দুর্ঘটনায় একা হয়ে যাওয়া, আদরের উপোস! কাবেরী বসুকে যেভাবে চিনেছি

Kaberi Basu: দুর্ঘটনার পরে কাবেরী বহুদিন সিনেমা করেনি। অনেকদিন পরে কাবেরী সিনেমায় ফিরল সত্যজিৎ রায়ের 'অরণ্যের দিনরাত্রি' ছবিতে...

তুমি শঙ্খবতি নারী। স্ত্রী-জাতির একতমা।

এই কথা বলে আমি কাবেরীর শাঁখের মতো গলায় আলতো চুমু দিলাম।

কাবেরী বসুর গলায় তিনটি রেখা। যেমন থাকে শাঁখের গায়ে। কাবেরী, তুমি সত্যিই শঙ্খিনী! জানালাম কাবেরীকে।

একথা কেউ তো আগে বলেনি। তাতে কি দেখতে আমাকে বেশি সুন্দর লাগে?

জানতে চায় কাবেরী। সে হাসে। সেই হাসি, যা আমাকে বারবার বধ করে।

আমি বলি, কাবেরী, ওই তিন রেখা তোমার কণ্ঠের ভূষণ।

কালিদাস? সামান্য তির্যক চেয়ে প্রশ্ন করে কাবেরী।

আমি হেসে বলি, না গো, কালিদাস নয়। রসমঞ্জরী।

কাবেরীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ সত্যজিৎ রায়ের 'অরণ্যের দিনরাত্রি'-র পরে। সিনেমায় নেমেই মাত করে দিল। চোখ-ঝলসানো সুন্দরী। কিন্তু ভারি নরম, কোমল সুন্দরী। যার কাছে আমার মন আরাম পায়। কাবেরী সিনেমায় এসেই উত্তমকুমারের নায়িকা। কী বিপুল মানাল উত্তম-কাবেরীকে!

আরও পড়ুন: মহাভারতে সতীত্বের কোনও চিহ্ন নেই, বলেছিলেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত

Kaberi Bose

'অরণ‍্যের দিনরাত্রি' ছবিতে

কাবেরী গাড়িতে স্বামী আর বাচ্চাদের নিয়ে পড়ে গেল দার্জিলিংয়ের খাদে। সবার মৃত্যু হলো। কাবেরী আর এক মেয়ে রইল বেঁচে। কাবেরীকে তখনও আমি চিনি না। শুধু সিনেমায় দেখি। আর মুগ্ধ হই। দুর্ঘটনার পরে কাবেরী বহুদিন সিনেমা করেনি। শুনলাম, কাবেরী বেঁচে আছে বটে, কিন্তু সিনেমায় অভিনয় করার মতো আর শরীর নেই তার।

অনেকদিন পরে কাবেরী সিনেমায় ফিরল সত্যজিৎ রায়ের 'অরণ্যের দিনরাত্রি' ছবিতে এক সুন্দরী, তরুণী, বিধবার ভূমিকায়। মেয়েটি দারুণ সেক্সি এবং চোখে, মুখে, ঠোঁটে, বুকে, ঘামে ভেজা পিঠে, এবং ব্রা-র লাইনে লাইনে সেক্স-উপোসী। সত্যজিৎ রায় সেই উপোস কাবেরীর সারা অঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। কাবেরী অভিনয়ে এনেছে সেই যৌন উপোস। এমন সুন্দরীর এত উপোস! এই ভাবনাটুকু আমাকে পাগল করে দিল।

আমি কাবেরীকে ফোন করলাম ইন্টারভিউ-র জন্য। এবং ফোনে প্রথম আলাপ গড়িয়ে গেল অপ্রত্যাশিত আন্তরিকতায়। কী মিষ্টি গলা! কী সুন্দর আলাপের বিন্যাস ও ভঙ্গি। আমি কাবেরীর প্রেমে পড়লাম নতুন করে। তার কণ্ঠের মধ্যে কোথাও যেন লুকোনো উপোস, মনে হলো আমার।

কাবেরীর ফ্ল্যাট। সে একা। আমি প্রথম তার মুখোমুখি। সে আমার জন্য নিজেই চা বানিয়ে নিয়ে এসে পটে চা ঢালছে। তাঁতের শাড়ি। স্লিভলেস ব্লাউজ। চা ঢালতে গিয়ে আলগা হলো আঁচল। দেখা দিল গভীর, মসৃণ, ঘামে আর্দ্র, বিপজ্জনক বিভাজিকা। কাবেরী উদাসীন। আমার মুগ্ধতা ঝাঁপ দিল সেই কোমল কুহকে।

সেদিন চা খেতে খেতে কাবেরীকে কী বললাম, আপনাদের বলি। শুরু করলাম আচমকা, এইভাবে:

কাবেরী, আমি শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত পড়ি ষোলো-সতেরো বছর বয়সে। রাজলক্ষ্মী আমাকে মুগ্ধ করল। কিন্তু আমার হৃদয় নিংড়াল বৈষ্ণবী কমললতা, যার ডাকনাম কমলিলতা। কাবেরী, আমি আজও ভুলতে পারিনি কমললতার সঙ্গে আলাপের প্রথম মুহূর্ত। বৈষ্ণবীর বয়স তিরিশের বেশি নয়। সে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। ঠিক যেমন তোমার গায়ের রং। যে রং আমার স্বপ্ন।

Kaberi Bose

'রাইকমল' ছবিতে কাবেরী বসু

কাবেরী হাসে। আবার আলগা হয় আঁচল। আবার দেখা দেয় চোখ ও মনের আরাম, সেই ভিজে ভিজে বিভাজিকার বিহ্বল বহতা! কাবেরী থাকে তার অলস অথচ বোধ-উজ্জ্বল উদাসীনতায়!

কাবেরী, সেই বৈষ্ণবী আমাকে কী বলল জানো?

কী?

বলল, কী গোঁসাই, চিনতে পারো?

আমি বললাম, কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে।

বৈষ্ণবী বলল, বৃন্দাবনে গো।

কিন্তু বৃন্দাবনে আমি তো কখনও যাইনি।

সে বলল, গেছ বইকি। অনেক কালের কথা। ভুলে গেছ। মনে করিয়ে দিচ্ছি। ঘরে এসো।

আমি বললাম, কাল আসব। আজ থাক।

সে বলল, কেউ তোমাকে সাবধান করে দেয়নি? বোষ্টুমির জাল ছিঁড়ে অত সহজে বেরিয়ে যাওয়া যায় না।

হঠাৎ কাবেরী একেবারে নিথর। যেন ঝড় ওঠার আগে বাতাস। তারপর কাবেরী উঠে আসে। নিচু হয়ে। ঝরে পড়ে আঁচল। আর রূপদু'টি আগ্রহী ফলের মতো। কাবেরী আদর হয়ে ওঠে। তার রাহুগ্রস্ত শরীরের সে সহজিয়া অন্তরঙ্গতা কোনওদিন ভুলবে না আমার শরীর। সেই রতি, সেই আখর চিরদিনের। সেই সোহাগ। সেই আশ্লেষ। আর ফিরবে না জীবনে। আমার জীবনে এই একটি বিরহ চিরদিনের।

তাকে যতবার ছুঁয়েছি, মনে হয়েছে আদরের নারী-রূপকে ছুঁলাম। আদরকেই আদর করলাম।

রোজ ফোন আসত, একদিন এলো না।

খবর পেলাম সংবাদপত্রে। কাবেরী হাসপাতালে।

ক্যানসার হয়েছিল। জানতে দেয়নি।

হঠাৎ চলে গেল!

More Articles