'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি! গত বছর ৫ অগাস্ট কী হয়েছিল বাংলাদেশে?

Bangladesh: কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা ৩৩ দিন রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করেন বাংলাদেশের ছাত্রজনতা। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১,৪০০।

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এই দিন সকাল থেকেই বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি শুরু হয়। অন্যদিকে, চলছিল সরকারের ঘোষিত কারফিউ। তবে কারফিউ-র তোয়াক্কা না করেই লক্ষ লক্ষ বিক্ষোভকারী রাজধানী ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল। শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন এই দিন। শেষ পর্যন্ত ৫ অগাস্ট দিনটি যা রূপ নিল, তার জন্য হাসিনা খুব একটা প্রস্তুত ছিলেন না বলেই মনে করেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ। কারণ জীবন বাঁচাতে শেখ হাসিনাকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। কী ঘটেছিল ৫ অগাস্ট? কেন পালাতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে?

২০২৪-এর মাঝামাঝি থেকেই বাংলাদেশের তৎকালীন হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে - তিস্তা প্রকল্প, কোটা বিরোধী আন্দোলন, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পেনশন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছিল। এরই মধ্যে কোটা সংস্কার নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় দিয়ে দিয়েছিল। এর পর থেকে টানা আন্দোলন ও অবরোধের মতো কর্মসূচি করে শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে লেগে পড়েছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা ৩৩ দিন রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করেন বাংলাদেশের ছাত্রজনতা। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্দোলনে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১,৪০০। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো আন্দোলনে এত কম সময়ে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

আরও পড়ুন- এক কথায় বীভৎস! কী রয়েছে বাংলাদেশের গুম সংক্রান্ত কমিশনের রিপোর্টে?

শেষে ৩ অগাস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা  ঢাকার কেন্দ্রীয় মিনার থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বলা হয়, ৫ অগাস্ট বাংলাদেশ জুড়ে বিক্ষোভ ও গণঅবস্থান করবেন তাঁরা। এবং পরদিন ৬ অগাস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি পালন করা হবে। কিন্তু হঠাৎই ৪ অগাস্ট বিকেলে সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ একটি বিবৃতি দিয়ে জানান 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ৫ অগাস্টই হবে। এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরই ৪ অগাস্ট সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ঢাকা-সহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করে হাসিনা সরকার।

২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট, বাংলাদেশে সকাল থেকেই থমথমে অবস্থা। ঢাকার মহাখালী, বনানী, গুলশান, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, রামপুরা-সহ ঢাকার প্রায় প্রতিটি রাস্তা  কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। রাস্তায় দলে দলে সেনাবাহিনী-সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেমেছিল। একদিকে যেমন, সেনাবাহিনী-সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ করছিল, অন্যদিকে কারফিউ আর কাঁটাতারের তোয়াক্কা না করেই ছাত্র জনতা এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে যাঁদের আগে থেকেই কারফিউ পাশ ছিল, তাঁদের কেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটকে দেয়।

সবচেয়ে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ঢাকার প্রবেশমুখগুলােতে। যেমন তার মধ্যে ছিল যাত্রাবাড়ী, গাবতলী, আর আব্দুল্লাহপুরের মতো এলাকা। বিভিন্ন গলির মুখেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া পাহারা ছিল। পুলিশ তরফে অনুরোধ করে মাইকিং করা হচ্ছিল কেউ যেন ঘর থেকে না বের হন। কিন্তু বেলা বাড়তেই দেখা যায় সম্পূর্ণ অন্য পরিস্থিতি। কারফিউ ভেঙে দলে দলে মানুষ রাস্তায় নামে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা  বিক্ষোভে যোগ দেন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হলে ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর বা ওএইচসিএইচআর- এর তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "'মার্চ অন ঢাকা' আটকাতে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালাচ্ছিল।"

সকাল ১০টা থেকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। জুলাই আন্দোলনের অন্যতম মূল কেন্দ্র ছিল ঢাকার উত্তরা। সকাল ১১টায় উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে অবস্থান নেন বিক্ষোভকারীরা। উত্তরা থেকে বিমানবন্দরে প্রধান রাস্তায় সেনাবাহিনীও কাঁটাতারের ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে ফেলে। ১১টা নাগাদ বিএনএস ভবনের পাশের গলি দিয়ে মূল রাস্তায় উঠে আসেন বিক্ষোভকারীরা। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁদের আটকাতে চায়। ছাত্র জনতা তার মধ্যেই মিছিল নিয়ে গণভবনের দিকে যাত্রা শুরু করেন। আশপাশের বিভিন্ন গলি দিয়ে দলে দলে বিক্ষোভকারীরা মূল রাস্তায় উঠতে শুরু করেন। সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে গণভবন অভিযান করেন তাঁরা। বিভিন্ন বয়সি নারী-পুরুষ সকলে একত্রে হয়ে লাঠি হাতে স্লোগান তুলেছিলেন 'দফা এক-দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ'।

আরও পড়ুন- মুজিবের বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ! ৭৬ বছরের সংগঠন কেন নিষিদ্ধ করল সরকার?

দুপুরের পর থেকেই খবর আসতে শুরু করে হাসিনা পদত্যাগ করে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছেন।
বিকেল ৩টে নাগাদ প্রথমে গণভবন, পরে তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব থেকে পিজিআর, এসএসএফসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সরে যান। এরপর দলে দলে মানুষ ভবনে প্রবেশ করতে শুরু করেন। গণভবনের ভেতরেই বিজয় মিছিল করতে দেখা যায়। অনেকেই আবার গণভবন ভাঙচুর করেন। চেয়ার-টেবিল,আসবাব, পশু-পাখি, খাবার আর ব্যবহার্য জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায় হাজার হাজার মানুষ। তিনটে নাগাদ তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পিজিআর-সহ সব বাহিনী কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যান। এরপর কার্যালয়ে ঢল নামে হাজারো সাধারণ মানুষের। কার্যালয়ের ছাদে পতাকা তুলে বিজয় উল্লাস করেন অনেকে।

৫ অগাস্ট ছাত্র, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক - সবাইকে একসঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা গিয়েছিল। হাসিনা বাংলাদেশ ছাড়ার পর রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় রং ছিটিয়ে, শ্লোগান দিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়। উত্তেজিত জনতা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কার্যালয়ে এবং থানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। ভাঙচুর করা হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর। সে দিন বিক্ষুব্ধ জনতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল একটি প্রতিকৃতিও ভেঙ্গে ফেলেন।

উল্লেখ্য, ৫ অগাস্ট বেলা বারোটার পর ঢাকা থেকে দিল্লিতে পরপর দুটো ফোন এসেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর নিজেই পরে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে সে কথা জানিয়েছিলেন। প্রথম ফোনটা এসেছিল খোদ শেখ হাসিনার কার্যালয় থেকে। ওয়াকিবহাল দাবি করে, এই দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই কথা বলেছিলেন। যদিও জয়শংকর-কে কে ফোন করেছিলেন সেই নিয়ে কিছু বলেননি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রোটোকল অনুযায়ী সাধারণত এই ধরনের পরিস্থিতিতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেই কথা হয়। দ্বিতীয় ফোনটি বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর কাছ থেকে দিল্লিতে ভারতের এয়ারফোর্স কমান্ডের কাছে আসে।

প্রসঙ্গত, ভারত সরকার হাসিনার এ দেশে থাকা নিয়ে সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখেছে। সম্প্রতি শেখ হাসিনার বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার অডিও ফাঁস হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে নিয়ে ভারত নিজেদের অবস্থান বদলায়নি।

More Articles