আর্জেন্টিনার খেলা দেখার অপেক্ষায় ছিল ছোট্ট মেয়েটি, দাদা-ই কেটে টুকরো করল তাকে!

Alina Islam Ayat: এই ছোট্ট ফুটবলপ্রেমীর হত্যা মেনে নিতে পারছেন না কেউ। ফোনে ফোনে ঘুরছে নীল-সাদা জার্সি পরা সেই আলিনার ছবি…

পরনে আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের জার্সি। নিষ্পাপ মুখ আর এলো চুলে চওড়া একটা হাসি। ছোট্ট এই মেয়েটির ছবিই এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নাম আলিনা ইসলাম আয়াত, বয়স মাত্র পাঁচ। বাড়ি ওপার বাংলায়, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। ফুটফুটে এই মেয়েটিকেই অপহরণ করার পর নৃশংসভাবে খুন করেছে তারই ‘প্রিয়’ প্রতিবেশী। তারপর প্রমাণ লোপাট করতে সেই শিশুটির দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে ভাসিয়ে দিয়েছে সাগরে। নৃশংস এই ঘটনা কার্যত স্তম্ভিত করে দিয়েছে নেটিজেনদের। ফুটবলের মরসুম, যখন সবাই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স-জার্মানির দ্বন্দ্বে মেতে আছে, সেই সময় এই ছোট্ট ফুটবলপ্রেমীর হত্যা মেনে নিতে পারছেন না কেউ। ফোনে ফোনে ঘুরছে নীল-সাদা জার্সি পরিহিতা সেই মেসিভক্ত আলিনার ছবি…

চট্টগ্রামের বন্দরটিলার সোহেল রানার পাঁচ বছরের মেয়ে আলিনা ইসলাম আয়াত বাড়ির সবারই বড্ড প্রিয় ছিল। ভালবাসত আচার খেতে, বাবার দোকানে গিয়ে হেসেখেলে লুকোচুরিও খেলত। আপাতভাবে নিরুপদ্রব জীবন, কোনও শত্রুতাও নেই বাড়ির কারও। তাহলে কী এমন হল? একটু একটু করে ঘটনার দিকে এগোনো যাক। ১৫ নভেম্বর, ২০২২। ফুটবল বিশ্বকাপ তখনও শুরু হয়নি। খেলাধুলা করে অন্যান্য দিনের মতো বিকেলে বাড়ির কাছেই এক জায়গায় পড়তে যায় আলিনা। তারপর থেকে সে নিখোঁজ, আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! বাবা সোহেল রানা ও পরিবারের অন্যান্য লোকেরা খোঁজ নিতেই তাঁদের কপালে হাত পড়ে। আলিনা ওইদিন পড়তেই যায়নি! তাহলে? পাঁচ বছরের একরত্তি মেয়েটি গেল কোথায়? হুটহাট না বলে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার মতো মেয়ে তো সে নয়; তাহলে?

আরও পড়ুন : শ্রদ্ধা-আফতাবের মধ্যে ছিল তৃতীয় কোনও মহিলা? পুলিসের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়

একদিন যায়, দু’দিন যায়, কিন্তু খোঁজ আর মেলে না। শেষমেশ সবাই মিলে থানায় পুলিসের কাছে নিখোঁজের অভিযোগ দায়ের করে। সেই সময় তাঁদের সঙ্গে আসে প্রতিবেশী আবির আলিও। ১৯ বছরের এই তরুণ কয়েক মাস আগে এলাকায় ভাড়ায় থাকতে এসেছে। আয়াত পরিবার ও আলিনার সঙ্গেও ওর দারুণ ভাব। এদিকে তদন্ত শুরু করার পরও দিন এগিয়ে যায়। মেয়ের খোঁজও পাওয়া যায় না, মেয়েও ঘরে ফেরে না। পুলিস অবশ্য ততদিনে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে।

বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর তদন্তের স্বার্থে এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখতে শুরু করে পুলিস। তখনই অদ্ভুত একটি বিষয় নজরে আসে। বিস্তর সিসিটিভি ফুটেজের মধ্যে একটি অংশে দেখা যায় আবিরকে। সেই আবির আলি, যে সোহেল রানা ও তাঁর মেয়ে আলিনা আয়াতের খুব ঘনিষ্ঠ। ভিডিওয় দেখা যায়, খুব সাবধানে দু’টি ব্যাগ নিয়ে সে কোথাও একটা যাচ্ছে। সেখানে তার হাবভাব দেখে পুলিসের খানিক সন্দেহ হয়। এরপর আরও গভীরভাবে এলাকার মধ্যেই তদন্ত শুরু করেন পুলিস অফিসাররা। আলিনার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও তাঁদের কথা হয়। সেই বাচ্চাগুলির মুখেও ঘুরেফিরে চলে আসে আবিরের নাম। নিখোঁজের দিন, অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর শেষবার তারা আবিরের সঙ্গেই আলিনাকে দেখেছে।

