ফিরল '৭৮ এর স্মৃতি! কেন বানভাসি তিলোত্তমা?
Kolkata waterlogged: মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ভোরে ঘন্টায় ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এটিকে কোনোভাবেই মেঘভাঙা বৃষ্টি বলা চলে না।
কলেজে পড়ার সময় থেকেই দেখতাম একটু ভারী বৃষ্টি হলেই, বইপাড়া হাঁটু অবধি জলে ডুবে যেত, কিন্তু এক্সাইড মোড়, ভবানীপুর, বালিগঞ্জের রাস্তায় যে জলে নেমে খাবি খেতে হচ্ছে মানুষজনকে, সে দৃশ্য গত কয়েক দশকে দেখেননি তিলোত্তমাবাসীরা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে কার্যত স্তব্ধ মহানগরী; মেট্রো, ট্রেন, বাস, প্রায় সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থাই বিপর্যস্ত! আর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু মিছিল তো লেগেই আছে। রাজ্যজুড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় ৯ জনের। সোমবার গভীর রাত থেকে মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টায় কলকাতায় গড়ে প্রায় ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে; সবচেয়ে বেশি হয়েছে আদিগঙ্গা লাগোয়া গড়িয়া কামডহরি অঞ্চলে (চার ঘণ্টায় প্রায় ৩৩২ মিলিমিটার)। ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মঙ্গলবার ভোর ৩টে থেকে ৪টে পর্যন্ত এই ১ ঘণ্টায় প্রায় ৯৮ মিলিমিটার সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে! কিন্তু হঠাৎ এত ভারী বর্ষণের কারণ কী? নেপথ্যে কী রয়েছে মেঘভাঙা বৃষ্টি নাকি গভীর নিম্নচাপ?
ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের হিসাব অনুযায়ী, কোনো ছোট অঞ্চলে (সর্বাধিক দশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে) এক ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হলে, তাকে মেঘভাঙা বৃষ্টি বলে। আবহাওয়াবিদরা এটাকে ক্লাউডবার্স্টও বলে থাকেন। স্বল্প সময় স্থায়ী হলেও এর তীব্রতা এবং প্রভাব স্বাভাবিক অবস্থায় ভারী বা অতিভারী বৃষ্টির চাইতে অনেক বেশি, সেজন্য ক্ষয়ক্ষতি ও অনেক বেশি হয়।
আরও পড়ুন- দেবতারা কি নিজেদের বাঁচাতে পারেন না? বিপর্যয় কীভাবে বদলে দিচ্ছে পাহাড়ের ধর্মীয় বিশ্বাস?
মেঘ ভাঙা বৃষ্টি কেন হয়?
একটা ছোট্ট এলাকায় মেঘ হঠাৎ ঘনীভূত হওয়ার কারণে মেঘভাঙা বৃষ্টি দেখা দেয়। মূলত ঠান্ডা বায়ুর সংস্পর্শে উষ্ণ বায়ু এলে ঘন মেঘের সৃষ্টি হয়। আবার উত্তপ্ত বাতাস ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে থাকায় মেঘে পুঞ্জিভূত জলকণা বৃষ্টি হয়ে ঝরতে পারে না। উপরন্ত সেই জলকণাকে শুষে উত্তপ্ত বাতাস আরও ওপরে উঠতে থাকে। পার্বত্য এলাকার নিম্ন অংশ থেকে উচ্চ ভূখণ্ডের দিকে গরম বাতাসের উঠতে থাকার এই ঘটনাকে বলে ‘অরোগ্রাফিক লিফ্ট’। ফলে উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলের আপেক্ষিক আর্দ্রতাও ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং মেঘের জন্ম হয়। সেই মেঘের ঘনত্ব, একসময় বাড়তে বাড়তে ঘনীভবন সীমাস্থ মানে পৌঁছায়, তখন মেঘ আর জলরাশি ধরে রাখতে পারে না –তীব্র গতিতে বারিধারা নামতে থাকে, এমনকি মাঝে মধ্যে শিলা বৃষ্টি ও দেখতে পাওয়া যায়।
