মদের চেয়েও ক্ষতিকর রিলস! নেশায় বুঁদ ‘জেন-জি’র কমছে ধৈর্য, বাড়ছে অবসাদ

Reels Addiction: অতিরিক্ত রিলস দেখার প্রবণতা মস্তিষ্কে ডোপামিন ও সেরোটোনিনের ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটায়। ফল, অমনোযোগী, ঘুমে সমস্যা, মানসিক অবসাদ, শর্ট টার্ম মেমোরি লস বা স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিশক্তি হ্রাস।

‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন রিলস দেখে চলি’— ইদানিং এটাই যেন জেন-জি’র বেদবাক্য। রিলসে বিভোর একটা গোটা তরুণ প্রজন্মই এখন এই মায়াজালে আবদ্ধ— ‘রিলস’। উঠতে-বসতে, খেতে, শুতে এমনকি কাজের ফাঁকেও রিলস স্ক্রল এখন শ্বাস-প্রশ্বাসের আনুষঙ্গিক একটা বিষয়। ওটা ছাড়া বাঁচা যায় না। চিকিৎসকদের দাবি, আর পাঁচটা নেশার সঙ্গে এর তুলনা চলে অনায়াসেই।

আপাতদৃষ্টিতে রিলস বিনোদনের অঙ্গ, তবে রিলস-সাগরে সর্বক্ষণ ডুব দেওয়ার অভ্যেসকে অনেকেই শুধু ‘সময়ের অপচয়’ বলেই এড়িয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টা কি আদতে এটুকুই! স্নায়ুবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন সমীক্ষা কিন্তু অন্য কথা বলছে। তাঁদের বক্তব্য, মদ-জুয়া কিংবা ড্রাগস, ‘রিলসে আসক্তি’ এদের চাইতে কম ক্ষতিকর কিছু নয়। নিউরোইমেজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ‘পির রিভিউড স্টাডি’(peer-reviewed study)-র, সমীক্ষা বলছে, যে কোনো ধরণের মাদকাসক্তি কিংবা জুয়া জাতীয় যেকোনো খেলাই আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন ও সেরোটোনিন নামক দুটি রাসায়নিক তরলের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়, যা আমাদের তাৎক্ষণিক আনন্দের অনুভূতি প্রদান করে, মাথায় চলতে থাকা চাপা উদ্বেগগুলি কমিয়ে দেয়। ঠিক একই ঘটনা ঘটে রিলস দেখার সময়ও।

এ প্রসঙ্গে হয়ত অনেকেই হৈহৈ-রৈরৈ করে তেড়ে এসে বলতে পারেন, ‘যে রিলস তো আর মাদক নয় কিংবা রিলসে যদি ক্লান্তি ঘোচে তাতে ক্ষতি কী! সময় বাদে শরীরের ক্ষতি তো নেই।’— ক্ষতি আছে। অতিরিক্ত রিলস দেখার প্রবণতা মস্তিষ্কে ডোপামিন ও সেরোটোনিনের ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটায়। ফল, অমনোযোগী, ঘুমে সমস্যা, মানসিক অবসাদ, শর্ট টার্ম মেমোরি লস বা স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিশক্তি হ্রাস।

আরও পড়ুন- রিলস দেখছেন সারাক্ষণ! ইনস্টাগ্রাম রিলসের ভয়াবহ দিক জেনে আঁতকে উঠছে বিশ্ব

কী ঘটে আসলে?

ধরুন, আপনি এমন কোনো কাজ করলেন যেটা করে আপনার ভালো লাগছে। যেকোনো কাজ- কারোর একটা সিনেমা দেখে মন ভালো হয়, কেউ আবার তাঁর পছন্দের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। কেউ গেম খেলেন আবার কেউ কেউ সিগারেটে সুখটান দিয়ে কিংবা অ্যালকোহলেই জীবনের উদ্বেগ ভোলাতে ব্যস্ত। এই সমস্ত ক্ষেত্রেই আপনার ভালো অনুভূতি হয় কারণ, সেসময় আপনার মস্তিষ্ক ডোপামিন ও সেরোটোনিন নিঃসরণ করে। এর মধ্যে ডোপামিন মুখ্য, যা আপনার আনন্দ অনুভূত হওয়ার অন্যতম কারণ। এখানে ডোপামিনের ভূমিকা একটি নিউরো ট্রান্সমিটারের মতো, যা আপনাকে বোঝায় ‘আপনার ভালো লাগছে’।

