পরিসংখ্যান বনাম বাস্তব: মেয়েদের জন্য কতটা নিরাপদ কলকাতা শহর?

Kolkata Safe City: বারবার কলকাতায় মেয়েদের হেনস্থা এবং যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়ছে রাজ্যের নিরাপত্তা তাই কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়।

কলকাতা নিরাপত্তার দিক দিয়ে অনেক শহরের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছে, বিশেষ করে জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো (NCRB)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শহরটি চতুর্থবারের মতো সবচেয়ে নিরাপদ শহর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে।  এটি দেখায়, বড় শহরগুলোর মধ্যে কলকাতার অপরাধের হার তুলনামূলকভাবে কম। তবে প্রশ্ন থাকে— “নিরাপদ” মানে কি সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত? বারবার কলকাতায় মেয়েদের হেনস্থা এবং যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়ছে রাজ্যের নিরাপত্তা তাই কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। সত্যি কি কলকাতা মেয়েদের জন্য নিরাপদ? 

২০২৩ সালে কলকাতায় প্রতি এক লক্ষ মানুষের মধ্যে গুরুতর অপরাধের সংখ্যা ৮৩.৯। এটি ২০১৬ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। নারী নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও কলকাতা ইতিবাচক ফল দেখিয়েছে। ২০২৩ সালে নারীর বিরুদ্ধে ১,৭৪৬টি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে, যা ২০২২ সালের ১,৮৯০ এবং ২০২১ সালের ১,৭৮৩-এর তুলনায় কম। পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক অপরাধের হারও কমেছে। রাজ্যের অপরাধের হার ১৮১.৬, যা জাতীয় গড় ৪৩৩-এর তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ, শুধু কলকাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য শহরও নিরাপদ হচ্ছে।

আরও পড়ুন - অভয়ার জন্য খোলা চিঠি যে-লড়াই শুরু হয়েছিল তা এখনও থামেনি জানিস

কিন্তু বাস্তব চিত্র এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে মিলছে কি? গত এক বছরের ঘটনা বোঝায়, নারী নিরাপত্তা নিয়ে এখনও আশঙ্কা  রয়েই গিয়েছে। তুলে ধরা হলো এমনই কিছু ঘটনা— 

মহিলা সাংবাদিক হেনস্থা

গত ২ অক্টোবর, দশমীর রাতে বাড়ি ফেরার পথে সোদপুর রেলওয়ে স্টেশনের সাবওয়েতে শ্লীলতাহানির শিকার হন ২৩ বছর বয়সি এক মহিলা সাংবাদিক। নির্যাতিতার অভিযোগ, হিন্দিভাষী একদল মদ্যপ যুবক তাঁকে অশ্লীল মন্তব্য করে এবং অশালীনভাবে স্পর্শ করলে তিনি প্রতিবাদ জানান, এরপরই তাঁকে মারধর করে পালিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। সাহায্যের জন্য চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি, এমনকি প্ল্যাটফর্মে থাকা জিআরপি কর্মীরাও হস্তক্ষেপ করেননি। পরে দমদম জিআরপি-র ওসি হস্তক্ষেপ করলে মহিলা সাংবাদিকের অভিযোগের ভিত্তিতে পদক্ষেপ শুরু হয়।

আরজি কর কাণ্ড

৯ অগাস্ট, ২০২৪ আরজি করের ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর প্রশ্নের মুখে পড়ে রাজ্যের নারী নিরাপত্তা। ৩৬ ঘণ্টা ডিউটি করার পর অভয়ার সঙ্গে ঘটে যায় বর্বরোচিত ঘটনা। নিহত চিকিৎসকের ন্যায়বিচার এবং মেয়েদের নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন রাজ্যবাসী। ডাক দেওয়া হয় 'রাত দখলের কর্মসূচি'-র। রাস্তায় নামেন লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশু ও প্রবীণ সকলে। তারপরও পরিস্থিতি বদলায়নি, ঘটে গিয়েছে আরও একাধিক ঘটনা।

কলেজে ধর্ষণ ও হেনস্থা

কসবা এলএল কলেজে একাধিক ধর্ষণ ও যৌন হেনস্থার ঘটনা সামনে এসেছে। কিছু ছাত্রীর অভিযোগ দীর্ঘদিন বিচার পায়নি। সম্প্রতি এক শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে অভিযোগ দায়ের করেছে। এটি দেখায় যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নারীদের নিরাপত্তা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হয়নি।

বিদ্যালয়ে হেনস্থা

১৭ জুলাই উত্তর ২৪ পরগনার একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছিল। পুলিশ, শিক্ষক সুদীপ্ত মৈত্র-কে গ্রেফতার করে এবং পকসো আইনে মামলা রুজু করা হয়। তবে অনেক সময় অভিযোগ দায়েরের পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।

