'সোনার কেল্লা' কমেডি থ্রিলার, বলেছিলেন সত্যজিৎ
উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমারের ‘সন্দেশ’ পত্রিকা নতুন করে প্রকাশিত হতে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে, ১৯৬১ সালে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং সত্যজিৎ রায়ের উদ্যোগে আবার ‘আত্মপ্রকাশ’ করল 'সন্দেশ'। প্রথম যখন 'সন্দেশ' প্রকাশিত হয়েছিল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর হাত ধরে, তখন সেখানে গোয়েন্দাকাহিনি প্রকাশিত হত না। কিন্তু সত্যজিতের 'সন্দেশ'-এ গোয়েন্দাকাহিনি ঠাঁই পেল, তার দু'-একটি কারণ আছে। অজেয় রায়কে একটি চিঠিতে সত্যজিৎ লিখছেন, পাঠকের কাছ থেকে পাওয়া মতামতের ভিত্তিতে তাঁর মনে হচ্ছে, অ্যাডভেঞ্চার-কাহিনি ও গোয়েন্দাকাহিনির গুরুত্ব ও চাহিদা খুবই বেশি। কিন্তু 'সন্দেশ'-এ যেমন-তেমন গোয়েন্দাকাহিনি তিনি প্রকাশ করতে পারবেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা হয়, যখন নতুন কোনও সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়, তখন তা অন্য সাময়িকপত্রর থেকে কোথায় আলাদা, তা সম্পাদক চিহ্নিত করতে চান। একটি চিঠিতে সত্যজিৎ সচেতনভাবে লিখছেন, "মনে রেখো, অন্য পাঁচটা কিশোরপত্রিকায় যে গল্প বেরোয়, শুধু তার চেয়ে ভাল হলেই হল না, কারণ ওটা কোনও স্ট্যান্ডার্ডই নয়। আমাদের লক্ষ্য হবে আরও অনেক উপরে।" এই আদর্শ সত্যজিৎ স্থির করছেন, অন্যান্য গল্পের পাশাপাশি রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির ক্ষেত্রেও। ফলে, ফেলুদা যে অন্য পাঁচটা গোয়েন্দাকাহিনির চেয়ে আলাদা হবেই, তা যেন নির্ধারিত।
উনিশ শতকে বাংলা গোয়েন্দাকাহিনি লেখা যখন শুরু হয়েছিল, যাঁরা সেই প্রথমদিকে গোয়েন্দাকাহিনি লিখছিলেন, তাঁরা সকলেই পুলিশ কর্মচারী। তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। ফলে, তাঁরা যত না গোয়েন্দাকাহিনি লিখছেন, তার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতার বয়ান তৈরি করছেন। আর সেই বয়ানে বাস্তবতা খুব প্রখর। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের 'দারোগার দপ্তর' পড়লে যে সবসময় আমাদের খুব মনোরঞ্জন হবে, তা নয়। সেখানে এতই ক্রুর বাস্তবের কথা আছে, অনেক সময় পড়লে একটু অস্বস্তি হয়, ভয় করে, বিরক্ত লাগে। সেই সময়ের পাঠক প্রতিক্রিয়ার দিকে তাকালে দেখা যাবে, তাঁরাও প্রশ্ন তুলছেন, কী লাভ হচ্ছে এই জাতীয় লেখা প্রকাশ করে? পাঠকদের মনে অপরাধপ্রবণতা কি বেড়ে যাচ্ছে না? অনেকে বলছিলেন এ-সব পড়ে অপরাধ-জগৎ সম্পর্কে পাঠক সচেতন হচ্ছেন। এই জাতীয় বিতর্ক তখন দানা বাঁধছিল।
বাস্তবতার যে চেহারা এই পুলিশি অভিজ্ঞতার বয়ানে ছিল, তার বাইরে আরেকরকম অতিরঞ্জিত গোয়েন্দা বা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি লেখা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের লেখার কথা ধরা যেতে পারে। তাঁর একটি গল্পে দেখা যাচ্ছে, শিয়ালদহ থেকে এক-দু ঘণ্টা ট্রেনে করে গেলেই এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যাওয়া গেল, যেখানে একদিকে পাহাড়ের খাদ, আরেকদিকে উত্তুঙ্গ পাহাড়। অনেক সময় গোয়েন্দার হাতের যন্ত্র অনুবীক্ষণ না দূরবীক্ষণ, লেখক তা গুলিয়ে ফেলছেন, কার্যকারণ সূত্র অনেক ক্ষেত্রেই আর মানা হচ্ছে না। কীভাবে যে কী ঘটে যাচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন: কেন বারবার ব্যোমকেশই জিতে যায়? ফেলুদা-কিরীটির থেকে কোথায় এগিয়ে সে!
