স্নান-খাওয়ার জলটুকুও নেই! দূষিত সমুদ্রের জলেই বাঁচছে গাজার শরণার্থী শিশুরা
Gaza Refugee Families : সমুদ্রের জলও দূষিত। দূষণ এবং সমুদ্রে সাঁতার কাটার কারণে শিশুরা ডায়রিয়া, কাশি ও সর্দিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
প্রবল যুদ্ধ, নিয়ত বোমাবর্ষণ। এই চরম অনিশ্চিত জীবনের মধ্যেই সমুদ্র এবং সাগর পাড়ের নোনতা বাতাসের কাছে যেন কৃতজ্ঞ গাজার বাসিন্দারা। কৃতজ্ঞ আন্দালিব আল-জাক। ৭ অক্টোবর ইজরায়েল গাজা উপত্যকায় বোমা হামলা শুরু করার পরপরই তার ১৬ সদস্যের পরিবার গাজা শহরের পূর্বে শুজাইয়া পাড়ায় নিজেদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান বাস্তুচ্যুত হয়ে। দক্ষিণে দেইর আল-বালাহ কেন্দ্রীয় গভর্নরেটের দিকে এগোতে থাকেন সকলেই। রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণার্থী সংস্থা পরিচালিত আলিফ এলিমেন্টারি বয়েজ স্কুলে ঠাঁই নেন তারা।
কিন্তু ঠাঁই কই? স্কুলের সমস্ত ক্লাসরুম ততক্ষণে গিজগিজ করছে তারই মতো শরণার্থী পরিবারে। এক একটা ক্লাসে প্রায় ৮০ জন! তাই স্কুলের মাঠেই তাঁবু পাতেন তারা। সেখানে ৮,০০০ মানুষের আশ্রয়। খাবার নেই, পর্যাপ্ত জল নেই। চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে বাধ্য সকলেই। সেই বিশৃঙ্খলা এবং নোংরা পরিবেশ থেকে যেন রেহাই দিয়েছে সমুদ্র। যুদ্ধে গুঁড়িয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে দূরে এসে এই সমুদ্র পেয়ে বাচ্চারাও খানিক শান্ত, যেন স্কুল থেকেই ঘুরতে নিয়ে এসেছে কোথাও!
যে স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন সকলে, সেই স্কুলটি ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি। পরিষ্কার জলের অভাবের কারণে কিছু পরিবার এবং তাদের বাচ্চারা সমুদ্রের জলেই স্নান করছেন। কাপড় ধোয়ার জন্য সমুদ্রের জলই ব্যবহার করছেন এই শরণার্থীরা।
আরও পড়ুন- প্রতি ১০ মিনিটে ১টি শিশুর মৃত্যু! ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু গাজায়! আর কত?
৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামাসের হামলায় কমপক্ষে ১,৪০০ ইজরায়েলি নিহত হন। তারপরই গাজায় যুদ্ধ শুরু করে ইজরায়েল। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজা উপত্যকায় সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। গুঁড়িয়ে গিয়েছে বাড়িঘর, জ্বালানি প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে ইজরায়েল। খাবার নেই, ওষুধ নেই, পানীয় নেই, শুধু বোমা আর মৃত্যু। ১০,৫০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে গাজায়, যার অধিকাংশই নারী ও শিশু। গাজার একমাত্র ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্টটিও জ্বালানির অভাবে বন্ধ।
উপকূলীয় গাজা ১৭ বছর ধরেই মিশর এবং ইজরায়েলের লক্ষ্যবস্তু। গাজা স্ট্রিপের সমস্ত নাগরিক পরিকাঠামোর ৫৮ শতাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। ২১২,০০০ টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ছাড়াই হাসপাতালগুলো সৌরশক্তি চালিত জেনারেটরে কাজ করছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় জানিয়েছে, ২১ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বরের মধ্যে, অত্যাবশ্যকীয় জল এবং স্যানিটেশন পণ্য বহনকারী মাত্র ২৬টি ট্রাক গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করেছে। গাজার প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর ধারেকাছেও নেই এই পরিমাণ পণ্য। ২৩ লক্ষেরও বেশি মানুষের বাস ওই ছোট্ট এলাকাতে।
