'বর্জ্যের উপনিবেশবাদ'! আমেরিকার ই-বর্জ্যে ডুবে যাচ্ছে এশিয়া
Electronic waste: প্রতি বছর বাড়ছে ইলেকট্রনিক্স ‘ডেড বডি’র সংখ্যা। আর এই বর্জ্যের সুনামি এখন ছড়িয়ে পড়ছে মার্কিন বন্দর পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে।
আজকের স্মার্ট দুনিয়ায় স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবের নতুন মডেল প্রতিদিনই বাজারে আসছে। কিন্তু এই প্রযুক্তির চকচকে আয়নার আড়ালেই জমছে এক অদৃশ্য বিপর্যয়: ই-বর্জ্য। প্রতি বছর বাড়ছে ইলেকট্রনিক্স ‘ডেড বডি’র সংখ্যা। আর এই বর্জ্যের সুনামি এখন ছড়িয়ে পড়ছে মার্কিন বন্দর পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে। বাসেল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (BAN)-এর সর্বশেষ রিপোর্টে উঠে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২,০০০ কুইন্টাল ই-বর্জ্য রফতানি হচ্ছে, যার ওজন প্রায় ৩৩,০০০ মেট্রিক টন। নামমাত্র ‘রিসাইক্লিং’-এর আড়ালে চলছে এক বিশাল আন্তর্জাতিক ব্যবসা। ২০২২ সালে বিশ্বে উৎপন্ন ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৬২ মিলিয়ন টন। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, ২০২৩-২৫ সালের মধ্যে তা পৌঁছাতে পারে ৮২ মিলিয়ন টনে। এই বর্জ্যের বড় অংশই জমা হচ্ছে এশিয়ায়, যেখানে ইতিমধ্যেই বিশ্বের মোট ই-বর্জ্যের প্রায় অর্ধেক প্রক্রিয়াকরণ হয়।
এই ই-বর্জ্যের মধ্যে ফেলে দেওয়া ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস যেমন- মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টিভি এগুলিতে একদিকে যেমন মূল্যবান উপকরণ থাকে, তেমনই সিসা, ক্যাডমিয়াম ও পারদের মত মারাত্মক বিষাক্ত ধাতুও থাকে। এই আধুনিক যুগে প্রযুক্তি দ্রুত পুরনো হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষও আগের চেয়ে অনেক দ্রুততার সঙ্গে যন্ত্র বদলে ফেলছে। যে কারণে বিশ্বব্যাপী ই-বর্জ্যের পরিমাণ পাঁচগুণ হারে বাড়ছে, আর এই বর্জ্যের খুব অল্প অংশই সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা হচ্ছে। ই-বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে বলে পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য তা বড়ো বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আমেরিকার এই ই-বর্জ্য বা ‘ইলেকট্রনিক আবর্জনার’ গন্তব্য এখন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, এমনকি ভারতও। অনিরাপদ কারখানায় শ্রমিকেরা কোনও সুরক্ষা ছাড়াই ভাঙছে টিভি, পুড়িয়ে ফেলছে মোবাইল। আর সেই সঙ্গে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করছে সিসা, ক্যাডমিয়াম, পারদের মতো বিষাক্ত কণা। পরিবেশে মিশছে মারাত্মক রাসায়নিক। প্রযুক্তির আলোয় পুড়ছে প্রকৃতি আর মানুষের ফুসফুস! এই বর্জ্যের একটি বড়ো অংশ সরাসরি ল্যান্ডফিলে ফেলা হয়, আবার কিছু ই-বর্জ্য পৌঁছে যায় "অনানুষ্ঠানিক স্ক্র্যাপইয়ার্ড"-এ, এটি এমন জায়গাকে বোঝায় যেখানে পুরনো বা অকেজো ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র যেমন- ফোন, কম্পিউটার, টিভি ইত্যাদি ভেঙে বা পুড়িয়ে ধাতু ও অন্যান্য উপাদানকে আলাদা করা হয়, কিন্তু কোনও সরকারি নিয়ন্ত্রণ, নিয়ম-কানুন বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া। এই জায়গাগুলোতে সাধারণত দরিদ্র মানুষ কাজ করেন, যাদের সুরক্ষা না থাকার ফলে তারা বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে এসে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন।
আরও পড়ুন-গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের জিয়নকাঠি! যেভাবে পরিবেশের সর্বনাশ করছে কার্বন ডাই অক্সাইড
অন্যদিকে, বেশ কিছু মার্কিন কোম্পানি, যেমন: আত্তান রিসাইক্লিং কর্পোরেট ই ওয়েস্ট সলিউশনস( CEWS), ক্রিয়েটিভ মেটালস্ গ্রুপ, ইডিএম, ফার্স্ট আমেরিকা মেটাল কর্পোরেশন, আয়রন অ্যান্ড মেটাল, পিপিএম, গ্রিনল্যান্ড রিসোর্স এবং সেমসোটাই BAN-এর অভিযোগ অস্বীকার করলেও, পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। মাত্র দশটি কোম্পানি ২০২৩-২৫ সালের মধ্যে ১০,০০০-এর বেশি কন্টেইনার ই-বর্জ্য রফতানি করেছে, যার বাজারমূল্য এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি! মাসিক হিসেবে এই বাণিজ্য ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি হতে পারে। এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে আটটিরই R2V3 সার্টিফিকেশন থাকলেও বাস্তবে এই সনদ কার্যকরভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সক্ষম নয়। এছাড়া, ক্যালিফোর্নিয়ার কঠোর ই-বর্জ্য আইনের বাধ্যবাধকতা এড়াতে অনেক প্রতিষ্ঠান সে রাজ্যের বাইরে কাজ করছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হল, অনেক চালানই ‘কাঁচা ধাতু’ বা ‘পণ্য সামগ্রী’ নামে ভুল কোডে পাঠানো হচ্ছে, যাতে শনাক্ত করা না যায়। যুক্তরাষ্ট্র বাসেল কনভেনশনের অধীনে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে, রফতানিও। থাইল্যান্ড ইতিমধ্যেই ২৩৮ টন, আর মালয়েশিয়া ১১৮ মিলিয়ন ডলারের ই-বর্জ্য বাজেয়াপ্ত করেছে। তবু এই ই-বর্জ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়। স্থানীয় কর্মী সিপেং ওং-এর কথায়, “ধনী দেশের এই বর্জ্য রফতানি শুধু পরিবেশের ওপর চাপ নয়, এটা এক নতুন ‘বর্জ্য উপনিবেশবাদ’।” প্রযুক্তি বদলাচ্ছে, স্মার্ট দুনিয়া এগোচ্ছে, কিন্তু এই স্মার্ট যুগের ই-বর্জ্যের পাহাড় হয়তো হয়ে উঠবে পৃথিবীর পরবর্তী ‘অদৃশ্য মহামারী’।
Whatsapp