ফলে, দুটো চেহারা পাওয়া যাচ্ছে প্রথমদিকের গোয়েন্দাকাহিনির। একটি একদম বাস্তবের প্রতিফলন, যা সবসময় পাঠকের মনোরঞ্জন করতে পারছে না। আবার, আরেক ধরনের অতিরঞ্জিত কাহিনিও পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে ক্রাইম আছে, ক্রাইমের নানা স্তর আছে, সেই ক্রাইমের প্রতি মানুষের আকর্ষণ ও কৌতূহল বেশি। প্রয়োজন মতো পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য সেখানে নানা স্তরে যৌনতা আছে, নারীশরীরের বিবরণ আছে, গোয়েন্দার সঙ্গে রমণীয় সম্পর্কের বিবরণ আছে, যা 'ভদ্র' পাঠক মেনে নিতে পারছে না।
এই দুই ধারার বাইরে তৃতীয় একটি ধারা গড়ে উঠল।
সত্যজিৎ 'যখন ছোট ছিলাম'-এ লিখেছেন, তাঁর প্রিয় লেখক মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর কথা। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর লেখা সত্যজিৎ পড়ছেন 'রামধনু'-তে, রামধনু 'সন্দেশ'-এর আদর্শে প্রভাবিত ছিল। 'রামধনু'-তেই আত্মপ্রকাশ করছে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর গোয়েন্দা 'হুকাকাশি', হুকাকাশির অ্যাডভেঞ্চার ‘পদ্মরাগ'-এর কথা না বললেও 'ঘোষচৌধুরীর ঘড়ি' পড়ে সত্যজিৎ মুগ্ধ, একথাও তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লিখিত। হুকাকাশির গল্পের সঙ্গের অলংকরণ অধিকাংশই করতেন ফণী গুপ্ত। সেই অলংকরণেও বাস্তবতার চেহারা ধরা পড়েছিল। হুকাকাশির আত্মপ্রকাশের কিছুদিন পর 'বসুমতী'-তে ব্যোমকেশের প্রথম তিনটি কাহিনি প্রকাশিত হচ্ছে। এর কিছুদিন পর 'ব্যোমকেশের ডায়েরী' প্রকাশিত হচ্ছে গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স থেকে। ব্যোমকেশের মধ্য দিয়ে বাঙালি গোয়েন্দাগল্পের আরেক 'ভদ্র' পাঠ্যরূপ পাচ্ছে। তবে ছোটবেলায় সত্যজিতের ব্যোমকেশ পড়ার সম্ভাবনা ছিল বলে মনে হয় না।
অর্থাৎ, নতুন এক ধরনের গোয়েন্দা গল্পের ধারা তৈরি হল, যেখানে আগের ওই অতিরঞ্জন, ভ্রান্তি পেরিয়ে গোয়েন্দাকাহিনি বাস্তবতার ছোঁয়াচ পেল। সেই বাস্তবতা যদিও পুলিশি কাহিনির বাস্তবতার চেয়ে আলাদা। একরকম যুক্তিনিষ্ঠায় যেন গল্প সাজতে শুরু করল। তবে অতিরঞ্জিত ধারার গল্পও এরই পাশাপাশি পড়ছিলেন বাঙালি পাঠকরা। এই দুই ধারার মধ্য থেকে সত্যজিৎ যে ধারাকে বেছে নিচ্ছেন, তা এই দ্বিতীয় যুক্তিনিষ্ঠ ধারাই। কিন্তু সত্যজিৎ কি জনপ্রিয় সাহিত্যধারাটিকে ফেলে দিচ্ছেন, বাদ দিচ্ছেন? এই দুই ধারা কিন্তু দুই সংস্কৃতির পরিচায়ক। এক সংস্কৃতি বলছে যুক্তিনির্ভরতার কথা, অন্য সংস্কৃতি বলবে আপাত যুক্তিহীনতা, কাল্পনিকতার অতিরেকের কথা।
আরও পড়ুন: বর্ণময় জীবন পর্দার ‘সিধুজ্যাঠা’-র || তাঁর বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন সত্যজিতের নায়িকা!