আর একটু সহজ করে বলি, ধরুন, আপনি একটা গেম খেলছেন এবং সেই গেমটায় আপনি জিতলেন। এতে আপনার মস্তিষ্ক একটা রিওয়ার্ড পেল। ডোপামিন নিঃসরণ হলো, আপনি খুশি হলেন। এক্ষেত্রে আপনি যদি হেরে যেতেন তাহলে ডোপামিন নিঃসরণ হতো না কিংবা, কম হতো অর্থাৎ এই ডোপামিনই যদি মাত্রাতিরিক্ত কিংবা কম নিঃসরণ হয় তাহলে তা আপনাকে হতাশা দেবে। মোদ্দাকথা, মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ না খুব বেশি ভালো না খুব কম। একটা ভারসাম্য জরুরি।

রিলসে বুঁদ জেন-জি


কখন সেটা আসক্তিতে পরিণত হয় ?

একই কথা, আপনি কোনো কাজ করলেন এবং দেখলেন সেই নির্দিষ্ট কাজটা করে আপনার ভালো লাগছে। ধরুন, আপনি গেমটা খেললেন এবং তাতে বহুবার জিতলেন। আপনার ভালো লাগছে। এবার আপনার অবচেতন মন আপনাকে বোঝালো এই কাজটাতে আপনি ‘খুশি’। অপনার মস্তিষ্ক বারবার রিওয়ার্ড পাচ্ছে , সঙ্গে ডোপামিন নিঃসরণও বাড়ছে। এই প্রক্রিয়াটিকে বলে 'ইউফোরিয়া'। এবার, ঠিক যে মুহূর্তে আপনার মস্তিষ্ক রিওয়ার্ডে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে, সেই মুহূর্তে ক্রমাগত ডোপামিন নিঃসরণে মস্তিষ্ককে কাজে লাগাচ্ছে। যত বেশি ডোপামিন তত বেশি নিউরো সংযুক্তি, ফল আপনার মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ ‘হাইজ্যাক’। এখানে হাইজ্যাক অর্থ, ওই একই আনন্দ উপলব্ধির জন্য আপনার মধ্যে তৈরি হওয়া তীব্র লালসা। কেউ গেম খেললে বারবার গেম খেলবেন, কেউ রিলস দেখলে বারবার রিলস দেখবেন আবার কারোর মদে স্ট্রেস কমলে, উদ্বেগ কমাতে তিনি বারবার মদেই ঝুঁকবেন। অর্থাৎ, আসক্তি বাড়বে।

কেন রিলসে ঝোঁক বেশি?

রিলস ছোট, ৩০-৬০ সেকেন্ড। চিত্তবিনোদক ,মনোগ্রাহী, আকর্ষক। ‘ইনফোটেইনমেন্টের’ ডিপো। রোজনামচা জীবনে মানুষের ব্যস্ততা প্রচুর, ধৈর্য কম। তাই বড় কিছুর চেয়ে ছোট ক্লিপিং বেশি গ্রহণীয়। কম সময়ে বেশি বিনোদন। আলাদা-আলাদা, ফলে একঘেঁয়েমিতাও কম— প্রভূত কারণে সব সামাজিক মাধ্যমেই রিলসের দৌরাত্ম্য এখন বড় ভিডিওকে ছাপিয়েছে। আসক্ত হচ্ছে আট থেকে আশি সকলেই। তবে, জেন-জির জন্য বিষয়টা বেশি চিন্তার। কারণ- এই প্রজন্মের রিলসে বিচরণ বেশি। মোবাইল তাঁদের শরীরের প্রায় একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দিবারাত্র তাদের এই আসক্তিই চিন্তার ভাঁজ ফেলছে স্নায়ুবিজ্ঞানীদের কপালে। তাঁদের বক্তব্য স্পষ্ট, অতিরিক্ত রিলস স্ক্রলিং আমাদের মস্তিষ্ককের দুটি পর্যায়ে ক্ষতি করে।

 আরও পড়ুন- রিলস দেখছেন সারাক্ষণ! ইনস্টাগ্রাম রিলসের ভয়াবহ দিক জেনে আঁতকে উঠছে বিশ্ব

