ভাঙা হুইলচেয়ার, কানে আসে না বোমার শব্দ! কেমন আছেন গাজার ৯৩,০০০ বিশেষভাবে সক্ষম মানুষ?
Disabled People in Gaza War : ২০১৯ সালে গাজা শহরের পশ্চিমে বিশেষভাবে ব্যক্তিদের জন্য প্রথম একটি সৈকত উদ্বোধন করা হয়, মুওয়াইমাহ সমুদ্র সৈকত।
প্রতি মুহূর্তে বোমা পড়ছে। যুদ্ধের সাইরেন, মানুষের আর্তনাদ, কান্না। হেবা আবু জাজার কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না। বোমা বিস্ফোরণের শব্দও না, কান্নাও না। তবে এই কান্না, এই চিৎকারের তীব্রতা তাঁর মর্মে আঘাত করছে। ২৮ বছর বয়সি হেবা আবু জাজার দুই ভাই, জন্ম থেকেই বধির তারা। তবে শক্তিশালী বিস্ফোরণে গাজা এবং মিশরের সীমান্তের রাফাহ শহরে তাদের বাড়ির দরজা জানালা যেভাবে কেঁপে উঠছে তা অনুভব করছেন। গাজার ২.৩ মিলিয়ন মানুষের জীবন কাটছে মৃত্যুর আশঙ্কাতেই। আর যারা বিশেষভাবে সক্ষম? যুদ্ধে কেমন আছেন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বাঁচা গাজার মানুষরা?
হামাস ইজরায়েলে হামলা চালিয়ে ১,৪০০ মানুষ হত্যার পর, ইজরায়েল গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নিরলস বোমাবর্ষণ শুরু করেছে। এই হামলায় মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছুঁই ছুঁই, মৃতদের বেশিরভাগই মহিলা এবং শিশু। গাজা জুড়ে হাজার হাজার বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ বাস্তুহারা। ইজরায়েলি সরকারের নির্দেশে ওষুধ, পানীয় জল, খাদ্য এবং জীবনযাপনের অন্যান্য মৌলিক সুবিধাও পাচ্ছেন না তারা। যুদ্ধে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের অবস্থা তাই সহজেই অনুমেয়।
হেবা নিজেকে জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য কত স্বপ্নই তো দেখছিলেন। গত এক বছরে গ্রাফিক ডিজাইনের কোর্স করেছেন, ফটোগ্রাফি করেছেন, নারী বিষয়ক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। ধীরে ধীরে নিজের একটা জগৎ তৈরি হচ্ছিল তাঁর। কিন্তু এই যুদ্ধ এসে তাঁকে ফেলে দিল চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। গাজায় ২০২১ সালের মে মাসে ইজরায়েল যখন আক্রমণ করে, হেবার বোন আহত হয়েছিলেন। হেবা এবারও ভয় পাচ্ছেন একইরকম। হেবা বলছেন, ভাগ্যিস তাঁর বাবা-মা বধির নন, তাই বাবা মা নিরন্তর তাঁকে জানাচ্ছেন নিরাপদ আছেন, নাকি চরম বিপদ সামনেই।
আরও পড়ুন- গাজার যুদ্ধে ‘হ্যানিবাল’ নীতি নিচ্ছে ইজরায়েল? কী এই বিতর্কিত হ্যানিবাল প্রোটোকল?