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, সত্যজিৎ কিন্তু যুক্তি এবং যুক্তির সীমা- দুই সম্পর্কেই সচেতন। কারণ, ফেলুদাকাহিনির আগেই শঙ্কুকাহিনি লিখেছেন তিনি। শঙ্কুকাহিনিতে বিজ্ঞানের এক বিশেষ ঘরানার প্রতি সমালোচনা রয়েছে। সত্যজিৎ শঙ্কুকে দিয়ে বলান, বিজ্ঞানের সব জেনে ফেলার প্রবণতারও সীমা রয়েছে। 'আগন্তুক'-এ, জীবনের একেবারে প্রান্তসীমায় এসে, আধুনিক বিজ্ঞান এবং যুক্তি, যা পুঁজির পক্ষে কথা বলে, তার সমালোচনা করছেন সত্যজিৎ। সত্যজিতের হয়ে ছবিতে কথা বলছেন অভিনেতা উৎপল দত্ত। আধুনিক পুঁজিবাদ-নির্ভর পরিবেশ-ধ্বংসী বিজ্ঞানের বিরোধিতার এই ধারা কিন্তু 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছবি থেকেই শুরু হয়েছিল। এই মনটা সত্যজিতের আগাগোড়াই ছিল। ফলে ফেলুদার সৃষ্টি এবং পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায়, পূর্বোক্ত দুই ধারার মধ্যে একটা সংলাপ তৈরি করলেন সত্যজিৎ, এই সংলাপ নির্মাণের জন্য একটি চরিত্রের প্রয়োজন হল সত্যজিতের। সেই চরিত্রের নাম লালমোহন গাঙ্গুলী, ওরফে জটায়ু। যাকে তিনি নিয়ে এলেন 'সোনার কেল্লা'-য়। 'সোনার কেল্লা' ও 'জয় বাবা ফেলুনাথ'- এই দু'টি কাহিনি সাতের দশকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল সত্যজিতেরই হাত ধরে। ভাবতে হবে, সত্যজিৎ এমন একজন মানুষ, যিনি ফেলুদাকে নিয়ে গল্প লিখছেন, সেই গল্পের অলংকরণ করছেন, ছবি বানাচ্ছেন, আবার রেডিও নাটকও করছেন ('বাক্স রহস্য')। অর্থাৎ, ফেলুদাকে দৃশ্য ও শ্রুতিমাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি, এক সাংস্কৃতিক পণ্যর চেহারা ও চরিত্র দিচ্ছেন। এই পণ্য নির্মাণ করতে গিয়েই দুই সংস্কৃতির কথোপকথন নির্মাণ করছেন সত্যজিৎ।
শরদিন্দুর 'সত্যান্বেষী' মন দিয়ে পড়লে দেখা যাবে, অজিত কিন্তু সমবয়সী ব্যোমকেশকে ভালবেসে ফেলেছে। এক ধরনের আবেগদীপ্ত সে সম্পর্ক। এই আবেগ কিন্তু লালমোহন আর ফেলুদার সম্পর্কে্র মধ্যে নেই, কিন্তু বন্ধুত্বের কিছু উচ্চারণও আবার আছে। এই যে বন্ধুত্ব থাকা আর না থাকা, এর মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই 'দ্বন্দ্ব' শব্দটা আমি ভারতচন্দ্রীয় অর্থে ব্যবহার করছি, যেখানে ঈশ্বরী পাটনিকে অন্নপূর্ণা বলেছেন, 'তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব আমার চলে অহর্নিশ'। এর মধ্যে যেন মিলন ও বিরহের সমাহার আছে। আবার দ্বন্দ্বসমাসের নিরিখে দেখলে একটা বৈপরীত্যও যেন আছে দু'-জনের মধ্যে। দ্বন্দ্বসমাস আপাত বিপরীত গুণের সমাবেশ ঘটায়। একজন উত্তর কলকাতার, একজন দক্ষিণ কলকাতার, একজন সুপুরুষ, দীর্ঘ, আরেকজন...
