বিশ্বের বিপদ বাড়বে নিমেষেই! কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ইরানের হরমুজ প্রণালী?
Israel-Iran conflict Strait of Hormuz: বিশ্বব্যাপী যত তেল ব্যবহার হয় তার প্রায় ২০ শতাংশ এই প্রণালীর মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল ট্রানজিট চোকপয়েন্ট বলা হয় এই হরমুজ প্রণালীকে।
বহু যুগ ধরেই একে অপরের শত্রু। তবে বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা অস্থিরতাকে আরও কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে এবার তীব্রতর মুখোমুখি সংঘর্ষে নেমেছে যুযুধান ইজরায়েল এবং ইরান। দুই দেশই অস্ত্রের বলে বলীয়ান। ফলে ইরানের উপর যে হামলা ইজরায়েল করেছে, তার পাল্টা জবাব যে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়েই ইরান ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়াস করবে, সহজেই অনুমেয়। আর এই সংঘাতের প্রভাবে কেবলই আঞ্চলিক নয়। সারা বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে চলেছে ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষ। এরই মধ্যে ইরান জানিয়েছে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার কথা বিবেচনা করছে সে দেশের সরকার। ইরানি সংবাদ সংস্থা ইরিন জানিয়েছে, ইজরায়েলের সঙ্গে বিরোধ তীব্র হওয়ার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এই পদক্ষেপটি তেলের দাম বাড়িয়ে তো দেবেই, পাশাপাশি যুদ্ধকেও প্রসারিত কররতে পারে। এই হরমুজ প্রণালী আসলে কী? কেন এটি বিশ্ব বাণিজ্যের পক্ষে এই প্রণালী এত গুরুত্বপূর্ণ?
হরমুজ পারস্য উপসাগরে ঢোকার একমাত্র সামুদ্রিক প্রবেশ পথ। এটি একদিকে ইরানকে বিভক্ত করছে এবং অন্যদিকে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহিকে বিভক্ত করছে। হরমুজ প্রণালী পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর এবং ভারত মহাসাগরের আরব সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে।
ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী যত তেল ব্যবহার হয় তার প্রায় ২০ শতাংশ এই প্রণালীর মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল ট্রানজিট চোকপয়েন্ট বলা হয় এই হরমুজ প্রণালীকে। এই প্রণালীর সংকীর্ণতম অংশে, এটি ৩৩ কিলোমিটার মাত্র প্রশস্ত। তবে জলপথে শিপিং লেনগুলি আরও সংকীর্ণ। ফলে এখানে আক্রমণ হলে বিপদ বাড়বে, তা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন- ইরান-ইজরায়েল সংঘর্ষ! কী প্রভাব পড়বে ভারতে?
১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে ইরান-ইরাক দ্বন্দ্বের সময়, দুই পক্ষেরই হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। দুই দেশই উপসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজগুলিতে হামলা করে। সেই সময় ট্যাঙ্কার যুদ্ধ হিসাবে পরিচিত হয়েছিল এই সংঘাত। তবে হরমুজ প্রণালী কখনই পুরোপুরি বন্ধ ছিল না।
সাম্প্রতিককালে, ২০১৯ সালে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথমবার রাষ্ট্রপতি হন, সেই সময় ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা আরও তীব্র হয়। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ফুজাইরাহ উপকূলে প্রণালীর কাছে চারটি জাহাজ আক্রমণ করা হয়েছিল। এই ঘটনার জন্য ওয়াশিংটন তেহরানকে দোষ দিয়েছিল, তবে ইরান অভিযোগ অস্বীকার করে। সাধারণত, দীর্ঘকালীন কোনও সংঘাতের মধ্যে আরও চাপ বাড়াতে সাধারণত শিপিং লেনগুলিতে আক্রমণ করা হয়। গাজায় যুদ্ধের পর থেকে ইয়েমেনের হাউথিরা আরব উপদ্বীপের ওপারে লোহিত সাগরে প্রবেশ পথ বাব আল-মন্ডেব প্রণালীর আশেপাশে জাহাজগুলিতে আক্রমণ করছে। হাউথিদের এই আক্রমণ বিশ্ব বাণিজ্যকে প্রভাবিত করেছে ঠিকই, তবে জাহাজগুলি আফ্রিকার আশেপাশ দিয়ে ঘুরে গিয়ে লোহিত সাগর এড়াতেও পারে - দীর্ঘতর হলেও নিরাপদ যাত্রা। কিন্তু হরমুজের মধ্য দিয়ে না গেলে উপসাগর থেকে সমুদ্রের বাইরে কিছু পাঠানোর কোনও উপায় নেই।
এমনকী যে দেশগুলি উপসাগরীয় দেশের থেকে পেট্রোল আমদানি করে না তারাও এই প্রণালী বন্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হবে কারণ এতে বিশ্ববাজারে সরবরাহে ঘাটতি হবে আর তা ব্যারেল প্রতি তেলের দাম বাড়িয়ে তুলবে।
তবে ইরানের এই প্রণালী বন্ধ করার ক্ষমতা বা প্রকৃত ইচ্ছা আছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। এমনটা করলে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুপ থাকবে না। এই অঞ্চলে নৌ-সামরিক সম্পদ রয়েছে আমেরিকার।
ইজরায়েল গত শুক্রবার ভোরে ইরান জুড়ে আক্রমণ চালায়। মূলত সামরিক নেতা, আবাসিক ভবন, সেনা ঘাঁটি এবং পারমাণবিক কেন্দ্রকে লক্ষ্য করে হামলা চলেছিল। তারপর প্রত্যাঘাতে ইরান শ'য়ে শ'য়ে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ছোড়ে ইজরায়েলকে লক্ষ্য করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে নষ্ট করতে সহায়তা করেছে ঠিকই কিন্তু মনে রাখতে হবে, ওয়াশিংটন সরাসরি ইরানকে আক্রমণ করেনি। এমনকী মার্কিন কর্মকর্তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইজরায়েলের এই হামলার সঙ্গে ওয়াশিংটন কোনওভাবেই জড়িত ছিল না।
আরও পড়ুন- ইরান হামলার বিরোধিতা থেকে কেন সমর্থনে ট্রাম্প?
উল্টোদিকে দেখতে গেলে, তেহরানও কিন্তু এই অঞ্চলে মার্কিন সেনা বা মার্কিন স্বার্থকে লক্ষ্য করে হামলা করেনি। তাই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে আমেরিকাকে অহেতুক উত্যক্ত করার পথে কি ইরান হাঁটবে? ট্রাম্পের থেকে সরাসরি সামরিক প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি কি এই মুহূর্তে ইরান নিতে চাইবে? তবে ইরান একটি বিষয় স্পষ্ট করছে যে, এই জাহাজ চলাচলের প্রণালীগুলিকে আগামীতে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে সিরিয়ার দামাস্কাসে ইরানের কনস্যুলেটে এক মারাত্মক হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েল। তারপরে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী হরমুজ প্রণালীর কাছে একটি জাহাজ দখল করে নেয়। তারপর ইরান ও ইজরায়ের মধ্যে সংঘাত চলে। দুই শত্রুর মধ্যে অন্যতম গুরুতর প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘাত ছিল সেটি। সংঘাত আবারও চলছে, হরমুজ প্রণালী সেখানে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেটিই দেখার।