'আমি খুঁজি আমাকে': ‘কলকাতার তলায় থাকা’ মানুষকে যেভাবে ডাক দিলেন অনির্বাণ-ঋদ্ধি

Ami Khuji Amake Music Video: কলকাতার শিক্ষিত শ্রেণি যতই রণজিৎ গুহ আর পেডাগগি অব দ্য অপ্রেসড আওড়াক না কেন, কাজের সময় তার ১০%-ও প্রকাশ পায়না অনেকক্ষেত্রেই।

প্রথমেই গৌরচন্দ্রিকা করে রাখি, এই লেখা কোনও অ্যানালিটিকাল বা ক্রিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা নয়। এই শহরে, এই বাংলায় আমার সমসাময়িক কালের বেশ কিছু ‘প্রকৃত শিল্পী’ যে অভাবনীয় কাজটি করেছেন তার সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কিছু ভালোলাগার অনুভূতি তুলে ধরার জন্যই এই লেখা। এ গান যারা অন্ধকারে আছে তাদের আলোয় ডেকে নেওয়ার গান, যারা পূর্ণিমার চাঁদের উল্টো পিঠে আছে তাদের দপ করে জ্বলে ওঠার গান। কোন গানের কথা বলছি? বলছি, ‘আমি খুঁজি আমাকে’র কথা। ‘কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি’র ‘আমি আর্ট ফেস্টিভ্যাল '২২’ এর জন্য এই গান ও এই মিউজিক ভিডিও। গান লিখেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সুরারোপ করেছেন শুভদীপ গুহ, গেয়েছেন শুভদীপ, অনির্বান, রঞ্জিতা ও জয়ন্ত। মিউজিক ভিডিওটির নির্দেশক ঋদ্ধি সেন ও তাঁর দল।

এই দলে যাঁরা আছেন তাঁদের অনেকেই পৃথক পৃথকভাবে পরিচিত নাম, নয় ক্যামেরার সামনে, নয়তো মঞ্চে। যাঁদের মধ্যে সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজর্ষি নাগ, উজান চট্টোপাধ্যায়, বিশাখ সরকার অন্যতম। গানটি প্রথম শোনার পরই যাকে গোদা বাংলায় বলে ‘ছিটকে যাওয়া’, সেই অবস্থাই হয়েছিল। এর মূলে রয়েছে, প্রথমত গানের কথা ও সুর এবং দ্বিতীয়ত মিউজিক ভিডিওর ভিজ্যুয়ালের যুগ্ম প্রভাব।

যাঁরা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের লেখনীর সঙ্গে পরিচিত, সে 'নিজেদের মতে নিজেদের গান' হোক, ‘ভ্যাকসিনের গান’ হোক বা ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র গানই হোক, তাঁরা জানেন অনির্বাণের লেখা শ্রোতার হৃদয়ে কতটা গভীরে রেখাপাত করতে পারে। এবারেও তার অন্যথা হয়নি অবশ্যই। তবে এবারের উপরি পাওনা গানের মধ্যে রবি ঠাকুর, লালন, জীবনানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের উঁকিঝুঁকি।

আরও পড়ুন- ‘দরকার হলে সারাজীবনে চারটে সিনেমা করব, কিন্তু সৎভাবে করব’: অনির্বাণ ভট্টাচার্য

‘মন্দার’ ও ‘বল্লভপুরে’র পর শুভদীপ গুহ (যাঁকে গোটা বাংলা থিয়েটার মহল বাবান নামেই চেনে) এখন চলচ্চিত্রের ধারাতেও পরিচিত নাম। থিয়েটারের দর্শক শুভদীপের সংগীত সৃষ্টি ও কণ্ঠের মাদকতার স্বাদ বহু আগে থেকেই পেয়ে এসেছেন। এখন বৃহত্তর প্রেক্ষিতে আরও বহু বহু মানুষ সেই মাদকতার স্বাদ পাচ্ছেন এবং তার সঙ্গে অবশ্যই জুড়ে আছে অনির্বাণের কণ্ঠের এক ম্যাজিক।

এবার আসা যাক মিউজিক ভিডিওটির কথায়, যদিও সেইভাবে পৃথক করে দেখা সম্ভব নয়, তাও যদি অডিও ও ভিজ্যুয়ালকে দু'টি ভিন্ন ভাগ হিসাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা যায়, তাহলে অডিওকে এর ভিজ্যুয়াল দৃশ্যায়ণ বেশ কিছু অংশে ছাপিয়ে গেছে বলেই মনে করা যায়। প্রথমেই যে লোকেশনটি ঋদ্ধি বেছেছেন এই মিউজিক ভিডিওটির জন্য তা নিজের মধ্যেই নিজে অনন্য। বাংলার সংস্কৃতি, কৃষ্টি, শিল্প মননকে তুলে ধরার গানের দৃশ্যপট যে টাঙা বস্তি হতে পারে, প্রথমেই এই ভাবনাটিকে কুর্নিশ জানাতে হয়।

