানা ৩ নম্বর লেক টেম্পল রোড। তখন সত্যজিৎ রায় ওই ঠিকানায় থাকতেন, মেনকা সিনেমা হলের কাছাকাছি। আমি তখন মাকে বলেছিলাম, "এখান থেকে ট্যাক্সিভাড়াও অনেক। আমাকে দেখে সত্যজিৎ রায়ের পছন্দ হবে না। গিয়ে লাভটা কী হবে?" মা বললেন, "ডেকে পাঠিয়েছেন যখন, তখন একবার যাওয়া উচিত!" এই কথোপকথন চলছে যখন, তখন দুর্গাবাবু আর অনিলবাবু আবার ফিরে এলেন, এসে বললেন, ট্যাক্সিভাড়াটা রাখুন। তখন যেন একটু লজ্জা পেয়ে ওটা নিতে চাইনি, কিন্তু ওঁরা জোর করে ট্যাক্সিভাড়াটুকু দিয়ে গেলেন।
সত্যজিৎ রায় তখন তিনতলা বা চারতলায় থাকতেন সম্ভবত, যত দূর মনে পড়ে। আমি গেলাম, ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। তখন 'অভিযান'-এর আউটডোর চলছে। সত্যজিৎবাবু বললেন, "আমি আউটডোর থেকে ফিরে এসে আবার কথা বলব।" আমি তখন ভাবলাম, পাত্র-পাত্রী দেখার সময়ও তো এমন কথা হয়, পরে কথা হবে বলে আর হয় না। ওই নিয়ে আমি আর বিশেষ ভাবিনি। কিন্তু ফিরে এসে আবার ডাকলেন আমাকে। 'মহানগর'-এর চিত্রনাট্যটা শোনালেন এবং আমার হাতে দিলেন সেই চিত্রনাট্য। তখন বুঝলাম, হয়তো সত্যিই আমি কাজটা করছি।
চিত্রনাট্য পড়লাম। নরেন্দ্রনাথ মিত্রর গল্প। গল্পটা সময়োপযোগী। তখন সময়টা এমনই ছিল, বাড়ির মেয়েরা কাজে বেরলে তা নিয়ে সংসারে অশান্তি হত। আমার তো তখন সংসার ছিল না। ফলে, আরতির মতো অশান্তি আমার ক্ষেত্রে হয়নি। যাই হোক, দশ দিন বা বারো দিন টানা শুটিং হয়েছিল, মনে পড়ে। সেই সময় চোখে একটা আঞ্জনি হল। আমি খুবই ভয় পেয়েছিলাম, সিনেমায় যদি দেখা যায়! কিন্তু এমনভাবেই শট নিয়েছিলেন, কিছুই বোঝা যায়নি ছবিতে।
আরও পড়ুন: ‘যে তোমার গায়ে হাত তোলেনি কক্ষনও, সে এসেছে’, ফিসফিস করে বললেন মানিককাকা
'মহানগর'-এর আরতি সংসারের প্রয়োজনেই কাজ করতে বেরিয়েছে। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, সকলের আপত্তি আছে তাতে। সেসব আপত্তি এড়িয়েও যখন সে বেরল, তখন আস্তে আস্তে তার আত্মবিশ্বাস তৈরি হল। একটা দৃঢ় প্রত্যয়ও তৈরি হচ্ছিল তার। আরতির খ্রিস্টান সহকর্মী এডিথ সিমনস-কে অসম্মান করা হল যখন, তখন সে রেজিগনেশন দিয়ে দিতেও দেরি করেনি। তার স্বামী সুব্রতরও তখন চাকরি নেই, চাকরি ছেড়ে তার মুখোমুখি হতে ভয় পেয়েছিল আরতি। কিন্তু তারপর সেই শেষ দৃশ্য, যেখানে আরতি বলে, "এত বড় শহর, এতরকম চাকরি, দু'জনের একজনও কি পাব না একটা?" সুব্রত বলে, "চেষ্টা তো করি, আমার বিশ্বাস, দু'জনেই পাব।" বলে দু'জনেই হাঁটতে থাকে শহরের রাস্তায়। এই যে আরতির যাওয়া-আসা, মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়ের অভিনয়, এটা করতে অসুবিধে হয়নি। কারণ, আমি তো সেই ছোটবেলা থেকেই অভিনয় করছি। সেই ছ'সাত বছর বয়স থেকেই। তাছাড়া 'মহানগর'-এর আগে ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের ছবি করেছি। তাই একটা শিক্ষালাভও হয়েছিল। আর আমি তো এই মধ্যবিত্ত পরিসরটাকে চিনি, কাজেই আরতির অভিনয় আমার কাছে খুব কঠিন মনে হয়নি। আর অভিজ্ঞতার কথা ভেবে তো অভিনয় করি না আমরা, চরিত্র নিয়ে ভাবি, অভিজ্ঞতা আপনিই হয়ে যায়। বাকিটা ভাবেন পরিচালক, কীভাবে তিনি প্রেজেন্ট করবেন, সেটা তাঁরই ওপর। সেক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায় ছিলেন নিখুঁত।
আরতির চরিত্রায়ণ অনেকেরই খুব প্রিয়। আরতি যেমন ওই সময়ের, তেমন আবার সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়েই। তপন সিংহ বলতেন, "চারুলতার থেকেও তোমার আরতিকে আমার বেশি ভালো লাগে।" আমার কাছে 'মহানগর'-এর আরতি, 'চারুলতা', বা 'কাপুরুষ'-এর করুণা- সবক'টাই খুব প্রিয়। প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা। আর সত্যজিৎ রায়ের কাজ বলে এগুলো বেশি প্রিয়। সত্যজিৎ রায়ের কাজের বিশেষত্ব ছিল, তাঁর ছবিতে প্রেম আছে, সম্পর্ক আছে, কিন্তু তার শালীনতা কখনও মাত্রা ছাড়ায়নি। ওঁর কোনও ছবিতে এমন অশালীন কিছু নেই, যা সকলে মিলে বসে দেখা যায় না। এবং, প্রতিটি চরিত্র কোথায় বিলং করে, তা বোঝা যায়। বোঝা যায়, এটা আমার দেশেরই ছবি, আমার ভাষারই ছবি। এখন তো চরিত্রদের শিকড় বোঝা যায় না, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কিন্তু তা স্পষ্ট।