মুখ্যমন্ত্রী জড়িয়ে, তবু বিধানসভার ভোটাভুটিতে কেন নেই তৃণমূলের বেশিরভাগ বিধায়ক? জল্পনা তুঙ্গে

এমন ঘটনা কেন ঘটল তৃণমূল পরিষদীয় দলের অভ্যন্তরে? রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন কাণ্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ, জটিল এবং চিন্তারও বটে।

 

 

 

রাজ্যপালের পরিবর্তে রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদে আসবেন মুখ্যমন্ত্রী, এমনই বিষয় ছিল ‘দ্য ওয়েস্টবেঙ্গল ইউনিভার্সিটি ল অ্যামেন্ডমেন্ট ২০২২ বিল-এর। বোঝাই যাচ্ছে, এই বিলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। খোদ মমতাকেই আচার্য পদে আনার লক্ষ্যে সংশোধন করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট আইনটির। সোমবার বিলটি বিধানসভা অধিবেশনে পেশ করা হয়। এবং অধিবেশনের প্রথম দিনেই ভোটাভুটিতে পাস হয়ে যায় এই 'আচার্য-বিল'।

আপাতদৃষ্টিতে এই বিল পেশ এবং পাস হওয়ার ব্যাপারটি খুবই সহজ-সরল মনে হলেও আদতে সত্যিই কি তেমন হয়েছে? বিধানসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে সরকার পক্ষের। যে কোনও বিল সরকারের তরফে বিধানসভায় সাবলীলভাবে পাস হয়ে যাওয়ারই কথা। আচার্য বিলের ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেস তথা দলের সুপ্রিমোর কপালে ভাঁজ বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে গিয়েছে সোমবারের বিধানসভায়। যার ফলে একাধিক প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে।

বিধানসভায় তৃণমূলের মোট সদস্যসংখ্যা এখন ২২০-র কাছাকাছি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যুক্ত যে বিলের সঙ্গে, এদিন সেই বিলের পক্ষে ভোট পড়েছে মাত্র ১৬৭টি। অর্থাৎ ৫৩ জন তৃণমূল বিধায়ক হয় গরহাজির ছিলেন, অথবা উপস্থিত থেকেও ভোট দেননি। এমন ঘটনা কেন ঘটল তৃণমূল পরিষদীয় দলের অভ্যন্তরে? রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে এমন কাণ্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ, জটিল এবং চিন্তারও বটে।

আরও পড়ুন: কে হবেন রাষ্ট্রপতি! বিরোধী ঐক্যের সর্পছিদ্রই বিজেপির পোয়াবারো?

আরও আছে৷ এই বিল ভোটাভুটিতে যাওয়ার পর দু'বার দু'ধরনের ফল ঘোষিত হয়। প্রথমে ঘোষণা করা হয়, ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি ল অ্যামেন্ডমেন্ট ২০২২ বিলটি ১৮২-৪০ ভোটে বিল পাশ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি বিধায়করা দাবি করতে থাকেন, অধিবেশনে হাজির থাকা তাঁদের ৫৭ জন বিধায়কই বিলের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। তা হলে বিপক্ষে ৪০টি ভোট পড়ে কী করে? কোথায় গেল ১৭টি ভোট? বিজেপির তোলা অভিযোগ পত্রপাঠ উড়িয়ে দিয়ে সরকার পক্ষের চিফ হুইপ বলেন, "এদিন ১৮২জন তৃণমূল বিধায়ক হাউসে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরাই এই ভোট দিয়েছেন।" এর অর্থ সরকার পক্ষের চিফ হুইপ নিশ্চিত ছিলেন, হাউজে ১৮২ জন তৃণমূল বিধায়ক হাজির ছিলেন। ওদিকে সন্ধ্যা নাগাদ বিধানসভার সচিবালয়ের তরফে জানানো হয়, আগের ঘোষণায় ভুল হয়েছিল। নতুন ফল বিলের পক্ষে ১৬৭, বিপক্ষে ৫৫। এটাই যদি চূড়ান্ত হয়, তাহলে সরকার পক্ষের চিফ হুইপ কীসের ভিত্তিতে জানালেন ১৮২ জন তৃণমূল বিধায়ক হাজির ছিলেন। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন তো উঠবেই, বিলের পক্ষে তৃণমূলের ১৫টি ভোট কম হলো কেন? আসলে কেউই কোনও বিষয়ে সিরিয়াস নন, সব দায় যেন মুখ্যমন্ত্রীরই!

