কয়লার কালো ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে হাসদেওয়ের সবুজ ভবিষ্যৎ!

Arand forest: বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে আদানি এন্টারপ্রাইজেস ও তাদের সহযোগী সংস্থা RRVUNL PEKB। পরিবেশবিদ ও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, কোম্পানি পরিবেশগত ও সামাজিক মানদণ্ড উপেক্ষা করছে।

SS

মধ্য ভারতের ফুসফুস ছত্তিশগড়ের হাসদেও আরন্দ বনাঞ্চল। প্রকৃতির সুইস ব্যাংক। তবে এই ব্যাংকে এখন কেবল সবুজ নয়, জমছে ধোঁয়া। সুরগুজা থেকে সুরজপুর, কোরবা এই বিস্তীর্ণ বনভূমি অসংখ্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের আবাসভূমি। গোঁড আর ওঁরাওরা এই বনকে ধরে রেখেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তাদের জন্য বন মানে কেবল গ্রিনজোন নয়, ধাত্রীদেবতাও। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এই অরণ্যসংকুল অঞ্চল যেন রণভূমির চেহারা নিচ্ছে। একদিকে সরকারের শিল্পোন্নয়নের প্রচেষ্টা, বিশেষত কয়লা খনির প্রসার, অন্যদিকে, বনাধিকার আইন ২০০৬-এর মাধ্যমে স্বীকৃত বনবাসী আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার সংগ্রাম, উত্তপ্ত হয়ে উঠছে বনাঞ্চলের আকাশ-বাতাস।

গত কয়েক বছরে ছত্তিশগড় সরকার একাধিক বেসরকারি সংস্থাকে এই বনাঞ্চলে কয়লা উত্তোলনের অনুমতি দেয়। যার মধ্যে অন্যতম আদানি এন্টারপ্রাইজেস। সবচেয়ে বিতর্কিত প্রকল্প পার্সা ইস্ট ও কান্টা বাসান কয়লাখণ্ড, যা আদানি এন্টারপ্রাইজেস ও রাজস্থান রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন নিগম লিমিটেড -এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত। এই অঞ্চলের সালহি, হরিহরপুর ও ঘাটবারা গ্রামগুলিতে বন অধিকার আইন (FRA)-এর অধীনে কমিউনিটি ফরেস্ট রাইটস বা সম্প্রদায়িক বনাধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। FRA, ২০০৬-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বনবাসী আদিবাসী ও প্রথাগত বননির্ভর জনগোষ্ঠীর অধিকার আইনগতভাবে স্বীকার করা। কোনো বনভূমিকে শিল্প বা খনির কাজে রূপান্তর করতে হলে সংশ্লিষ্ট গ্রামসভাগুলির শর্ত সম্মতি বাধ্যতামূলক। কিন্তু হাসদেওর ক্ষেত্রে এই শর্ত উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে ব্যাপক প্রতিবাদ ও আইনি লড়াই শুরু হয়েছে।

সদ্য এক ঘটনায়, ছত্তিশগড় উচ্চ আদালত এই অঞ্চলের গ্রামবাসীদের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সাম্প্রদায়িক বনাধিকার বাতিলের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছে। আদালতের মতে, এই জমি “জনস্বার্থে” অর্থাৎ কয়লাখনির জন্য প্রয়োজনীয়। রাজ্য সরকারের দাবি, গ্রামবাসীদের কমিউনিটি ফরেস্ট রিসোর্স অধিকার নাকি ভুলবশত দেওয়া হয়েছিল। আদালত রাজ্যের এই যুক্তি মেনে নেয়। কিন্ত এই রায়ের বিরোধিতা করেছেন আইনবিদ, পরিবেশবিদ ও মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের মতে, এটি FRA-এর চরম অবমাননা, কারণ FRA তে স্পষ্টভাবে গ্রামসভার সম্মতি বাধ্যতামূলক করেছে। ইতিমধ্যেই অনুমোদিত CFR বাতিল করা মানে আদিবাসীদের আইন স্বীকৃত অধিকার অগ্রাহ্য করা।

আরও পড়ুন - ভারত বিশ্বের নবম বৃহত্তম বনভূমি! FAO রিপোর্টে নতুন যে তথ্য উঠে এল

কাউন্টারকারেন্টস -এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসদেও অঞ্চলে আদানিকে খনির অনুমতি দেওয়া সংবিধানের পঞ্চম তফসিলের সরাসরি লঙ্ঘন। একইসঙ্গে PESA আইন (১৯৯৬) গ্রামসভাকে স্থানীয় ভূমি ও সম্পদ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেয়, তবে হাসদেওর ক্ষেত্রে দেখা গেছে জোর-জবরদস্তি ও ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে তা আদায় করা হয়েছে। অনেক গ্রামবাসী অভিযোগ করেছেন, তাদের চাকরি ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্মতি নিতে বাধ্য করা হয়েছিল, কিন্তু পরে তা বাস্তবায়িত হয়নি। হাসদেও আরন্দ ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত অঞ্চল। এখানে হাতি, চিতা সহ বহু বিরল প্রজাতির প্রাণীর আবাস। এই বন একটি বিশাল কার্বন সিঙ্ক হিসেবেও কাজ করে।

কয়লা খনির ফলে প্রায় দুই লক্ষাধিক গাছ কাটা হতে পারে। এর ফলে শুধু জীববৈচিত্র্যই নয়, বরং মানব-প্রাণী সংঘাতও বাড়বে। খনির কারণে উচ্ছেদ, জীবিকা হারানো, পর্যাপ্ত পুনর্বাসনের অভাব এইসব কিছু মিলিয়ে স্থানীয়দের অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে‌‌।

এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে আদানি এন্টারপ্রাইজেস ও তাদের সহযোগী সংস্থা RRVUNL PEKB। পরিবেশবিদ ও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, কোম্পানি পরিবেশগত ও সামাজিক মানদণ্ড উপেক্ষা করছে। অভিযোগ, আদানির প্রভাবেই রাজ্য সরকার FRA ও PESA-এর বিধান উপেক্ষা করেছে। জলদূষণ, অবৈধ বর্জ্য ফেলা ইত্যাদি অভিযোগও উঠেছে। কোম্পানির দাবি, তারা সমস্ত আইন ও পরিবেশগত নিয়ম মেনে কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবে সরকারের সিদ্ধান্তে কর্পোরেট প্রভাবের আশঙ্কা স্পষ্ট।

হাসদেও বনবিতর্ক আসলে ভারতের উন্নয়ন মডেল ও আদিবাসী অধিকারের মধ্যে গভীর টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছে। FRA আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল আদিবাসীদের ক্ষমতায়নের জন্য, কিন্তু বাস্তবে তা প্রায়ই উপেক্ষিত। সুপ্রিম কোর্টের উচিত উচ্চ আদালতের রায় FRA ও সংবিধানের মধ্যে কোনো বিরোধাভাসের জায়গা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা । গ্রামসভার প্রকৃত সম্মতি নিশ্চিত করাও জরুরি। পাশাপাশি স্বাধীন ও কঠোর পরিবেশগত আইন প্রয়োজন। তবেই যদি আদিবাসীরা এই অধিকারের পথ খুঁজে পায়।

More Articles