ধোঁয়ার জেরে জাঁকিয়ে বসছে অবসাদ! চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আনলেন বিজ্ঞানীরা
Mental Health issue due to Pollution: যত দিন যাচ্ছে, দূষণে জেরবার হচ্ছে নগর থেকে মফস্বল। তবে কেবল ফুসফুস নয়, মস্তিস্কেও প্রভাব ফেলছে বায়ুদূষণ...
“একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।”
কবি শঙ্খ ঘোষের লেখা এই জনপ্রিয় লাইনটি প্রায়শই মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। উন্নয়ন, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞাপনের পৃথিবীতে হোর্ডিংয়ের ভিড়ে সত্যিই চলা দায়। তবে ২০২২-এ দাঁড়িয়ে এই কথাটি একটু পরিবর্তন করাই যায়। কেবল বিজ্ঞাপন নয়, মুখ ঢেকে যায় ধোঁয়ায়। মুখ ঢেকে যায় দূষণে…
বিগত কয়েক বছরে খবরের পাতায় বারবার ভারতের পরিবেশ দূষণের ইস্যু সামনে এসেছে। গোটা পৃথিবীতেই বায়ুদূষণ, জলদূষণ, বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো দৈত্য মারণ থাবা বসিয়েছে। অথচ মানব সভ্যতার খেয়াল নেই খুব একটা। তারই ফলস্বরূপ ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে নগর, মফস্বল। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে বারবার শিরোনামে আসে দেশের রাজধানী নয়াদিল্লি। মুখের ওপর মুখোশ (পড়ুন মাস্ক) ছাড়া গতি নেই। কলকাতা সহ অন্যান্য শহরগুলিও পিছিয়ে নেই। বিষাক্ত রাসায়নিক ও গ্যাস মিশ্রিত এই ধোঁয়া আমাদের শ্বাসযন্ত্রকে একেবারে নষ্ট করে দিচ্ছে। আজ থেকে নয়, বহু বছর ধরেই বিজ্ঞানীরা এই কথা বলে আসছে। তবুও থোড় বড়ি খাড়া!
তবে কেবল শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের বেহাল দশাই নয়, বায়ুদূষণ সরাসরি প্রভাব ফেলে মাথায়। এই জায়গায় আসার আগে একটু চারপাশটায় তাকিয়ে দেখা ভালো। করোনা পরবর্তী সময় বাড়ি বসে কাজ, নিউ নর্মাল সহ একাধিক জিনিস আমাদের জীবনে এসেছে। সেইসঙ্গে এসেছে অবসাদ, মানসিক উৎকণ্ঠা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-এর রিপোর্ট বলছে, বিগত কয়েক বছরে মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত খারাপ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা দিনদিন বাড়ছে। সেই রিপোর্টই বলছে, ২০১৭ সাল থেকে হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে, মানসিক অবসাদ ও রোগ অন্তত ১৩ শতাংশ বেড়েছে। গবেষকরা বলছেন, মানুষের জীবন প্রণালী, জীবনযাত্রা ইত্যাদি নানা রকম বিষয়ের বাইরেও আরও একটা জিনিস সত্য। পরিবেশ দূষণ, বিশেষ করে বায়ুদূষণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে।
আরও পড়ুন : একাদশ শ্রেণিতে ক্যান্সার, ফুসফুসে ১৯ সেমির টিউমার! ঐন্দ্রিলা আসলে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা!
