ব্লাড ক্যান্সার| কেমো থেকে পিল, চিকিৎসায় নিঃশব্দ বিপ্লব
Blood cancer treatment: ডায়াবেটিসের চেয়েও সহজে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এটা কোনো উচ্চবাচ্য না। একদা মারণব্যাধি ছিল, এমন রোগ, আজ নিয়ন্ত্রিত এবং ‘ক্রনিক’– অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি রোগে পরিণত হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সৃজা। ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। CML- Chronic Myeloid Leukaemia। লিউকেমিয়া! পরিবারের মাথায় হাত, এই ছোট্ট বয়সে মেয়ে কীভাবে সামলাবে? চিকিৎসার অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করার মতো মনের জোর কি বাচ্চা মেয়েটার আছে? অঙ্কোলজিস্টের কাছে গিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, মাত্র একটি ওষুধের দ্বারা সৃজার রোগ নিয়ন্ত্রণে আসবে। বছরের পর বছর কেমোথেরাপি, আইভি ড্রিপ, হাসপাতালের বিছানায় ক্লান্তিকর রাত কাটানোর প্রয়োজন পড়বে না (এটি একটি কাল্পনিক ঘটনা)। চিকিৎসাবিজ্ঞান নীরবে ও নিরলসভাবে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেছে। বর্তমানে কিছু রক্তের ক্যান্সার ওটি ক্লিনিকেই চিকিৎসা হয়, হাসপাতালে রাত কাটানোর প্রয়োজন পড়ে না, আইভি ড্রিপের এমনকি ইনজেকশনেরও প্রয়োজন নেই। রোগী ডাক্তারখানায় পৌঁছান, ওষুধ হাতে নেন, বাড়ি ফিরে আসেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিসের চেয়েও সহজে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এটা কোনো উচ্চবাচ্য না। একদা মারণব্যাধি ছিল, এমন রোগ, আজ নিয়ন্ত্রিত এবং ‘ক্রনিক’– অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি রোগে পরিণত হয়েছে। Chronic Myeloid Leukaemia (CML) এবং Chronic Lymphocytic Leukaemia (CLL), এই দুই ব্লাড ক্যান্সার ধীরগতিতে বৃদ্ধি পায় এবং নতুন এই চিকিৎসার সাহায্যে দ্রুত এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। BCR ও ABL নামে দুটি জিন মিশে গেলে CML নামক জেনেটিক ত্রুটির শুরু হয়। তারপর বোনম্যারোর কোষ বৃদ্ধি পেতেই থাকে। কয়েক দশক আগেই এই রোগ এক মারণব্যাধি ছিল। চিকিৎসা ছিল কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি অথবা ঝুঁকিপূর্ণ বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট। এমনকি তারপরও বেঁচে থাকা ছিল অনিশ্চিত।
অঙ্কোলজিস্ট ড. নটরাজ কে এস বলছেন, “আজকের দিনে এই রোগগুলিতে হাসপাতালের প্রয়োজনই পড়ে না অনেক সময়। আগে এই রোগে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে হতো, কিন্তু এখন সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। আধুনিক চিকিৎসায় প্রায় ৯০% রোগীই সুস্থ হয়ে ওঠেন। আগে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি বা ট্রান্সপ্ল্যান্টের পরও আক্রান্তদের ৪০%ও সেরে উঠতে পারতেন না। কিন্তু এখন বেশিরভাগ আক্রান্তকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা ডায়াবেটিসের থেকেও সহজ হয়ে উঠেছে। আর শুধু একটি মাত্র ওষুধের দৌলতেই এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।”
আরও পড়ুন - বয়স কম কিন্তু ভয় বেশি, কেন তরুণীদের মধ্যে বাড়ছে স্তন ক্যান্সার?
হাসপাতালের বিছানার বদলে নিজের বাড়ির সোফায় বসে ট্যাবলেটের বাক্স হাতে নিয়ে CML-এর রোগীরা প্রতিদিন ট্যাবলেট খান– আইভি ড্রিপ নিতে হয় না। অনেক রোগী ‘ডিপ রেমিশন’-এ চলে যান অর্থাৎ ক্যান্সার পরীক্ষা করালেও ধরা পড়ে না। নিয়মিত টেস্ট, ডাক্তারের পরামর্শ– এভাবেই চলতে থকে রোজকার জীবন। অন্যদিকে CLL-এ ততদিন চিকিৎসার দরকার পড়ে না, যতদিন না রোগের বাড়বাড়ন্ত স্পষ্ট হয়। ধরা পড়ার পর ডাক্তাররা নজরে রাখেন এবং টেস্ট করাতে বলেন। তারপর, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওষুধেই নিয়ন্ত্রণে আসে এই রোগ।
সত্যিই কি ডায়াবেটিসের থেকে সহজ উপায়ে এর চিকিৎসা সম্ভব?
ডায়াবেটিস রোগী যেমন নিয়মিত সুগার টেস্ট করান, ডায়েট মেনে চলেন, ওষুধ খান, ডাক্তারের কাছে যান। তেমনই CML-এর রোগী নির্দিষ্ট ডোজের ওষুধ খেয়ে রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। ডায়াবেটিস ক্রমাগত ওঠানামা করায়, নিয়ন্ত্রণে রাখা তুলনামূলক কঠিন। কিন্তু CML-এর মাত্রা এবং সেই অনুযায়ী ওষুধের ডোজ জেনে গেলে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সহজেই। নিয়মমাফিক সঠিক ডোজের ওষুধ খেয়ে যেতে হবে ডাক্তারের পরামর্শ মতো। তা না হলে রোগ ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কিছুদিন পর পর রক্ত পরীক্ষা করানোও জরুরি। অনেক রোগী “ডিপ মলিকিউলার রেমিশন”-এ পৌঁছান, যেখানে ক্যান্সার পরীক্ষা করালেও ধরা পড়ে না। যদিও সকলে সেই স্টেজে পৌঁছান না। কিন্তু ওষুধের দ্বারা এই রোগ দীর্ঘমেয়াদে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
আরও পড়ুন - ট্যাটু করালে সত্যিই ক্যান্সার হতে পারে? যা বলছে নতুন গবেষণা
নতুন এই চিকিৎসা ব্যবস্থা ভারতে গৃহীত হচ্ছে, তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। CML, CLL-এর এই ওষুধগুলির দাম ব্র্যান্ড ও ডোজ ভেদে মাসে ৩,০০০ থেকে ১,০০,০০০ টাকা। সরকারি হাসপাতাল, বিভিন্ন ট্রাস্ট থেকে সাহায্য করা হলেও ছোট শহরগুলিতে ওষুধ ও নিয়মিত টেস্টের ব্যাবস্থাপনার অভাব দেখা যায়। তাই, লক্ষ্য হল জেলাস্তরের হাসপাতাল ও ক্যান্সার ক্লিনিকে এই ধরণের রোগে নতুন টেস্ট, কাউন্সেলিং, নিয়মিত ফলোআপের ব্যবস্থা করা।
অঙ্কোলজিস্টরা যখন বলেন, “এই ক্যান্সার ডায়াবেটিসের চেয়ে সহজ!”–তখন তাঁরা রোগের মারাত্মক দিককে একটুও ছোট করেন না, বরং একটা বড় জয় উদযাপন করেন। একসময় যা মারণব্যাধি ছিল, সেই রোগকে এখন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়– এটাই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আসল সার্থকতা।

Whatsapp
