আমেরিকা বনাম চিন! চাঁদ জয়ের যুদ্ধে কে এগিয়ে?

Space Race: ১৯৭২-এর পর বহুদিন চাঁদ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো, কিন্তু হঠাৎ কী এমন হল যার জন্য সবাই চাঁদ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে চাঁদের বুকে জমানো সম্পদের অন্দরে।

বর্তমান বিশ্বের শক্তিধর দেশ গুলি মূলত ব‍্যস্ত দুটি বিষয় নিয়ে- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজার কে দখল করবে এবং মহাকাশ জয়ের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে? প্রথমটি বয়সে নবীন হলেও মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস বহু পুরনো। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বাম মনোভাবাপন্ন সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে বলে গোল দিয়েছে পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। স্পুটনিক-১ থেকে শুরু করে মহাকাশে পাঠানো প্রথম প্রাণী, (লাইকা নামের কুকুর), এমনকী প্রথম নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন, সব কৃতিত্বই রুশদের ঝুলিতে। রেষারেষির ক্ষোভ মার্কিন জনসমাজে অন্দরে ছড়িয়ে পড়ে।

আসন্ন নির্বাচনে 'রুশদের মহাকাশ বিজয়ে হারাবই' প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে বাজিমাত করলেন কেনেডি। ক্ষমতায় এসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে দিলেন, নাসা আগামী ১০ বছরের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠাবে। সেই মতো মহাকাশ খাতে ব্যাপক বাজেট বরাদ্দ হল। ফলস্বরূপ, অ্যাপোলো-১১ এর প্রথম সফল চন্দ্র অভিযান। তবে নিয়তির পরিহাস! দু'বছর পরই খুন হয়ে যাওয়ায় তিনি আর দেখে যেতে পারেননি তাঁরই নামাঙ্কিত কেনেডি স্পেস স্টেশন থেকে আরোহী সমেত উড়ে যাচ্ছে অ্যাপোলো-১১। সেই হল শুরু, তারপর একে একে রাশিয়া, চিন, জাপান চাঁদে মহাকাশযান পাঠানো শুরু করে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ , এই চার বছরে মোট ছয়বার আমেরিকান নভোচারীরা চাঁদে গেছেন, কিন্তু সোভিয়েতরা চাঁদে মানুষ পাঠাতে পারেনি; তারা রোবট পাঠিয়েছে চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহের জন্য ।

আরও পড়ুন- খুলছে রহস্যের জট! চাঁদের মাটিতে আশ্চর্য বস্তু খুঁজে পেল রোভার ‘প্রজ্ঞান’

সেই সময়ের পর চাঁদ নিয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর উন্মাদনা একটু কমে যায়। ১৯৭২ সালের পর অ্যাপোলো কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যায়, অপরদিকে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে রাশিয়া ও তাদের চন্দ্র অভিযান মিশন একরকম গুটিয়ে নিয়ে আসে। ইদানীং গত একদশক চাঁদ নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে। এখন ঠান্ডা লড়াই চলছে আমেরিকা ও চিনের মধ‍্যে -কে আগে চাঁদে মহাকাশচারী পাঠাবে?

একদিকে নাসা শুরু করেছে তাদের আর্টেমিস প্রোগ্রাম; এরই অংশ হিসাবে ২০২৬ সালে আর্টেমিস–২ মিশন চালু করবে তারা। এই মিশনে মহাকাশচারীরা থাকবেন, কিন্তু তাঁরা কেউ চাঁদে অবতরণ করবেন না, চাঁদের কক্ষপথ ঘুরে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। অনেকটা রাস্তা চিনতে যাওয়ার মতো ব‍্যাপার। এই প্রোগ্রাম সফল হলে পরের বছর নাসা আর্টেমিস-৩ মিশন চালু করবে তারা, উদ্দেশ্য চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মানুষ নামানো। অর্ধ শতাব্দী পূর্বের অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর প্রথম চাঁদে মানুষ পাঠানোই মিশনের মূল লক্ষ্য।