এদিকে প্রথম দফায় ফল ঘোষণার পর গেরুয়া শিবিরের দাবি ছিল, বিল পেশের সময় তাঁদের ৫৭ জন বিধায়ক হাউজে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিলের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। তাই বিলের বিপক্ষে ভোট পড়ার কথা ৫৭টি, সেক্ষেত্রে বিপক্ষে ৪০টি ভোট পড়ে কী করে? তাদের ১৭টা ভোট কোথায় গেল? তৎক্ষণাৎ শুরু হয় জল্পনা, ভোটদানে হয় পদ্ধতিগত ভুল করে ফেলেছেন বিজেপি বিধায়কদের একটি অংশ, অথবা ঢালাও ক্রসভোটিং? অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বিজেপির তরফে নালিশ জানানো হয়। ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ। আর মঙ্গলবার অধিবেশনের শুরুতেই স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন, সোমবার বিধানসভায় আচার্য বিলের ভোট গণনায় ভুল হয়েছিল। স্পিকার বলেছেন, ‘‘আশা করব, এমন ভুল ভবিষ্যতে হবে না। কী করে ভুল হল, তা খতিয়ে দেখতে বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে।”

বিধানসভার ইতিহাসে এমন ঘটনা বেনজির। গণনায় ভুলের কারণে প্রথমবার বিপক্ষের ১৫টি ভোট সরকার পক্ষের দিকে চলে গিয়েছিল। এভাবেই হিসেব করার ফলে বিলের পক্ষে ভোট দেখানো হয় ১৮২। কিন্তু দ্বিতীয় গণনায় বিপক্ষের সেই ১৫টি ভোট বিজেপির দিকেই চলে যাওয়ায় বিরোধীদের ভোট ৪০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫-য়। তবে দ্বিতীয় গণনায় দেখা যায়, বিজেপির ২জন বিধায়কের ভোট বাতিল হয়েছে। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত ফল, বিলের পক্ষে ১৬৭, বিপক্ষে ৫৫। গণনার এই ভুল না হলেই ভালো হতো, তবুও শেষ পর্যন্ত তা মেনে নেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, এমন ভুল ভবিষ্যতে হবে না।

কিন্তু মূল বিষয়টি তো রয়েই গেল। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিল বিধানসভায় পেশ করা হচ্ছে, তৃণমূল বিধায়করা তা জানতেন না, এমন হতে পারে না। ভোটাভুটির হিসেব বলছে, বিলের পক্ষে আরও ৪৮-৫০টি ভোট পড়া উচিত ছিল, ২-৪ জন অনুপস্থিত থাকতেই পারেন, কিন্তু তেমন হয়নি। তৃণমূলের পক্ষে এটা অবশ্যই চিন্তার।

রাজনৈতিক মহলের অভিমত, এই চিন্তা অমূলক নয়। দেশের আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সহমতের ভিত্তিতে বিরোধী শিবিরের প্রার্থী দাঁড় করাতে সক্রিয় হয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই লক্ষ্যেই তিনি বুধবার, ১৫ জুন, দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাবে দেশের বিরোধী শিবিরের শীর্ষ নেতৃত্বের এক বৈঠক ডেকেছেন। সেই বৈঠকে যোগ দিতে মঙ্গলবারই দিল্লি গিয়েছেন মমতা। সেই আবহে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিল পাস করার দিনে এত সংখ্যক দলীয় বিধায়কের গরহাজিরা অন্য এক আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে কি না, তাও ভাবার বিষয় বলেই মনে করছে রাজনীতির জগতের লোকজন।

 

More Articles