পরিচালক হিসাবে ঋদ্ধির প্রথম কাজ নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কোল্ডফায়ার’ অবলম্বনে তৈরি একটি শর্টফিল্ম (২০২০) যা এখনও সাধারণ দর্শকদের জন্য মুক্তি পায়নি। গতবছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে মুক্তি পায় ‘নিজেদের মতে নিজেদের গান’ যার মিউজিক ভিডিও ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুগ্মভাবে নির্দেশনা দেন ঋদ্ধি। ‘আমি খুঁজি আমাকে’ ঋদ্ধির একক নির্দেশনার প্রথম কাজ যা দর্শকদের সামনে এল এবং একথা বলাই বাহুল্য, ঋদ্ধি নিজের শিল্পী মনন ঢেলে দিয়েছেন এই কাজে। নির্দেশক বিভিন্ন রকম চমক দিয়েছেন গোটা ভিডিওটিতে (প্রতিটাই সুস্থ চমক, গিমিক নয়)। যেমন ধরা যায়, মাটিতে বাচ্চাদের বক আঁকা ও তার সঙ্গে ভিএফএক্সে বকের আগমনের জায়গাটি, বাইকের হেডলাইট জ্বেলে আঁধার ঘোচানোর জায়গাটি এবং অবশ্যই ছায়ার জায়গাটি। ভিডিওতে, যখন ওই বস্তির মধ্যে বাইরের কিছু শিল্পমনস্ক মানুষ আসেন ও তাঁদের মধ্যে একজন (কৌশানি মুখোপাধ্যায়) একটি কাপড় ছুঁড়ে দেয় বস্তিবাসী কিশোর কিশোরীদের দিকে, তখন মুহূর্তে ওই কাপড়টি ছায়ার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হতে দেখানো দর্শককে তাক লাগায়। এখানেও একটা কথা বলার থাকে, ওই ছায়ামূর্তির স্ক্রিনে আগমনে ছৌ ও রায়বেশের যে অনন্য মিশ্রণ দেখালেন ঋদ্ধি তা দর্শকের বহু বহুদিন মনে থেকে যাবে।

আরও পড়ুন- নড়ে উঠল পাতা, ধেয়ে এল ট্রেন! যেভাবে পর্দায় এল বিশ্বের প্রথম সিনেমা

ভিডিওতে দেখতে পাওয়া যায় এমন দু'জনকে যারা ‘সঞ্জয় মণ্ডল ব্যান্ড’-এর সদস্য। ভিডিওর একদম শেষে স্ক্রিনে অনির্বাণকে দেখা যাওয়া ও তাঁর গলায় ‘মিলন হবে কত দিনে’ যেন এই অন্ধকারে আলোর সঙ্গে মিলনের পথকেই প্রশস্ত করে।

এবার একদম ভিন্ন একটা প্রসঙ্গে আসা যাক , ঋদ্ধি একটি সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, তাঁদের অ্যাডভেঞ্চারের লক্ষ্য থেকেও ক্যামেরার পিছনের গোটা রান্নাঘরটাকে অনুপুঙ্খভাবে চেনার জন্যই তাঁরা ‘অডভেঞ্চার্স’ গড়ে তোলেন। এই কাজ, এই মিউজিক ভিডিও ‘অডভেঞ্চার্স’এরই কাজ, ঋদ্ধি, সুরঙ্গনা, রাজর্ষি, বিশাখদের কাজ।

এই সত্য অস্বীকার করার নেই, এই গান যাঁদের জন্য বানানো তাঁদের মূলে যে সংস্থা আছে, তার সঙ্গে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ওতপ্রোত যোগ আছে। কিন্তু সেই ‘দৈত্যকূলে’ দাঁড়িয়ে ‘প্রহ্লাদের মতো আচরণ করে এই মিউজিক ভিডিও, কথা বলে কলকাতার সবথেকে অবহেলিত মানুষগুলোকে নিয়ে (যাদের এলিট প্রগতিশীল বাবু’রা প্রোলেতাঁরিয়েত বলে ডাকতে পছন্দ করেন)। মনে পড়ে যায় টিনের তলোয়ারের মেথরের সেই অমোঘ উক্তি "আমরা কলকাতার তলায় থাকি"। ঋদ্ধি বা অনির্বাণ কেউই কিন্তু তাঁদের কলকাতার তলা থেকে তুলে এনে মহৎ হতে চাইলেন না, বরং তাঁরা তাদের আলোর দিকে ডেকে নিলেন। ঋদ্ধিরা বিশ্বাস করেন, "বঞ্চিতরা সঞ্চিত মাল ছিনিয়ে নিতে জানে", ওরা সবাই নিজের পায়ে ভর করেই আলোর দিকে হেঁটে আসবে।

ভিডিওর শেষে ফাতিমা বিবি, সাকিনা বিবি, আফরোজ ও সকল আঞ্চলিক মানুষদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানানোর ভঙ্গি থেকেই নির্মাতাদের তাঁদের প্রতি আন্তরিক সম্মানের বোধটা খুঁজে পাওয়া যায়। কলকাতার শিক্ষিত শ্রেণি যতই রণজিৎ গুহ আর পেডাগগি অব দ্য অপ্রেসড আওড়াক না কেন, কাজের সময় তার ১০%-ও প্রকাশ পায়না অনেকক্ষেত্রেই। ঋদ্ধিরা সেই খরা কাটালেন, সেই স্টিরিওটাইপ ভাঙলেন, কলকাতার মধ্যে যে আরেকটা কলকাতা আছে প্রায় চোখে আঙুল দিয়ে সেটা চেনালেন। দর্শক যদি আরও একটু সচেতন হয়, এই কাজ বহু বহুদিন থেকে যাবে।

 

More Articles