অন্যদিকে চিনও জোরকদমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চন্দ্রবিজয়ে তাদের চাং’ই সিরিজ ইতিমধ্যেই তিনবার সফলতার মুখ দেখেছে; চাং’ই-৫ চাঁদের অদৃশ্য পৃষ্ঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এনেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পর চিন হচ্ছে তৃতীয় শক্তি, যারা চাঁদ থেকে সরাসরি নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে পেরেছে। ২০২৬ সালে তাদের রোবটিক অভিযান চাং’ই-৭ এবং ২০২৮-২৯ সালে চাং’ই-৮ কে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পাঠাবে। এমনকি ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর ঘোষণাও দিয়েছে চেঙ্গিজ খানের উত্তরসূরীরা। তাই চিন তাদের নিজেদের তৈরি অত্যাধুনিক রকেট এবং ল্যান্ডার ব্যবহার করবে। সম্প্রতি তারা শক্তিশালী রকেট লং মার্চ-১০ এবং ল্যান্ডার ল্যানিউয়ের কথা ঘোষণা করেছে। শুধু তাই নয়, চাঁদে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

চাং’ই-৮

এখন প্রশ্ন হল চিন ও আমেরিকার মধ্যে কে এগিয়ে?

আমেরিকার এই চন্দ্রাভিযানের ব্যবহার করা হবে ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের তৈরি রকেট। সমস‍্যা হচ্ছে এটি তৈরি করতে প্রচুর সময় নিচ্ছে স্পেসএক্স, যার ফলে নির্ধারিত সময়ে আর্টেমিস-৩ মিশন চালু করা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। আর একটা বড় সমস্যা হল জ্বালানি; চাঁদে যাওয়ার জন্য স্টারশিপে পর্যাপ্ত জ্বালানি রাখার ব্যবস্থা নেই, ইতিমধ্যেই জ্বালানি ভরতে হতে পারে, যা মহাকাশে খুবই ঝামেলার বিষয়। সেজন্য অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন চিন এককদম এগিয়ে আছে এই ঠান্ডা লড়াইয়ে।

১৯৭২-এর পর বহুদিন চাঁদ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো, কিন্তু হঠাৎ কী এমন হল যার জন্য সবাই চাঁদ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে চাঁদের বুকে জমানো সম্পদের অন্দরে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন চাঁদের পৃষ্ঠদেশের অনেক গভীরে পাওয়া যেতে পারে ম্যাগনেসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, টাইটেনিয়াম, সিলিকন, প্রভৃতি খনিজ। এমনকি মিলতে পারে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়ামের মতো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। সম্ভাবনা আছে হিলিয়ামের এক দুষ্প্রাপ্য আইসোটোপ, হিলিয়াম-থ্রি, এর সন্ধান মেলার, পৃথিবীতে যা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই 'হিলিয়াম-থ্রি', থার্মো নিউক্লিয়ার ফিউশন রিঅ্যাক্টরের মূল উপাদান, যেখান থেকে আমরা পেতে পারি মানুষের ব্যবহার উপযোগী বিপুল নিউক্লিয়ার শক্তি। মাত্র ২ টন হিলিয়ামের এই আইসোটোপ থেকে ভারতের মতো দেশে সারা বছরের শক্তি যোগান দেওয়া সম্ভব।

আরও পড়ুন- সত্যিই তবে জলের খোঁজ মিলল চাঁদে? চ্যালেঞ্জ পুরনো তত্ত্বকে

শুধু খনিজ পদার্থই নয়, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পুঞ্জীভূত জলকণার আভাস পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, সেখান থেকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন তৈরি করতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে এখানে উপনিবেশ গড়তে পারবে বিভিন্ন দেশ, এমনকি স্পেস স্টেশনে হিসেবে চাঁদকে ব্যবহার করা যাবে। সেখান থেকে দূর মঙ্গলে পাঠানো যাবে মহাকাশযান। এখানে পাওয়া শক্তি রেডিয়েশনের মাধ্যমে পাঠানো যাবে স্যাটেলাইটে। চাঁদের জলের বিভাজনে পাওয়া হাইড্রোজেন সহযোগে বানানো যাবে রকেটের জ্বালানি।

এছাড়া চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে লুকিয়ে থাকতে পারে তেজস্ক্রিয় পদার্থের অফুরন্ত ভান্ডার। গহ্বরের ভেতরে ধুলিকনার সাথে মিশে থাকা বরফ, ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের সন্ধানের মধ্য দিয়েই উঠে আসবে পৃথিবী সৃষ্টির সময়ের বিভিন্ন রহস্য। সে কারণেই পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রদের ভেতরে ইতিমধ্যে এক ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়ে গেছে, কে আগে এই সব রহস্য উদঘাটনের দাবিদার হবে- অধিকার করবে তিলোত্তমার খনিজ ভান্ডার। তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞরাই এ বিষয়ে একমত যে- চাঁদে যে দেশ প্রথমে মানুষ পাঠাতে পারবে, তারাই আগামী দশক মহাকাশে রাজ করবে।

More Articles