সম্প্রতি ‘নিউরোটক্সিকোলজি’ নামক একটি জার্নালে এমনই রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন একদল বিজ্ঞানী। তাঁদের দাবি, যে সমস্ত জায়গার বাতাস অত্যাধিক দূষিত, সেখানে বসবাসকারী মানুষদের মস্তিস্কে বেশকিছু পরিবর্তন হয়। মূলত বাতাসের ক্ষতিকারক গ্যাস, রাসায়নিকের কারণে নিউরোট্রান্সমিটারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, মস্তিস্কের যে অংশ মানুষের আবেগ, উত্তেজনা, মনের ভাব নিয়ন্ত্রণ করে, সেই অংশটিতেও প্রভাব পড়ে।
এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য বিজ্ঞানীরা বিস্তর গবেষণাও করেন। অন্তত ১০০টি গবেষণার সাহায্য নেন তাঁরা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন সেই রিপোর্ট। কেবল মানুষ নয়, অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও বায়ুদূষণ কীভাবে প্রভাব বিস্তার করছে, সেটাই ছিল পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য। সেখানেই আসে চমকপ্রদ তথ্য। গবেষণায় দেখা যায়, ৭৩ শতাংশ কেসে বায়ুদূষণের প্রভাব সাংঘাতিক। মানুষ এবং প্রাণীদের (যেমন, ইঁদুর) দূষিত বাতাসের মধ্যে ছেড়ে দিলে তাদের মস্তিস্কে বিভিন্ন পরিবর্তন হতে থাকে। মূলত হিপ্পোক্যাম্পাস, অ্যামিগডালা এবং প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের ওপরই নজর দেন বিজ্ঞানীরা। দেখেন, দূষিত বাতাসে দীর্ঘদিন থাকলে মানসিক স্বাস্থ্য ও আচার-আচরণে পরিবর্তন আসে। পাশাপাশি, ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্য, আবেগ ইত্যাদির সঙ্গে শারীরিক বিভিন্ন পরিবর্তনও হচ্ছে।
কিন্তু এমন রিপোর্ট নিয়ে আশঙ্কার কারণ কী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, বেঁচে থাকার জন্য বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বাতাসেই লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রাণীরা শ্বাস নিচ্ছে। অভিযোজন ঘটছে, সভ্যতা এগোচ্ছে। বিগত কয়েক দশক ধরে দূষণ পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। মেরু প্রদেশের বরফ গলছে, উন্মুক্ত হচ্ছে সেখানকার মানুষ। জঙ্গল পুড়ছে, জীবজন্তু তাদের বাসস্থান হারাচ্ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে নগর সভ্যতা, বাড়ছে কারখানা, গাড়ি, ধোঁয়া। যত দিন যাচ্ছে, আমাদের চারপাশের বাতাসও দূষিত হয়ে পড়ছে। কীরকম? বিগত কয়েক বছর খবরের দিকে চোখ বোলালেই নয়াদিল্লির নাম উঠে আসবে। রাজনীতি, খেলা, প্রশাসন ইত্যাদির পাশাপ্সহি আরও একটি মূল ইস্যু হল পরিবেশ। কেবল দেশ নয়, গোটা পৃথিবীর অন্যতম দূষিত শহর হিসেবে নিজের ‘জায়গা’ কায়েম করেছে রাজধানী শহর। চলতি ডিসেম্বরেও এখানকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ছাড়িয়েছে ৩৬০-এর ঘর। ভারতের অন্যান্য শহরও পিছিয়ে নেই। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের র্যা ঙ্কিংয়ে তাকালে দেখা যাবে, প্রথমদিকের বেশ অনেকগুলো জায়গাই ভারতের ছোট-বড় বিভিন্ন শহর দখল করে রেখেছে।
আরও পড়ুন : কষ্ট ভুলতে গিয়ে আরও অবসাদ! ডিপ্রেশনের রোগী করে তুলতে পারে মদই?
এর মধ্যেই বসবাস করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। পড়াশোনা, কাজের জন্য প্রতিদিন বাইরে বেরোতে হচ্ছে। এদিকে ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের বইয়ে পড়ানো হয় যে, বায়ুদূষণের ফলে শ্বাসকষ্ট হয়। ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু বছর ধরে এটাই আমাদের ধারণা। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণাগুলির খবর বিজ্ঞানের পাতা এড়িয়ে যায়। গবেষকরা শিশুদের ক্ষেত্রেও এই দূষণের প্রভাব বিশদে পর্যালোচনা করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, একদম শিশু বয়সে মানুষের মস্তিস্কে বায়ুদূষণের প্রভাব বেশি পড়ে। বেড়ে ওঠার সময় মানুষের মস্তিস্কেরও বিকাশ হতে থাকে। তখন ক্ষতিকারক রাসায়নিক সেখানে প্রভাব ফেলে। তবে কেবল মানুষ নয়, প্রাণীরাও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষকরা বলছেন, অনেক সময় মস্তিস্কের আকার আকৃতিরও পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে এই দূষণের প্রভাব পড়ে শরীরের অন্যান্য অংশেও।
যত দিন যাচ্ছে, দূষণ সমস্ত দিক থেকে সভ্যতাকে কবজা করে ফেলছে মারাত্মকভাবে। সেইসঙ্গে নেমে আসছে অবসাদ। মস্তিস্কের আবেগের অংশে আঘাত এলে, নিউরো ট্রান্সমিটার তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হারালে, অল্প বয়স থেকেই মানুষ মানসিক রোগের কুয়োয় পড়ে যায়। ডাক্তাররা এই জায়গা থেকে বারবার সতর্ক করছেন। অবসাদ, দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা, অন্যান্য জটিল মানসিক রোগগুলিকে অবহেলা নয়, গুরুত্ব দিন সবার আগে। পৃথিবীজুড়ে এই একটিই বীজমন্ত্র বারংবার আউড়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক থেকে গবেষক।