চিকিৎসাকেন্দ্রে হেনস্থা

২০ জুন বারাসাতের একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে মা ও মেয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়ে যৌন হেনস্থার শিকার হন। অভিযোগ জানালেও কর্তৃপক্ষ কোনো সহায়তা করেনি। পরে থানায় লিখিত অভিযোগ করার পরই তদন্ত শুরু হয়। এতেই বোঝা যায়, নিরাপত্তার ঘাটতি হাসপাতাল-সহ অন্যান্য জনসাধারণের জায়গাতেও বিদ্যমান।

নাবালিকা ও নার্সকে ব্ল্যাকমেল

পুরুলিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে এক তরুণী নার্সের ফোন চুরি হয়। এরপর তাঁকে ব্ল্যাকমেল করা হয় এবং তাঁর গোপন ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়ানো হয়। পুলিশের এবং সাইবার সেলের তদন্তের পর অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হলেও, জেলা আদালতে শর্তসাপেক্ষে জামিন মঞ্জুর হয়। প্রশ্ন থেকে যায়— গুরুতর অভিযোগের পরও কেন দোষীর শাস্তি হয় না?

গণধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ অপরাধ

কল্যাণী ও বর্ধমান-নবদ্বীপ রোডে গত বছর একের পর এক গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। স্বামী-স্ত্রী, বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া কিশোরী—সবক্ষেত্রেই নারীরা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। কুলতলিতে নাবালিকা ধর্ষণ, কল্যাণীতে বাড়ি থেকে ডেকে ধর্ষণ— এগুলো প্রমাণ করে নিরাপত্তা শুধু চারদিকের পরিসংখ্যানের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় না।

আরও পড়ুন- অভয়াকাণ্ডের ঠিক পরেই কী কী ঘটেছিল আর জি কর হাসপাতালে?

হাসপাতাল, বিদ্যালয়, কলেজ— সব জায়গায় নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী কলকাতা অনেকটা নিরাপদ হলেও “নিরাপদ” বলতে সব ক্ষেত্রে বিপদমুক্ত নয়—এটি মূলত অপরাধের হার অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় কম বোঝায়। সমাজকর্মী রিমঝিম সিনহা ইনস্ক্রিপ্ট-কে বলেন, "২০২১-এ ১০৩.৫%, ২০২২-এ ৮৬.৫%, এবং ২০২৩-এ প্রতি এক লাখ মানুষে ৮৩.৯% গুরুতর অপরাধ ঘটেছে। সেই একই রিপোর্ট বলছে, ভারতবর্ষে অ্যাসিড অ্যাটাকের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে শীর্ষে। গোটা দেশে নথিভুক্ত হয়েছে ২০৭টি ঘটনা, আর তার মধ্যে ৫৭ টি বাংলায়। আমরা সবাই জানি যে, কোনো পরিসংখ্যান নথিভুক্ত হওয়া ঘটনার উপরেই করা সম্ভব এবং আমাদের দেশে এখনও বহু মহিলা কেস নথিভুক্ত করা কেন, কোন বিষয় আসলে হিংসার আওতায় পড়ে, সেটুকু নিয়েই সঠিকভাবে সচেতন নন— কাজের সুত্রে বুঝেছি, কলকাতাও বাদ যায় না সেই ক্ষেত্রে। প্রশ্ন জাগে, ঘটনা ঘটার হার কমেছে, নাকি ঘটনা নথিভুক্ত করানোর হার?"

সমাজকর্মী শতাব্দী দাশের কথায়, "প্রান্তিক, কামদুনি বা হাঁসখালিতে বারবার নৃশংস ঘটনা ঘটলেও, অন্তত এন সি আর বি-র তথ্য অনুযায়ী কলকাতাকে নিরাপদতম শহর ভেবে কেউ কেউ খুশি ছিলেন। কিন্তু আর জি করের দৃষ্টান্তের পর, তথ্যপ্রমাণ নিয়ে পুলিসি ও সরকারি স্তরে এত দুর্নীতি দেখার পর, সংশয় জেগেছে— কলকাতার এই নারী-নিরাপত্তার ইমেজ সত্য, না বানানো? মুখ্যমন্ত্রী নিজে যেখানে ভিক্টিম ব্লেমিং করেন সেখানে সব অপরাধ নথিভুক্ত হয় তো?"

উল্লেখ্য, কলকাতার পরিসংখ্যান যতই ভাল দেখাক, বাস্তব চিত্রের সঙ্গে মিল রাখার জন্য অনেককিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুধু পরিসংখ্যান নয়, কার্যকর পদক্ষেপ, সচেতনতা এবং শক্তিশালী আইনি ব্যবস্থাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

More Articles