লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভিনকে মনে রাখবে বিবেকহীন সময়?

Farida Parvin: বাংলাদেশের নাটোরে ১৯৫৪ সালে জন্ম গ্রহণ করেন লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভিন। হিন্দুস্থানি ধ্রুপদী সংগীতের সুরসপ্তক রপ্ত করা ফরিদার জীবন শুরু হয় নজরুলগীতি ও দেশাত্মবোধক গান দিয়ে।

স্মৃতি সততই উদাস, মলিন ও ভঙ্গুর। সে উড়ে যায়, ক্ষয়ে যায়, আড়াল হয়ে যায়, চাপা পড়ে যায় জাগতিক নানা হিসেব নিকেশে। তারপরও কোথাও কখনও রঙ-রূপ-গন্ধ আর সুরে স্বরে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। সে হারায় না বরং ক্রমে এক নিদারুণ ইতিহাস হয়ে মনমাঝারে গেঁথে দেয় স্মৃতির সরগম। সেখানে সুরের প্রাবল্য থাকে ঢের। এই কথাগুলো আমি বলছি না। এরই ধারে কাছের কথা বলছেন প্রখ্যাত মনোবিশ্লেষক আর ডি ল্যাঙ। আমরা মানতে পারি বা নাও মানতে পারি। তথাপি একথা নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণ হয়েছে যে গান বা সুর মানুষকে অবচেতন থেকে এক চৈতন্যের ডাক পাঠায়। স্মৃতি তখন ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম থেকে পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। সে তখন বর্ণময় অতীতের দিক নির্দেশ করে। আমরা ভুলে যাওয়া নানা ঘটনাকে মনের গভীরে দেখতে পাই। স্মৃতি তখন সজীব হয়ে ওঠে। ডানা মেলে পাখির মত এডালে সেডালে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় কখনও বা আকাশ উড়ানে। আমাদের মননের বাতিঘরগুলো জ্বলে ওঠে, হয়ে ওঠে ক্রিয়াশীল। আমরা টের পাই সব হারায়নি।থেকে গেছে কিছু। তার হাত ধরে আরও কিছু খুঁজে পাই।

এইসব আবোলতাবোল কত কি ভাবছিলাম লালনগীতির স্বনামধন্য গায়িকা ফরিদা পারভিনের প্রয়ানের খবর পেয়ে। প্রকৃতপক্ষে ফরিদা আপাকে আমি শুধুমাত্র একজন গায়িকা বলে মনে করি না। তাঁকে মনে হয় একজন অত্যন্ত মেধাবী সুরসাধিকা হিসেবে। এপার ওপার, দুপার বাঙলায় গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে নামী-অনামী শত শত গায়ক গায়িকার কন্ঠে লালনের গান শুনেছি। কিন্ত ফরিদা পারভিনকে সব দিক থেকেই, সবসময়ই অনন্য ও ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে। তার অন্যতম কারন হল একজন সেই অর্থে আর্বান গায়িকা হিসেবে তিনিই অন্যতম যিনি গানের মধ্যে দিয়ে লালনের পদকে যথার্থ অনুভবে পরিবেশন করেছেন। প্রতি নিয়ত চেষ্টা করেছেন লালন সাঁই-এর গানের প্রত্যন্তে গিয়ে তাঁর নিজস্ব জীবনকে উপলব্ধি করতে। শুদ্ধস্বর ও উচ্চারণে লালনের গানকে সুরমন্ডলে চিত্রিত করেছেন। সূক্ষ্ম তানে তার মধুর কন্ঠস্বর যেমন চড়ায় উঠেছে তেমনই আবার খাদে উনি প্রযুক্ত করেছেন  টেনর এবং বেস এর মধ্যবর্তী ব্যারিটোন। লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে যা দুর্লভ। তাই বলতে সাধ হয়, উনিই এই উপমহাদেশের এমন এক অন্যতম গায়িকা ইংরেজিতে যাকে বলে কমপ্লিট মিউজিশিয়ান।

আরও পড়ুন- ধর্মীয় বিভেদের রাজনীতির বাড়বাড়ন্তে আতঙ্কিত বাংলার ফকিররা

প্রথম পরিচয়েই তিনি অত্যন্ত আন্তরিক হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশে, এদেশে বা বিদেশে, যেখানেই দেখা হয়েছে আমরা ডুবে গেছি লালন সাঁইজির পদ ও সুরের গভীর আড্ডায়। কলকাতায় এলে আমাদের টালিগঞ্জের আখড়ায় (স্টুডিও) আসতেন। একবার গানে আড্ডায় রাত বারোটা বেজে গিয়েছিল। আমাদের কারও একবারের জন্যও সময়ের কথা মনে হয়নি। আসলে তিনি এই ধরনের আলোচনা, আড্ডা ও পিঠোপিঠি গান পছন্দ করতেন। ফরিদা আপার স্বামী গাজি আব্দুল হাকিম ছিলেন সুশিক্ষিত ও দুরন্ত একজন বংশীবাদক। গাজি সাহেবের সাথেও গানবাজনা নিয়ে তুমুল আড্ডা হয়েছে দিনের পর দিন। একবার তিনি অত্যন্ত যত্ন নিয়ে এই অধমকে বুঝিয়ে ছিলেন কন্ঠস্বর ও বাঁশির স্কেলের তারতম্য।

