গরিব হয়ে পড়ার ভয়, এই অসুখে আক্রান্ত কি আপনিও?

ক্রমবর্ধমান দারিদ্র এই মুহূর্তে তামাম দুনিয়ার সমস্যা। আর এই দারিদ্রই জন্ম দিচ্ছে ভয়ের, যা অসুখে রূপান্তরিত হচ্ছে। হঠাৎ দরিদ্র হয়ে পড়ার ভয় পরিভাষায় 'অ্যাপোরোফোবিয়া' নামে পরিচিত। ভ্যালেন্সিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের 'এথিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল ফিলোসফি'-র অধ্যাপক অ্যাডেলা কর্টিনা ১৯৯০ সালে দরিদ্র হয়ে যাওয়ার ভয় এবং দরিদ্র মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণাকে 'অ্যাপোরোফোবিয়া' নামে চিহ্নিত করেছেন।

আদিম মানুষ প্রকৃতিকে ভয় পেত। কিন্তু সেই ভয় কাটিয়ে মানুষ সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এতদসত্ত্বেও আধুনিক পৃথিবীর মানুষ কিছু ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ৬ রকমের ভয় পৃথিবীজুড়েই বিদ্যমান। এই তালিকায় রয়েছে দরিদ্র হয়ে পড়ার ভয়। সেই সঙ্গেই জড়িয়ে দরিদ্র মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণার মনোভাব। বিত্তবানরা অনেক সময়েই এর শিকার। এছাড়া মানুষের আরও পাঁচ কিসিমের ভয় রয়েছে। যেমন, সমালোচনার মুখে পড়ার ভয়, স্বাস্থ্যহানির ভয়, ভালবাসা হারানোর ভয়, বৃদ্ধ বয়সে জীবন কোন খাতে বইবে সেই ভয় এবং মৃত্যুভয়।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ৬ ধরনের ভয়ের কারণ অমূলক। কারণ এই ৬ ধরনের ভয়ই ভবিষ্যতে বিপর্যয়ের ছবির কল্পনামিশ্রিত। পরে কী ঘটবে, ভয়ের উৎস সেখানেই। 

আরও পড়ুন: হু হু করে বাড়ছে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা, অবসরের পরেও চাই কাজ

'অ্যাপোরোফোবিয়া'-ও সেরকমই এক ভয়। যাঁরা 'অ্যাপোরোফোবিয়া'-য় ভোগেন, দরিদ্র মানুষকে তাঁরা সহ্য করতে পারেন না। এই কারণে অনেক সময়েই তাঁদের ঘৃণার পাত্র হন দরিদ্র, গৃহহীন মানুষজন। কিন্তু সমীক্ষা বলছে, যাঁরা 'অ্যাপোরোফোবিয়া'-য় ভোগেন, তাঁদের ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়। জীবনে ধনী হওয়ার সম্ভাবনাও হ্রাস পায়। 'থিঙ্ক অ্যান্ড গ্রো রিচ' শীর্ষক বইয়ের লেখক নেপোলিয়ন হিল লিখেছেন, 'অ্যাপোরোফোবিয়া'-য় আক্রান্তরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধনী হতে পারেন না। একদিকে ওঁরা হদ্দ দরিদ্র হয়ে পড়ার ভয়টা মন থেকে সরাতে পারেন না, অন্যদিকে হদ্দ গরিব মানুষের জীবনকে ঘৃণা করে স্বখাতসলিলে ডুবে মরার মতো মানসিক সমস্যায় ভোগেন। 

ভয়টা কাটাতে হলে কী করতে হবে, সেই প্রসঙ্গেও লিখেছেন নেপোলিয়ন হিল। তিনি লিখেছেন, শত্রুকে জয় করতে হলে যেমন শত্রুর খুঁটিনাটি জানা প্রয়োজন, মন থেকে অ্যাপোরোফোবিয়া-জনিত ভয় কাটাতে হলে ভয়টাকে আগে বিচার করতে হবে। মানুষের জীবনের সাফল্যের মাপকাঠি যে শুধুমাত্র টাকাপয়সা নয়, এও উপলব্ধি করতে হবে।

'অ্যাপোরোফোবিয়া'-র মতো আরেকটি ভয় 'পেনিয়াফোবিয়া'। পেনিয়াফোবিয়ায় ভোগেন যে সমস্ত মানুষ, তাঁরা হামেশাই ভয় পান দরিদ্র হয়ে পড়ব কি? ভয়ের কারণে তাঁরা বিরক্ত বোধ করেন বর্তমান জীবন সম্পর্কে।