এই আরেকজনের জায়গায় এসে একটু থামলাম। কারণ, সন্তোষ দত্ত আমাদের কাছে সত্যজিতের লালমোহনের প্রতিমূর্তি। কিন্তু লহমায় ওই প্রতিমূর্তিতে সত্যজিৎ পৌঁছননি। অনেকটা সময় লেগেছিল। 'সোনার কেল্লা' উপন্যাসে জটায়ুর আবির্ভাবের বৃত্তান্ত খেয়াল করলে দেখা যাবে, জটায়ু বলছে, শরীরচর্চা করে পেশি বানাতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হলেন, তাই 'গায়ের মাসল'-এর থেকে 'ব্রেনের মাসল'-কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বোঝা যায়, উনিশ শতকীয় ধারায় শরীর নির্মাণের যে বাসনা বাঙালি বহন করছিল সেই বাসনা সাংস্কৃতিক যৌথ নিশ্চেতনার সূত্রে লালমোহন বহন করছে। উনিশ শতকে সাহেবরা আমাদের বলতেন, 'এফিমিনেট', বঙ্কিমচন্দ্র চটে যেতেন। বঙ্কিম বীর্যমান শক্তিশালী ভারতীয় পুরুষের ছবিই শুধু আঁকেননি, 'আনন্দমঠ'-এ বাঙালি মেয়ে শান্তিকে শাড়ি পরিয়ে ঘোড়ায় চড়িয়ে যুদ্ধে ছুটিয়েছেন। নীরদচন্দ্র চৌধুরী রসিকতা করে ফুট কাটতেন। শান্তি কীভাবে শাড়ি পরেছিল তিনি জানতে চাইতেন। মূল কথাটা হল, বাঙালির তথাকথিত মেয়েলিপনাকে অতিক্রম করে শারীরিকভাবে প্রবল বাঙালি তৈরি করতে হবে। পুরনো 'সখা' বা 'বালক'-এ ব্যায়ামবীর বাঙালির ছবি থাকত, বাঙালির শরীরচর্চার অনুপ্রেরণা থাকত। 'সখা'-র যুগ অতিক্রান্ত। বাঙালি তার শরীর গড়তে পারেনি। কিন্তু লালমোহনের হাত দিয়ে আমরা বাঙালির ইচ্ছের চেহারা-চরিত্রের পরিণতি কিছুটা দেখতে পাই তাঁর সৃষ্ট প্রখর রুদ্রর মাধ্যমে। আর লালমোহনের উল্টোদিকে রয়েছে ফেলুদা। ফেলুদা নিয়মিত যোগব্যায়াম করে, ক্রিকেট খেলে, নির্মেদ। এই দুই বিপরীতকে সত্যজিৎ ধীরে ধীরে নির্মাণ করলেন।
সত্যজিৎ যখন 'সোনার কেল্লা' ছবি করলেন, তখন তিনি যে বইয়ের ডিটেকটিভ গল্পের ধরনটা বদলে দিচ্ছেন, সেকথা তিনি চিঠিতে লিখছেন অজেয় রায়কে- "গল্প একেবারে ঢেলে সাজিয়ে মিস্ট্রি স্টোরির বদলে একটি কমেডি থ্রিলারে দাঁড় করিয়েছি।" এই কমেডি থ্রিলার তিনি বানালেন জটায়ুর আবির্ভাবের গল্পটি ধরেই। সুকুমার সেন তাঁর 'ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি'-তে লিখেছেন, গোয়েন্দা থাকবে, তার সহকারী বা বন্ধু থাকবে, এবং একজন পুলিশ থাকবে, যাকে বলা যায় কমিক রিলিফ। এই কাঠামোকে সুকুমার সেন বলেছেন 'ত্রিশূল'। হেমেন্দ্রকুমার রায় থেকে এর শুরু। এখন এই কমিক রিলিফ হিসেবে পুলিশদের রাখাই স্বভাবতই বাস্তবের পুলিশেরা এই জাতীয় গোয়েন্দা-কাহিনি পড়ে খুব চটে যান, চটে যাওয়ারই কথা। সত্যজিৎ পুলিশের বদলে লালমোহনকে নিয়ে এলেন ‘কমিক রিলিফ’ হিসেবে। সত্যজিতের গল্পের পুলিশ কিন্তু বুদ্ধিমান, ক্ষেত্রবিশেষে ফেলুদাকে সাহায্যও করে। পরাধীন ভারত আর স্বাধীন ভারতের পুলিশ গোয়েন্দা গল্পে আলাদাভাবে উপস্থাপিত। স্বাধীন ভারতে পুলিশকে হাস্যকর করে, কৌতুকের বিষয় হিসেবে উপস্থাপনা করে তো লাভ নেই। তার বদলে আসছেন লালমোহন। 'সোনার কেল্লা' গল্পে কিন্তু লালমোহনকে দেখে বা শুনে অতটা মজা তৈরি হয় না, মজাটা অনেক বেশি রয়েছে ছবিতে। এটা সত্যজিৎ ছবিতে করলেন।
