অস্তিত্ব সংকটে অ্যামাজন! তেল আগ্রাসনের বলি ৪০০-রও বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী

Amazonas River : এছাড়া এখানে ৪০০-র বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে, যাদের মধ্যে অনেকেই এখনো বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগহীন। সুকুরিজু ও আশপাশের অঞ্চলগুলো তাই শুধুমাত্র পরিবেশগত নয়, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক সংকটের মুখে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কল্পলোক থেকে বাস্তব জগতে নেমে আসা এক নদীবেষ্টিত গ্রামের নাম সুকুরিজু। অ্যামাজন নদীর মুখে, ম্যানগ্রোভে ঘেরা এই স্থান যেন সময়ের বাইরে টিকে থাকা এক জৈব-সামাজিক বাস্তুতন্ত্র। এখানে জীবন চলে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে, চন্দ্রচক্রের গতিপথে— প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য ছন্দে। অথচ এই সমন্বিত জীবনধারার বুকে বারবার থাবা বসিয়েছে এক আধুনিক দানব, তেল শিল্প। সুকুরিজু আজ দাঁড়িয়ে আছে অস্তিত্বের প্রান্তরেখায়— নতুন করে তেল খননের পরিকল্পনা শুধু তার নিজস্ব জীবিকা ও সংস্কৃতিকেই নয়, গোটা অ্যামাজনের উপকূল ও বৈশ্বিক পরিবেশ ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

ব্রাজিলের নিরক্ষীয় উপকূল বরাবর বিস্তৃত অঞ্চলটিকে ‘ইকুয়েটোরিয়াল মার্জিন’ বলা হয়। এটি শুধু একটি ভূগোলিক পরিভাষা নয়, বরং তেল কোম্পানিগুলোর নয়া আগ্রাসনের কেন্দ্রবিন্দু। সুকুরিজু এই অঞ্চলেই অবস্থিত, যেখানে ব্লক ৫৯ নামের একটি অফশোর তেল ব্লক নিয়ে এখন চলছে তীব্র টানাপোড়েন। ১৯৭০-এর দশক থেকেই এখানে তেল অনুসন্ধান চলছে। তখন ব্রিটিশ কোম্পানি শেল প্রথম হেলিকপ্টারে করে তেল কর্মীদের এনে গ্রামের হৃদয়ে ঘাঁটি তৈরি করেছিল। গ্রামবাসীদের ভাষায়, “ওই প্রথম আমরা বুঝতে পারি বাইরের দুনিয়া আমাদের জীবনে হস্তক্ষেপ করতে পারে।”

তবে প্রকৃত খনন কার্যক্রম শুরু হয়নি। পেট্রোব্রাস ২০২০ সালে ফরাসি কোম্পানি টোটাল এবং ব্রিটিশ বিপি-এর কাছ থেকে ব্লকগুলো অধিগ্রহণ করে। এই অধিগ্রহণ এমন এক সময়ে হয় যখন প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আওতায় বিশ্ব তীব্রভাবে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের আহ্বান জানাচ্ছে। পেট্রোব্রাসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিন পিটার প্রেটো এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য সব সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে চাই।” কিন্তু এই ‘উন্নয়ন’-এর সংজ্ঞা আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

গবেষণাভিত্তিক সাংবাদিকদের যৌথ প্রকল্প ‘এভরি লাস্ট ড্রপ’ অনুসারে, পেট্রোব্রাস ব্লক ৫৯-এ খননের জন্য যে পরিবেশগত বিশ্লেষণ জমা দিয়েছে, তাতে সঠিক বিপদ বিশ্লেষণ অনুপস্থিত ছিল। প্রস্তাবিত জরুরি তেল ছড়ানোর প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা (oil spill response plan) পুরাতন প্রযুক্তিনির্ভর ও অপ্রতুল। এমনকি পেট্রোব্রাস স্বীকার করেছে যে যদি সমুদ্র প্রবাহ পূর্বদিকে থাকে, তবে ছড়িয়ে পড়া তেল অ্যামাজনের মুখ দিয়ে সোজা বেলেম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। সেই বেলেম, যেখানে আগামী নভেম্বর মাসে ক'প ৩০ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

এই বাস্তবতা স্বীকার করেও ব্রাজিল সরকার বলছে, তারা তেলের মাধ্যমে 'পরিবর্তনের জন্য তহবিল' জোগাড় করছে। রাষ্ট্রপতি লুলা দা সিলভা আন্তর্জাতিক মহলে নিজেকে পরিবেশবান্ধব নেতা হিসেবে উপস্থাপন করলেও দেশের ভেতরে তিনি তেল কোম্পানির অনুকূলে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ করে দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, 'আমরা এমন এক দেশ, যার অধীনে দারিদ্র্য ও উন্নয়নের ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন।' এই বিবৃতি আদতে উন্নয়নের নামে জীববৈচিত্র্য ও আদিবাসী অধিকারের আপসের ইঙ্গিত বহন করে।