কথায় বলে, 'অর্থই অনর্থের মূল'। 'অ্যাপোরোফোবিয়া' কিংবা 'পেনিয়াফোবিয়া'-য় মানুষ আক্রান্ত হয় টাকাপয়সা থেকে উদ্ভূত ভয়ের ফলে। অনেকসময়েই তা প্যানিক অ্যাটাকের চেহারা নেয় উদ্বেগ মাত্রাছাড়া হওয়ার কারণে।

'হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান' কাব্যের লাইন হিসেবে কালজয়ী। কিন্তু বাস্তবে নয়। কেন মানুষ দরিদ্র হয়, এসম্পর্কে গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক কারণে যে কোনও সমাজে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাধিক্য ঘটে।

দারিদ্র দু'রকমের। একধরনের দারিদ্র হল চূড়ান্ত দারিদ্র, যখন মানুষ নিজের অথবা পরিবারের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের সংস্থান করতে ব্যর্থ হয়। দারিদ্রের আরেক ধরনের চেহারা আছে। অন্যের সঙ্গে নিজের আর্থিক অবস্থার আপেক্ষিক বিচারে তার পরিমাপ হয়। কেউ যখন অন্যদের তুলনায় জীবনযাপনের ন্যূনতম মান বজায় রাখতে পারেন না, তিনিও দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত হন।

দরিদ্র মানুষ কিংবা দারিদ্রকে ভয় পেয়ে আখেরে কোনও লাভ নেই। বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষই দরিদ্র। এর মধ্যে আবার ১০ শতাংশ মানুষ ভয়াবহ দারিদ্রের শিকার। এঁদের দৈনিক আয় ১.৯০ ডলারের কম।

বিশ্ব ব্যাঙ্ক এও জানিয়েছে, বিশ্বের যে দেশগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহ অথবা সামাজিক অশান্তি চলছে, সেখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তুলনায় অনেক বেশি। এই ধরনের দেশগুলোতে বসবাসকারী ৪০ শতাংশ মানুষই দরিদ্র।

এদিকে 'বড়লোকের ঢাক গরিব লোকের চামড়া' দিয়ে তৈরি হচ্ছে সভ্যতার আদিকাল থেকেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্সটিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ-এর তৈরি একটি রিপোর্ট অনুসারে, পৃথিবীতে যে মানুষরা অত্যন্ত ধনবান, তাঁরা পাহাড়প্রমাণ ধনসম্পদের অধিকারী হতে পেরেছেন দরিদ্র মানুষকে বঞ্চিত করে। করোনা পরিস্থিতিতেও বহাল ছিল সেই ট্র্যাডিশন।

এ-ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেশ করেছে ইন্সটিটিউট অব পলিসি স্টাডিজ। তাতে দেখা গিয়েছে, ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাস আবিশ্ব মারণক্ষমতা ছড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে দীর্ঘকালীন করোনা পরিস্থিতিতে বিলিওনিয়ারদের সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে চোখ কপালে তোলার মতোই।

ফোর্বসের দেওয়া তথ্যানুসারে, পৃথিবীর ২,৬৯০ জন বিলিওনিয়ারের সম্পত্তির পরিমাণ খতিয়ে দেখা হয়েছে। তাতে জানা গিয়েছে, ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ওই বিলিওনিয়ারদের সম্পত্তির পরিমাণ ৮ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩.৫ বিলিয়ন ডলার।

এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আরও বেশি পরিমাণে কুক্ষিগত হয়েছে দুঃসহ করোনা পরিস্থিতিতে। পাশাপাশি, বিলিওনিয়ারের তালিকাতে আরও ৯টি নতুন নাম সংযোজিত হয়েছে। এদিকে বিশ্ব ব্যাঙ্কের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, করোনা পরিস্থিতি ২০ কোটি মানুষকে অসহনীয় দারিদ্রের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

ফলে 'অ্যাপোরোফোবিয়া' এবং 'পেনিয়াফোবিয়া'-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি হলেও, বলা বাহুল্য, শুধুমাত্র বিহেভিয়ার থেরাপির মাধ্যমে রোগটা নির্মূল করা যাবে না।

যদি না পৃথিবীটাই পাল্টে যায় কোনও ম্যাজিকে, যদি দূর না হয় ধনী-দরিদ্ররর ব্যবধান, তবে রোগমুক্ত হওয়াটাও সহজ নয়!

More Articles