১৯৪৭ সালে থিওডোর অ্যাডোর্নো তাঁর 'ডায়লেকটিক অফ এনলাইটেনমেন্ট'-এ সাংস্কৃতিক পণ্য নিয়ে, জন-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তিনি ভাবছিলেন ও বিশ্লেষণ করছিলেন সাংস্কৃতিক পণ্য ও তা জনসমাজে সম্প্রচারের প্রক্রিয়া, চাহিদা কীভাবে যথার্থ শিল্পের থেকে মানুষকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। সত্যজিৎ কিন্তু এই নিয়তিকে মেনে নিয়েছেন। বাজারের সঙ্গে তিনি বৈরি সম্পর্কে যাচ্ছেন না।
'সোনার কেল্লা' গ্রন্থ সংস্করণে লালমোহনের হিন্দি ভাষার প্রয়োগ ছিল না। লালমোহন সেখানে বাংলায় আত্মপরিচয় দিয়েছে। এক অবাঙালি সহযাত্রীর কথা বলা আছে, যে কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে খেয়েছে, কাগজের ওপর রেখেছে। এইটুকুই। ছবিতে দেখা গেল তিনটে স্তর। দক্ষিণ কলকাতার শিক্ষিত, মগজদার গোয়েন্দা ফেলুদা, বিপরীতে সাধারণ, জনপ্রিয়, ছদ্মনামে গোয়েন্দা গল্প রচয়িতা বেঁটেখাটো, গোলগাল লালমোহন। আর রয়েছে একজন অবাঙালি যিনি নীরবে খেয়ে চলে, এবং লালমোহন তাকে অদ্ভুত হিন্দিতে ‘বিমোহিত’ করে। সে অবাক হয়ে এই বাঙালিবাবুর হিন্দি শোনে এবং মুগ্ধ হন। ক্ষমতার এই তিনটে স্তর দেখা যায়। সাতের দশক, তখনও সর্বভারতীয় স্তরে বাঙালি ভদ্রলোক গুরুত্বপূর্ণ, তাদের বাঙালি বলে আলাদা করে আর গুরুত্ব দেওয়া হবে না এমন সর্বভারতীয় মনোভাব তৈরি হয়নি। সত্যজিৎ ছবিতে এই তিনটি স্তরকে রেখেছেন– দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য।
এখন ফেলুদা আর লালমোহনের কথোপকথনটা শুরু হবে কী করে? ফেলুদা লালমোহনের সংস্কৃতিকে শুধরে নিয়ে গ্রহণ করছেন, ফেলে দিচ্ছেন না। ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে এই প্রবাদসম বাক্যের প্রয়োগ- "সাতে শুধরে নেবেন।" সত্যজিতের কাছ থেকেই আমরা এই শুধরে নেওয়াটা শিখি। ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির হাত ধরে বিশ শতকেও যখন নতুন প্রযুক্তি আসছিল, তখন বাঙালির মধ্যে একদল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পণ্য উপভোগ করার কাবিল হয়ে উঠছিলেং। পাশ্চাত্য সংগীত বা ছবির বিষয়ে সত্যজিৎ অসম্ভব আগ্রহী, কিন্তু কীভাবে তা উপভোগ করবেন? মাঝেমধ্যে সত্যজিৎ নীরদ চৌধুরীর বাড়িতে যেতেন, পাশ্চাত্যের ছবি দেখতে, গান শুনতে। নীরদবাবু সেই বাঙালি, যিনি তাঁর অনুশীলিত প্রজ্ঞাকে কখনও অন্যের সঙ্গে শিক্ষায় বিনিময় করেন না। কৌতুক করেন, তামাশা করেন। সত্যজিৎ অন্যদিকে, যা অনুশীলন করেছেন, তিনি চান তা সাধারণে সম্প্রসারিত হোক। তাই ফেলুদা এক অর্থে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লালমোহনকে বাদ দেবে না, তাকে আস্তে আস্তে শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যাবে, লালমোহনের দ্বারা ফেলুদাও উপকৃত।