ব্রাজিলের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক নবীকরণ যোগ্য সম্পদ বিষয়ক ইনস্টিটিউট ইবামা-র বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মকর্তারা এই খনন কার্যক্রমের বিরোধিতা করেছেন বহুবার। সুয়ালি আরাউজো, যিনি ২০১৮ সালে ইবামা-র প্রেসিডেন্ট ছিলেন, বলেন, 'অ্যামাজনের মুখে তেল ছড়ালে আপনি তা থামাতে পারবেন না। এটি হলো এমন একটি অঞ্চল যেখানে খনিজ অনুসন্ধান মানেই প্রাণ-ব্যবস্থার ওপরে চরম আঘাত।' তার মতে, পেট্রোব্রাসের পরিকল্পনা শুধুমাত্র ব্লক ৫৯ নয়, বরং এই অঞ্চলের বাকি ব্লকগুলোকেও ভবিষ্যতের খননের জন্য প্রস্তুত করা। এটি একটি সুপরিকল্পিত 'ফুট ইন দ্য ডোর' কৌশল।

সুকুরিজু গ্রামের মানুষদের জন্য এই সংঘাত নিছক পরিবেশগত নয়—এটি অস্তিত্বের লড়াই। ৬৯ বছর বয়সি মৎস্যজীবী আমিরালদো ফেরেইরা বলেন, 'এই ট্যাঙ্কগুলো আর কাজে আসে না। ওগুলো এখন শুধু স্মৃতি। কিন্তু যদি আবার তেল কোম্পানিগুলো ফিরে আসে, তাহলে আমরা যে জলে মাছ ধরি, সেই জলেই বিষ মিশবে।' তার পাশে বসে থাকা বৃদ্ধা মারিয়া কাস্ত্রো যোগ করেন, 'তেল এলেই শিশুরা অসুস্থ হবে, গাছগুলো মরবে, নদী বদলাবে। আমরা শুধু ইতিহাসের দর্শক হয়ে থাকব না।'

ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলের একটি স্বাধীন, অলাভজনক গবেষণা সংস্থা, যার লক্ষ্য অ্যামাজন অঞ্চলের টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ, অ্যামাজন-এর গবেষক ভ্যালেরিয়া পিনহেইরো বলেন, 'এই খনন কার্যক্রম শুরু হলে তা শুধু সুকুরিজুর নয়, গোটা অ্যামাজনীয় বাস্তুসংস্থানের অবনতির সূচনা ঘটাবে।' তিনি উল্লেখ করেন, অ্যামাজনের মুখে ৬০ টির বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাস, যাদের মধ্যে ১০ টিরও বেশি বিলুপ্তপ্রায়। এই অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ, সাভানা, এবং শেলফ লেগুন মিলিয়ে এক দুর্লভ পরিবেশ তৈরি করেছে—যা একবার নষ্ট হলে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, অ্যামাজনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংযুক্ত প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষের জীবন, খাদ্য, পানি ও সংস্কৃতি। এছাড়া এখানে ৪০০-র বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে, যাদের মধ্যে অনেকেই এখনো বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগহীন। সুকুরিজু ও আশপাশের অঞ্চলগুলো তাই শুধুমাত্র পরিবেশগত নয়, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক সংকটের মুখে।

এই পটভূমিতে প্রশ্ন উঠছে—অ্যামাজন নদী, যা প্রতিদিন ২ লক্ষ কিউবিক মিটার পানি নিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত হয়, তার মুখে তেল খননের ঝুঁকি আমরা নেব কোন মূল্যে? ব্রাজিলের ভবিষ্যৎ কি আরেকবার 'উন্নয়নের' নাম করে ঔপনিবেশিক কায়দায় প্রাকৃতিক সম্পদকে বলি দেবে?

এই নদীর রক্তক্ষরণ শুধুমাত্র এক দেশ বা অঞ্চলের বিষয় নয়, বরং এটি এক বৈশ্বিক ইকো-রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। সুকুরিজু তাই এক প্রতীক—প্রাকৃতিক ভারসাম্য, আদিবাসী জীবিকার ব্যবস্থা, ও নীরব শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের। কিন্তু এই প্রতীক আজ আবারও ঝুঁকিতে। যদি আমরা এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ব্যর্থ হই, তবে ইতিহাসে লেখা থাকবে—আমরা জেনেও চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম।

 

তথ্যসূত্র :

Agência Pública, 2024. “Every Last Drop” সিরিজ রিপোর্ট।

Imazon ও Instituto Socio Ambiental (ISA) গবেষণা প্রতিবেদন, 2023-2024।

Interviews from Amazônia Real, 2022–2024 archive।

More Articles