আরিয়ানকে লেখা খোলা চিঠি

আরিয়ান,

তোমার মুখোমুখি হলে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, এখন কেমন আছ? 'তুমি' বলছি কারণ তুমি আমার চেয়ে কম পক্ষে নয় বছরের ছোট বলে নয়, তোমাকে আমার পাড়াতুতো ভাইয়ের মতোই কেউ ভাবছি বলে। আমি অসংখ্য বখাটে ছেলে দেখেছি আরিয়ান। বখাটে হওয়ার কারণে তাদের জীবনটা যে ততটা কুসুমাস্তীর্ণ হয় না, তাও দেখেছি। আমার পাড়ার এক দাদা, ফূর্তিবাজ, নেশাখোর, কুলতিলক ভদকা ও  বিড়ির ধুমকি নিতে নিতে তুবড়ি বাঁধছিল। অন্যমনস্ক হয়ে সে বিড়ির শেষাংশটা ফেলে তুবড়ির জন্য জমানো বারুদের গাদায়। তিনতলা বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছিল। আমি টুবাইদাকে সারাজীবনের কৃতকর্মের জন্য জ্বলতে জ্বলতে জ্বলতে নীচে নামতে দেখেছি। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি। বাঁচাতে পারিনি। আমি জানি বখাটে হলে মূল্য দিতে হয়। তবু হাওয়ার ধর্ম, জলের ধর্মের মতো কৈশোরের ধর্মই হল বখে যাওয়া। মাঠে খুব ভালো রেফারি যেমন গোটা খেলাটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে, তেমন লোকের পাল্লায় পড়লে টলমল টলমল সেতু পার করে ফেলে কেউ কেউ। অনেকে পারে না,হারিয়ে যায়। তারপরেও জীবন অবশ্য একটা থাকে, যার যার মতো করে মানুষ সে জীবনটাকে চালিয়েও নিয়ে যায়।

আরিয়ান তুমি যে অন্যায়টা করেছো বলে অভিযোগ, তার থেকে অনেক গুরুতর অন্যায় করে লোকে বুক বাজিয়ে ঘোরে, কখনও সাফার করে না, শাস্তি পায় না, এ কথা নিশ্চয়ই তোমার মাথায় এসেছে। অপমানে ন্যুব্জ হয়ে গিয়েছো তুমি, দেখছিলাম। তোমার মুখ ১০০ কোটি লোক চেনে কেননা তোমার মুখাবয়বের সঙ্গে যে মুখাবয়বের মিল রয়েছে তা ১০০ কোটির শ্বাসপ্রশ্বাসে জড়িয়ে। আর সেই মুখই তুমি দেখাতে পারছিলে না।

টিউশন ফেরত গাঁজা পরখ করেনি, এমন বাঙালি যুবক গুনতে হবে, এই নিষ্ঠুর সত্যিটা তোমায় জানাতে চাই। আমাদের মতো ছেলেপিলেরা তো বটেই, এই শহরের অনেক বয়স্ক মানুষও গাঁজার গোপন আস্তানা চেনে, চেনে কিন্তু বলে না, প্রকাশ্যে কেনে না, ধরায় না, কারণ তা আইনি অন্যায় এ দেশের সাপেক্ষে। আইন আছে বলেই আইন ভাঙার একটা অভীপ্সা, নিষেধের অন্ধ আকর্ষণ তা তো তোমার বয়সের ধর্ম। তোমায় বলি, গাঁজা-চরসে যখনতখন পুলিশি হেফাজত হলে,  বাংলার বাউল-ফকির সমাজকে জেলেই থাকতে হতো। গঙ্গাসাগরটাই জেলখানা হয়ে যেতো। তুমি এসব জানো। তুমি জানো যে তুমি প্রতিহিংসার শিকার। তুমি বোড়ে।

আমার চোখে তুমি দ্বি-প্রান্তিক। কেন বলছি এ কথা? একদিকে তুমি যে কারণে শাস্তি পেলে সে কারণে নব্বই ভাগ ছাড় পায়। দ্বিতীয়ত শাস্তি পেলে নব্বই ভাগকে যতটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়, অপমানিত বোধ করতে হয় তুমি তার চেয়ে অনেকানেক বেশি অপমানের বোঝা বইছ, তোমার নিশ্চয়ই নিজেকে গাধার পিঠে চড়া আবহমানের ভাড় মনে হচ্ছে। কারণ তোমার বাবা শাহরুখ খান। শাইনিং ইন্ডিয়া, নিওলিবারেল ভারতবর্ষের সূচক তোমার বাবা।

তুমি তো জানোই, আমরাও জানি, বিংশ শতকের গোড়ায় আমাদের নাগরিক পরিসরে এই যে আর্চিস গ্যালারিময় যৌবন, ভ্যালেন্টাইন ডে, রোজ ডে, হাগ ডে, সুগন্ধী সাবানের মায়ার মতো নানাবিধ পশ্চিমী জোয়ার তা তোমার বাবা না থাকলে এভাবে আসত না। ভালো মন্দ পরের কথা, নেহরুভিয়ান ভারতবর্ষের মাঠটাকে বড় করার যে পরিকল্পনা, আমাদের মনোজগতে, নব্বইয়ের দশকে সেই ঘটনার রূপকার তোমার বাবা। ১০০ কোটি মানুষের অভীপ্সা তোমার বাবা। কাজেই তোমাকে পল অনুপল ভাবতে হয়েছে এই অপমানটা তোমার বাবারও। ১০০ কোটি মানুষ কী ভাবছে তোমাকে ভাবতে হয়েছে। কী বিশাল অভিঘাত, লঘুপাপে গুরুদণ্ড প্রবাদটি হয়তো কখনও তোমার নামের সমার্থক হিসেবে জুড়ে যাবে।