জল নেই, স্যানিটেশন নেই, মৌলিক স্বাস্থ্যবিধির অভাবে প্রাপ্তবয়স্ক বা শিশুরা সকলেই সঙ্কটে। বাস্তুচ্যুত পরিবারেরা সমুদ্রের শরণাপন্ন তাই। কিন্তু সমুদ্রের জলও দূষিত। দূষণ এবং সমুদ্রে সাঁতার কাটার কারণে শিশুরা ডায়রিয়া, কাশি ও সর্দিতে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু উপায় কী? একটা ছোট্ট স্কুলে এত মানুষ, জলের মতো প্রতিক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিই নেই! এই যুদ্ধের আগেও, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন পরিকাঠামো এবং বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে অপরিশোধিত পয়ঃনিষ্কাশন জল সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ১০০ থেকে ১০৮ মিলিয়ন লিটার নোংরা জল! গাজা উপত্যকায় শিশুদের অসুস্থতার প্রাথমিক কারণ ছিল এটাই।
আরও পড়ুন- ৫০ হাজার গর্ভবতী মহিলা যুদ্ধের শিকার! প্রিম্যাচিওর শিশুদের মৃত্যু দেখবে গাজা?
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের মতে, অক্টোবরে বর্জ্য জল শোধনাগারগুলি বন্ধ থাকার ফলে ভূমধ্যসাগরে প্রতিদিন ১৩০,০০০ কিউবিক মিটারেরও বেশি অপরিশোধিত পয়ঃনিষ্কাশিত জল ফেলা হয়েছে, যা মারাত্মক পরিবেশগত বিপদ সৃষ্টি করেছে।
গাজা উপত্যকার তিনটি প্রধান জলের পাইপলাইনই ইজরায়েল নিয়ন্ত্রিত। ৮ অক্টোবর থেকে ইজরায়েল উত্তর গাজা পর্যন্ত পাইপলাইন বন্ধ করে দিয়েছে। দক্ষিণে, ইজরায়েল ১৫ অক্টোবর খান ইউনিসের জল সরবরাহ চালু করলেও দুই সপ্তাহ পরে সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। গাজা স্ট্রিপের কেন্দ্রীয় এলাকায়, ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষ ২৯ অক্টোবর জল সরবরাহ ফের চালু করার কথা বললেও তা করা হয়নি। কলে যে জল আসে তা হয় লবণাক্ত বা তাতে ক্লোরিনের মাত্রা অত্যন্ত বেশি।
বাস্তুচ্যুত পরিবারের কারণে মধ্য গাজা উপত্যকায় জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটছে। ফলে পরিবেশগত বিপর্যয় এবং ব্যাপক স্বাস্থ্য সংকট শিয়রে। গড়ে ৭০ জন মানুষ অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে একটিই শ্রেণিকক্ষে থাকছেন। ভিড়ের কারণে ফুসফুসের সংক্রমণ এবং অন্ত্রের ফ্লু-এর মতো অনেক রোগ এবং সংক্রমণ ঘটছে। বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ জলের অভাব সমস্যা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। স্কুলের শৌচাগারগুলি অস্বাভাবিক নোংরা! পরিষ্কার জলের অভাবের কারণে অনেক শরণার্থীই কাপড় ধোয়া বা স্নান করার জায়গা হিসাবে সমুদ্রকে ব্যবহার করেছে। আর ইজরায়েলি বিমান দেইর আল-বালাহের পশ্চিমে সমুদ্র সৈকতে থাকা শিশুদেরও লক্ষ্য করে বোমা ছুড়েছে। ইজরায়েলের বিমান হামলার ফলে তাদের মধ্যে তিনজন নিহত এবং সাতজন আহত হয়েছে।