ফিলিস্তিনি সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস বলছে, ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী এই অঞ্চলে প্রতিবন্ধী ফিলিস্তিনির সংখ্যা প্রায় ৯৩,০০০ মানুষ যা মোট জনসংখ্যার ২.১ শতাংশ। সেই সংখ্যার প্রায় ৫২ শতাংশ মানে ৪৮,৩৬০ জন মানুষই গাজা উপত্যকায় বাস করেন, বাকিরা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ইজরায়েলের এই হামলাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
বিশেষভাবে সক্ষম এই ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক বস্তু এবং স্বাস্থ্য পরিষেবাও অমিল। বিদ্যুৎ নেই, ফলে যাদের এক জায়গা থেকে অন্যত্র যেতে যন্ত্রের সাহায্য লাগে, যেমন লিফট, মোবিলিটি স্কুটার, এসকালেটর, তারা পড়েছেন চরম সঙ্কটে। যারা অন্যদের সঙ্গে ইশারার ভাষাতে কথা বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় আলোর অভাব তাঁদের ক্ষেত্রেও চরম দুর্বিষহ অবস্থা তৈরি করছে।
২০১৯ সালে গাজা শহরের পশ্চিমে বিশেষভাবে ব্যক্তিদের জন্য প্রথম একটি সৈকত উদ্বোধন করা হয়, মুওয়াইমাহ সমুদ্র সৈকত। এই সমুদ্রের পাড়ে বসে কত আড্ডা, নিজের মতো সময় কাটানোর সুবিধা ছিল। যুদ্ধ ছাড়া গাজা আসলে যে কোনও সুন্দর জায়গার মতোই তো। নিজের প্রতিবন্ধকতাকে সরিয়ে বাকি বিশ্বের সঙ্গে স্বাভাবিক মিলমিশের সুযোগ কেড়ে নিয়েছে যুদ্ধ। ঘরে বন্দি থেকে, বা শরণার্থী শিবিরে থেকে মৃত্যুর অপেক্ষাই যেন ভবিতব্য।
"যদি মারা যাই, আমার নিজের বাড়িতেই মরব। আমি আর কোথায় যাব? আমরা দক্ষিণ গাজা উপত্যকায় কাউকে চিনি না এবং যুদ্ধের সময়, প্রত্যেকে নিজের জন্য আশ্রয় খুঁজছে। অন্যদের সঙ্গে কতজনই আর জায়গা ভাগ করবে?” বলছেন বছর ৩৪-এর বিশেষভাবে সক্ষম সুহা মাকাত।
২০২১ সালের যুদ্ধের সময়, ইজরায়েলি যুদ্ধবিমান সুহার বাড়ির পাশের একটি বাড়িতে আঘাত হানে। মেঝেতে ছিটকে পড়ে যান সুহা। নিজের থেকে ওঠার ক্ষমতা তাঁর নেই। প্রতিবেশীরা কখন তাঁকে তুলে নিয়ে যাবেন সেই অপেক্ষাতেই পড়েছিলেন তিনি। মাটিতে পড়ে থেকে যন্ত্রণায় কাতরানোর সেই দৃশ্য আবার ঘটুক চান না তিনি।
আরও পড়ুন- ৫০ হাজার গর্ভবতী মহিলা যুদ্ধের শিকার! প্রিম্যাচিওর শিশুদের মৃত্যু দেখবে গাজা?
উত্তর গাজার ফিলিস্তিনিদের দক্ষিণে যাওয়ার জন্য ইজরায়েলি সেনা যে আদেশ দিয়েছে তা মানতে চান না সুহা মাকাত। তিনি বলছেন, "ইজরায়েল নাগরিকদের চিন্তা করে না। তারা কেবল মৃত্যু এবং ধ্বংসের চিন্তাই করে। আমি পাঁচটি যুদ্ধ পার করেও বেঁচে আছি। এখন যেটা ঘটছে এটাই এ পর্যন্ত ঘটা সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধ।"
সুহা এবং তাঁর বন্ধু রাবাব নোফাল জানাচ্ছেন, যুদ্ধের আগে বেশিরভাগ জায়গায় যেতে তাঁদের অসুবিধা হতো কারণ রাস্তা ভালো ছিল না। হুইলচেয়ার বা ক্রাচ ব্যবহারকারীদের জন্য খুবই খারাপ রাস্তা। তাও নিজের তিন বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়েই জিনিস কিনতে দোকানে যেতেন। এখন তো সেই অবস্থাও নেই। গাজা সরকারের মিডিয়া দফতর জানাচ্ছে, ইজরায়েল গাজা উপত্যকায় ১২,০০০ টনের বেশি বিস্ফোরক ফেলেছে, যা হিরোশিমায় ফেলা বোমার সমতুল্য। অর্থাৎ গড়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৩ টন বোমা ফেলা হয়েছে। বিশ্বের তৃতীয় সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকা ৪১ কিমি লম্বা এবং ১০ কিমি চওড়া।
ইজরায়েল আরও বেশি করে প্রতিবন্ধী মানুষই তৈরি করছে গাজাজুড়ে। বোমাবর্ষণে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়েছে এমন মানুষ গুণে শেষ করা যাবে না। ইজরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরেও গাজা শহরে নিজের বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছেন না আরেক ফিলিস্তিনি মাহমুদ আবু নামুস। তিনি বধির। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তাঁর বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। ২০২১ সালের যুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রী ছিলেন গর্ভবতী। আবু নামুস বলছেন, যুদ্ধের সময় ইশারার ভাষা দরকারি যাতে তাঁরা জানতে পারেন যে কী ঘটছে। আগেরবারের যুদ্ধে বন্ধুদের ফেসবুক গ্রুপে মেসেজ করতেন, কিন্তু এখন বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট নেই! এই যুদ্ধে সবার সঙ্গে যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।