এক, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স। এটি মস্তিষ্কের সামনের অংশ, যা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা, স্ব-নিয়ন্ত্রণ এবং মনোযোগ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ২৫-২৭ বছরের মধ্যে একজন মানুষের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সম্পূর্ণ পরিণত হয়। স্নায়ুবিজ্ঞানীদের মতে, এই বয়সে অতিরিক্ত রিলস স্ক্রলিং প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের সার্বিক উন্নতিতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে একাধিক বিষয়, একটার সঙ্গে আরেকটার যোগ আছে আবার নেইও— সমস্ত বার্তা বুঝে একটা সিদ্ধান্তে আসতে মস্তিষ্ককে বাড়তি চাপ দিতে হচ্ছে। সংকুচিত হচ্ছে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স। ফলে, খিটখিটে মেজাজ, ধৈর্যহীনতা, অমনোযোগী এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বাড়তি সময়, একের পর এক লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে ব্যবহারে।

দুই, হিপ্পোক্যাম্পাস, মস্তিষ্কের অন্যতম গুরুপূর্ণ একটি অংশ। যা সরাসরি আমাদের স্মৃতিশক্তির সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ, আমরা যা কিছু মনে রাখি , যা কিছু আমাদের স্মৃতিতে বর্তমান, তা সচল রাখে মস্তিষ্কের এই অংশটি। এমনকি, ‘ফাস্ট লার্নিং’-এর বিষয়টিও দেখে এই হিপ্পোক্যাম্পাস। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিরিক্ত রিলস দেখা বিশেষত রাতে ঘুমোনোর আগে, মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসের কার্যক্ষমতাকে কম করে। যার ফলে, স্মৃতিশক্তি হ্রাস— স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদী উভয়ই হতে পারে। অমনোযোগী, চঞ্চলতা বেড়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। তাহলে, কতটা সময় নিরাপদ? চিকিৎসক এবং স্নায়ুবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ‘কতটা সময় নিরাপদ তার সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড এখনও নেই।’ তবে আপাতত সংঘটিত প্রায় সবকটা গবেষণারই সারমর্ম, দিনে ২-৩ ঘণ্টার বেশি মোবাইল আসক্তিই মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকারক।

তবে, যাঁরা ইতিমধ্যেই এই আসক্তির শিকার তাঁরা কী করবেন? আদতে আর পাঁচটা আসক্তির ক্ষেত্রে যে যে উপদেশ খাটে, এর ক্ষেত্রেও তা-ই প্রযোজ্য। যেমন, একদিনে হবে না, ধীরে ধীরে স্ক্রিন টাইম কমিয়ে আনা ইত্যাদি। তবে যে বিষয়টিতে বিজ্ঞানীরা বেশি জোর দিয়েছেন তা হলো, যখন বুঝতে পারবেন যে আসক্তি তৈরি হচ্ছে তখন তার সঙ্গে আপনার ব্রেইনের যে সূক্ষ্ম ‘কানেকশন ব্রিজ’ বা সংযোগ তৈরি হবে সেটাকে ব্রেক করা বা ভেঙে দেওয়াটা আবশ্যক। সেটা ভাঙতে কী করবেন? একটা কাজে আবদ্ধ না থেকে আলদা আলাদা কাজ করুন। একটা প্রচলিত কথা আছে "যে কোনো কিছুই ‘অতিরিক্ত’ ভালো না।" ধরুন, আপনি সারাদিন খুব রিলস দেখেন, একবার ইনস্টাগ্রাম, একবার ফেসবুক, একবার ইউটিউবে। আপনি যখন বুঝতে পারবেন, এটার প্রতি আপনার আসক্তি বাড়ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আপনাকে আপনার ব্রেইনের সঙ্গে এই আসক্তির যে সংযোগ তৈরি হচ্ছে সেটা ভাঙতে হবে। এক্ষেত্রে আপনি বই পড়তে পারেন, অবশ্যই যেটা আপনার পছন্দের। ছবি আঁকতে পারেন, সিনেমা দেখতে পারেন অথবা অন্য যা কিছু করতে পারেন। অর্থাৎ ওই একই কাজ করা থেকে সেই মুহূর্তে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।

More Articles