একবার ফরাসি দেশে যাচ্ছি। মাঝে ট্রানজিটে মধ্যপ্রাচ্যের একটি এয়ারপোর্টে কফি খাচ্ছি। পাশের টেবিলে বাংলাদেশি কয়েকজন যুবক আলোচনা করছে যে তাঁরা ফরিদা আপাকে সামারের কোনো উৎসবে প্যারিসে গান গাওয়ার জন্য নিয়ে যেতে চায়। আমার কানে আসতেই উপযাচক হয়ে তাদের সাথে আলাপ করি। ওই রাতেই ফোনে ফরিদা আপাকে যোগাযোগ করি। উনি ওদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেই সেই অনুষ্ঠান করতে সম্মত হয়ে যান। আরেকবার এক কলকাতার সাংবাদিক ভাই আমাকে অনুরোধ করে যদি ফরিদা পারভিনের একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিই। ওনাকে ফোন করতেই বলেন, আমার নম্বর দিয়ে দাও আর তোমার কথা বলে ফোন করতে বলো আমি টাইম বলে দেব। আসলে অহেতুক আমার এই সব কথা বললাম এই কারণে যে ফরিদা আপা বিখ্যাত হলেও ছিলেন ইজিলি অ্যাক্সেসেবল। একদম সাধারণ ও মাটির মানুষ।

পূর্ণদাস বাউলকে উনি শ্রদ্ধা করতেন। সুবলদাস বাউলের গুণগ্রাহী ছিলেন। কিন্তু আফসোস করতেন গৌর ক্ষ্যাপার সঙ্গে দেখা না হওয়ার জন্য। একবার এক আড্ডায় বলেছিলেন, 'এই যে গ্রামে যাই অনুষ্ঠান করতে বা বেড়াতে, তখন প্রকৃতির সঙ্গে একটা বোঝাপড়া, একটা মিলমিশ তৈরি হয়। সে সময় লালন সাঁইজির কিছু কিছু গান করলে একটা অন্য মাত্রার সন্ধান পাওয়া যায়। শহরে তো সে অবকাশ নেই।' লালনের গানের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওঁর মতো অঝোরে কাঁদতে আর কাউকে দেখিনি। বোঝা যেত যে লালন সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বা পড়িয়ে বলছেন না। উনি সাঁইজিকে জেনেছেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। আপা বলতেন ওনার ঐকান্তিক অনুভবের মধ্যে দিয়ে, লালনের আত্মার সংলগ্ন হয়ে। উনি বলেছিলেন, 'দেখো ভাই গানের কোনও সীমান্ত নেই, কাঁটাতার নেই। গানের ভাষা বিশ্বজনীন। আমার মাটি আমার বাংলাদেশ, আর আমি বাংলা ভাষায় তা পরিবেশন করছি, আমার পরিচয় ওইটুকুই।'

আরও পড়ুন- ‌ছোঁয়াচে রোগী বলে জ্যান্ত ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীতে! লালন ফকিরকে ঘিরে আছে যে অজানা কাহিনি

বাংলাদেশের নাটোরে ১৯৫৪ সালে জন্ম গ্রহণ করেন লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভিন। হিন্দুস্থানি ধ্রুপদী সংগীতের সুরসপ্তক রপ্ত করা ফরিদার জীবন শুরু হয় নজরুলগীতি ও দেশাত্মবোধক গান দিয়ে। গেয়েছেন অসংখ্য বাংলা আধুনিক গান। পরবর্তীকালে শুরু করেন লালন সাঁই-এর গান। সেই সুরছন্দেই কাটিয়ে দেন বাকি জীবন। লালনের গানে তাঁর অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের একুশে পদক পান। ১৯৯৩ সালে তিনি "অন্ধ প্রেম" চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ মহিলা প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও ফুকাকাওয়ার মতো আরও কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। তিনি লালন সাঁই-এর গানের সংরক্ষণের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। লালনগীতির একনিষ্ঠ সাধক, প্রচারক ফরিদা পারভিন একাত্তর বছর বয়সে কিডনির অসুখ প্রয়াত হলেন কদিন আগে। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা লোকসঙ্গীত তথা লালনগীতির এক অপরিসীম ক্ষতি হয়ে গেল।

তিনি চলে গেলেন কিন্তু ইতিহাসবিজড়িত তাঁর গান থেকে গেল। থেকে গেল তাঁর কন্ঠমাধুর্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তিনি জানিয়ে গেলেন শুধু গান করলেই হবে না। প্রয়োজন শিক্ষা ও সাধনার। গান শিখতে হলে বা শুনতে হলে পদ ও সুরের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। জেনে নিতে হবে তার মর্মার্থ। প্রেম রাখতে হবে। গুরু ধরে শিখতে হবে। গানে, আলোচনায়, কথায় বারবার ফরিদা আপা সঙ্কটের কথা বলেছেন, বলেছেন পুনরুত্থানের কথা, সতর্ক করেছেন মূল্যবোধের অবনমন সম্পর্কে। প্রশ্নের হল এই বিবেকহীন সময়, ইতিহাস বিস্মৃত সমাজ তা কতটা গ্রহণ করবে।

More Articles