আরিয়ান তোমার বাবা নানা সাক্ষাৎকারে নিজের জীবনকে যে ভাবে তুলে ধরেন, তাতে আমরা বুঝতে পারি, ভারতের হৃদয়াধিপতি আজও স্বপ্নে বাঁচেন। দিল্লির সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান স্বপ্ন দেখেছিল বান্দ্রার এই মান্নাত বিল্ডিং। তাই সে কাজ করেছে, জোয়াল টেনেছে বিনোদন দুনিয়ায়। তার যে অর্জন তা ঘামের নুনে পাওয়া। তোমাকে নিশ্চয়ই ভাবতে হয়েছে, তোমার ছোট্ট ভুল এই মহাপ্রাণের মিনারটা গুড়িয়ে দিল। আমাদের কাউকে এভাবে ভাবতে হয়নি। এই অভিশাপ বইতে হয়নি। আমি তোমার দুঃখের তিলমাত্র অনুভব করতে পারছি।

আমরা এই সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় নিজেদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি বিচারকের ভূমিকায়। অবশ্য় সোশ্যাল মিডিয়াই বা বলছি কেন, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ আসার আগেই তো আমরা আমাদের লেন্সে বিচার করে গিয়েছি রোহন গাওস্কার, সন্দীপ রায়দের। তাদের পৃথক অস্তিত্বকে মান্যতা দেইনি। আমি মনে করি এই যে সন্দীপ রায় প্রায় সিনেমা বানানই না, এত ভালো পাঠক-লেখক হয়েও প্রায় লেখেনই না, তার দায় তো আমাদেরই। অথচ আজ যারা ছবি বানায়, মেধার উৎকর্ষের প্রশ্নে এই বাংলায় তারা কেউই সন্দীপের থেকে বিরাট এগিয়ে থাকা কেউ নয় বলেই মনে হয়। আমাদের স্থির করে দেওয়া স্কেলে হয়ে ওঠাটা যে কী যন্ত্রণার তা আমাদের মস্তিষ্কে ঢোকেনি কখনও। আমরা অন্যরকম হলে হয়তো তোমার বেদনাভারটা একটু কমত।

আরিয়ান আমার বাবা আমার খুব কম বয়স থেকে ঘুরে বেড়ান। নানা জায়গায় ঘুরে নিজস্ব পণ্যের সওদা করাটাই তাঁর কাজ। একার্থে তাকে আমি খুব বিরাট করে পাইনি। কিন্তু যখন পেয়েছি তখন আমের আঁটিটাও চুষে নিয়েছি। আমার বাবার আমার থেকে বড় কোনও চাহিদা ছিল না কখনও। আমরা ছাড়া কারও প্রত্যাশার চাপই নিতে হয়নি তাঁকে। কিন্তু এই সেদিন তুমি যখন বললে, বাবার সঙ্গে দেখা করতে হয় অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে, আমি বুঝলাম তোমার বুকে নিশ্চয়ই একটা প্রবল ঝালা বেজে চলেছে বহু বছর, গলায় জমে আছে অভিমান। এমন হতভাগ্য এক কিশোর হিসেবে তুমি যদি কোনও অন্য়ায় করে থাকো, তা আসলে ছিল তোমার অস্বাভাবিক জীবন থেকে এসকেপ রুট। কিন্তু মনের এই চলনকে রাষ্ট্র মান্যতা দেয় না।  আম-আদমি হলে রাষ্ট্র হয়তো গণ্যই করত না, কিন্তু তুমি বোড়ে হয়ে গিয়েছ তোমার বাবা শাহরুখ খান বলেই।

তোমার জন্য আশার কথা লিখব বলে এই চিঠি শুরু করেছিলাম। কিন্তু দেখছি একলাইনেও মেকি আশাবাদের চাষ করতে পারিনি। আমি জানি, তোমার কাছের মানুষরা, তোমার বাবার বন্ধুরা তোমার পাশে থাকবে এসময়। শুশ্রুষা পেলে তুমি ভালো হয়ে যাবে, আশা রাখি। শুধু এটুকু বলি আরিয়ান, দাবার বোর্ডে  রাজার খুব কাছাকাছিই থাকে বোরে। রাজাকে বিধ্বস্ত করতে সবচেয়ে সহজ চালই হল বোরে খাওয়া, কেননা সেও বিপজ্জনক অভিমন্যু, বিশ্বস্ত, সবার আগে প্রাণদানে প্রস্তুত। রাষ্ট্র একটি প্রেডিক্টেবল ব্যাপার। প্রতিহিংসার কুরুক্ষেত্রে সে বিরল কিছু করেনি।

তোমার বোরে হয়ে যাওয়াটা আমরা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলাম অনেকে। কেউ কেউ হয়তো কষ্টও পেল। কিন্তু এগুলি কোনওটাই তোমার দুঃখের থেকে বড় নয়। এখন এ অবদমনের উত্তর তুমি কী ভাবে দেবে এটাই বড় প্রশ্ন। তোমার বয়েস পেরিয়ে আসা আমি বলব, বোরের মতোই এক ঘর এক ঘর করে এগোও। হারিয়ে যাও অন্যত্র, আমাদের জিও- লোকেশানের বাইরে। বৈভবের থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মহাজীবনকে ছুঁয়ে দেখো যদি পারো। আমরা যেন তোমাকে ভুলে যাই। তেমনটা হলেই হয়তো তুমি আমাদের ক্ষমা করতে পারবে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

More Articles