মেঘভাঙা বৃষ্টি মূলত পাহাড়ি অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়; সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩,৩০০ থেকে ৮,২০০ ফুট উচ্চতায় এই বৃষ্টি দেখতে পাওয়া যায়। কিউমুলোনিম্বাস মেঘের দরুণ এর সৃষ্টি। এত বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা একভাবে পড়তে থাকে যে সেগুলিকে আর আলাদা করা যায় না, মনে হয় অবিরত প্রবাহমান বারিধারা। কিন্তু পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ভোরে ঘন্টায় ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এটিকে কোনোভাবেই মেঘভাঙা বৃষ্টি বলা চলে না। বরং উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হওয়া প্রবল নিম্নচাপের দরুণ রাতভর এত বৃষ্টি। মূলত কিউমুলোনিম্বাস মেঘ এই বৃষ্টির জন্য দায়ী। এই মেঘকে দূর থেকে উলম্ব স্তম্ভ বা টাওয়ারের মতো দেখতে লাগে, এর জলীয় বাষ্প ধারণের ক্ষমতাও অন্যান্য মেঘের তুলনায় অনেক বেশি। বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প স্থলভাগে প্রবেশ করে, এর ফলেই বৃষ্টির তীব্রতা বাড়তে থাকে ক্রমশ।
আরও পড়ুন- সুনামির ‘ T’ কেন উচ্চারিত হয় না?
এই দিনের দুর্যোগ প্রবীণ শহরবাসীকে ৭৮ সালের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। সে বার ২৮ সেপ্টেম্বর মহানগরের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৭০ মিলিমিটার। শুধুই মহানগর নয়, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় জেলায় বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, প্রায় অর্ধশত মানুষের প্রাণ যায় সেবার; জায়গায়, জায়গায় কোমর সমান জল, পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে জনজীবন স্বাভাবিক হতে সপ্তাহ খানেকের বেশি সময় লাগে ।
এই বছর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আবহাওয়া যে খারাপ থাকবে, সে খবর হাওয়া অফিস আগেই জানিয়েছিল, কিন্তু পরিস্থিতি যে এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে, তা বোঝা যায়নি। আসলে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ তৈরি হতে খুবই কম সময় লাগে, মাত্র ১৫-৩০ মিনিটের মধ্যেই ছোটখাটো একটা মেঘের চাঁই বিরাট আকার ধারণ করে। ফলে এর পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন ব্যাপার। তবে নিম্নচাপের দিনক্ষণ, গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু তিলোত্তমা জলমগ্ন থাকার সবচেয়ে বড় কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ন, ও জল নিকাশি ব্যবস্থার বেহাল দশা; যেটুকু ব্যবস্থা আছে, তা মুখ থুবড়ে পড়ছে পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে। পাশেই হুগলী নদী, কিন্তু অনবরত পরিবেশ দূষণের ফলে পলি জমে জমে নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে। আবার গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে সমুদ্রের জলস্তর বাড়ছে ক্রমশ, তার প্রভাব এসে পড়ছে নদীগুলিতে। বহুদিন আগের গঙ্গার গতিপথ, যা আদিগঙ্গা নামে পরিচিত, এখন মেট্রো চলাচলের জন্য তার বুক চিরে বসানো হয়েছে বিরাট বিরাট পিলার, ফলে আদিগঙ্গার জলের প্রবাহ চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে। ফলস্বরূপ ভারী বৃষ্টির সময় দীর্ঘক্ষণ জলমগ্ন হয়ে থাকছে বাঁশদ্রোণী, গড়িয়ার কামডহরি , ব্রহ্মপুর, ইত্যাদি এলাকা। হাতে নাতে সে প্রমাণও পেয়েছি আমরা। এমনিতেই কলকাতার কালীঘাট, চেতলা, বালিগঞ্জ, মোমিনপুর, বেহালা বন্যাপ্রবণ। একটু বেশি বৃষ্টি হলেই জল জমে যায়।
তবে, আশার কথা এই যে ৭৮ সালের তুলনায় এবার পরিস্থিতি অনেক তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে আবারও বঙ্গোপসাগরে আরেকটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছে মৌসম ভবন, যা ওড়িশা-অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলে আঘাত হানতে পারে সপ্তাহ শেষে।

Whatsapp