'জয় বাবা ফেলুনাথ'-এর কথাই ধরা যাক। দেখা যাবে, লালমোহন ও অক্রুর দত্তর লেখা রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ গুলে খেয়েছে রুকু। সেই সিরিজ থেকেই সে পরিকল্পনা করেছে, গণেশ কোথায় লুকিয়ে রাখতে হবে। ছবিতে নয়, তবে গল্পে কিন্তু পরিকল্পনা রুকুরই, তার ঠাকুরদার নয়। ফেলুদাও এই রহস্য একটা স্তরে ভেদ করতে পারছে না। এখানে মনে রাখতে হবে, সত্যজিৎ কখনওই কিন্তু কল্পনার বিরোধী নন, অর্থাৎ কল্পনার যে অতিরেক, তারও যে একটা মানে আছে, তা সত্যজিৎ মানেন। 'অঙ্ক স্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু'-র সেই অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের কথা ভাবুন, যে রূপকথাকে বাতিল করল, কিন্তু শেষ অবধি এমন এক অভিযাত্রায় শামিল হল, যা তাকে রূপকথার গুরুত্ব মানতে বাধ্য করল। অর্থাৎ কল্পনাকে বাতিল করে যে যুক্তি, সেই কাঠ-কাঠ যুক্তিকে সত্যজিৎ স্বীকার করবেন না। সত্যজিৎ তাই ফেলুদার মুখ দিয়ে বলান, লালমোহনের রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের বইগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এখানে আরেকটা জিনিস লক্ষণীয়, রুকু ভেবেছিল, গণেশটা সমুদ্রে চলে যাবে। একটা কুমির সেটাকে খাবে। কুমিরটাকে রুকু হারপুন দিয়ে মেরে গণেশটা উদ্ধার করবে। কল্পনার এই জগৎ পর্যন্ত রুকুকে ফেলুদা যেতে দেয় না। অর্থাৎ কল্পনার মূলটা লালমোহনের থেকে নেওয়া, তার বিস্তার কতটা হবে, তা নিয়ন্ত্রণ করছে ফেলুদা। সত্যজিৎ কোথাও একটা সামঞ্জস্য-পন্থায় বিশ্বাস করেন। যেখানে একটা কথোপকথন আছে, যার ওপর ভিত্তি করে ফেলুদা আর লালমোহনের বন্ধুত্ব তৈরি।
এই কথোপকথন কেন দরকার ছিল? সত্যজিৎ একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁর প্রিয় নাটক 'টিনের তলোয়ার'। এই নাটকের প্রথম দৃশ্যে উনিশ শতকের কলকাতায় ভদ্রলোকদের সঙ্গে কলকাতার তলার লোকদের যে বিভাজনটা দেখানো হয়েছে, সেই বিভাজনের মাঝে একটা সেতু নির্মাণের প্রয়োজন ছিল। স্বাধীন ভারতে এই ছোটদের লেখার মাধ্যমে যদি সেই যোগাযোগের কথা ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে হয়তো কল্পনা আর যুক্তির-আদর্শের মধ্যে সামঞ্জস্য নির্মাণ সম্ভব।
২২ এপ্রিল সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের নিবেদন 'সত্যজিতের ফেলুদা: কাহিনি, পণ্য ও দ্বন্দ্ব' শীর্ষক বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত অনুলিখিত রূপ বক্তার অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হল। অনুলিখন: প্রিয়ক মিত্র।