আরও পড়ুন : শ্রদ্ধার কাটা মাথা ফেলার আগে অভাবনীয় কীর্তি আফতাবের! দেহের বাকি টুকরো কোথায় কোথায় ফেলেছিলেন?

সন্দেহ আরও দৃঢ় হওয়ায় এবার সরাসরি আবির আলির ভাড়াবাড়িতে যান তদন্তকারী অফিসাররা। সেখানে গিয়ে আবিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসেন। বাড়িতে যাওয়ার আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নজরে পড়ে পুলিসের। সিসিটিভিতে যে দু’টি ব্যাগ নিয়ে আবিরকে যেতে দেখা গিয়েছিল, সেরকমই ব্যাগ তার বাড়িতেও রয়েছে। এরপরই চেপে ধরেন অফিসাররা। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। ঘটনার ১০ দিন পর, ২৫ নভেম্বর রহস্যের সমাধান হল। কিন্তু যে সত্য উঠে এল, তাতে দুঁদে পুলিস অফিসারদেরও গা শিউরে উঠছিল। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ই আবির সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে। সে-ই আলিনা ইসলাম আয়াতকে অপহরণ করে। কিন্তু সে আর বেঁচে নেই। ঘটনার পরদিনই একরত্তি শিশুটিকে খুন করে আবির। তল্লাশি চালিয়ে আলিনার পায়ের চটি আর রক্তমাখা বটিও উদ্ধার করে পুলিস।

ঠিক কী ঘটেছিল? কেন এমন নৃশংসতার স্বীকার হতে হল ছোট্ট আলিনাকে? প্রাথমিক তদন্ত করে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে পুলিসের হাতে। হাতে টাকা না থাকায় অপহরণ করে মোটা অর্থ আদায়ই ছিল উদ্দেশ্য, জেরায় এমনটাই বলেছে আবির। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিসেরও সন্দেহ সেই দিকেই। কারণ অপহরণের আগে সে বাড়ির সেলাই মেশিনও বিক্রি করে দেয়। পাশাপাশি কম দামের একটি মোবাইলও কেনে। কিন্তু সিমকার্ড কাজ না করায় মুক্তিপণের জন্য ফোন করতে পারেনি। অন্তত বেশ কয়েক মাস ধরে আবির এই পরিকল্পনা করছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিস। সুযোগ পাওয়ার পরই সে এই কাজটি করে। কিন্তু তারপর সে চিন্তায় পড়ে যায়। অন্যদিকে আলিনা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলে সে আরও ঘাবড়ে যায়। তখনই সে পাঁচ বছরের মেয়েটিকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। তারপর লোপাট করার জন্য দেহটিকে কয়েকটি টুকরো করে ব্যাগে ভরে সাগরে ভাসিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন : ৭০ টুকরো স্ত্রী, ৩০০ টুকরো প্রেমিক! প্রেমের এমন নৃশংস পরিণতি বারবার দেখেছে দেশ

জেরায় আরও একটি বিস্ময়কর তথ্য উঠে এসেছে, যেদিকে নজর দেওয়া দরকার। আবির পুলিস অফিসারদের জানিয়েছে, টিভিতে ‘ক্রাইম পেট্রোল’-এর মতো অনুষ্ঠান দেখে সে এমন পরিকল্পনা এঁটেছিল। মাত্র কয়েকদিন আগে ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও এরকমই একটি নৃশংস ঘটনা সাড়া ফেলে। শ্রদ্ধা ওয়ালকরের হত্যাকাণ্ড এবং তাঁর শরীরকে টুকরো টুকরো করে লোপাট করে দেওয়ার বিষয়টি এখনও পুরনো হয়ে যায়নি। সেখানেও খুনি তথা প্রেমিক আফতাব পুনাওয়ালার অনুপ্রেরণা ছিল ‘ডেক্সটার’ নামের একটি সিরিজ। কারণ আলাদা হলেও, খুনের পদ্ধতিতেও বিস্তর মিল। অতিরিক্ত হিংসাপ্রবণতা কি ক্রমশ ব্যাধির মতো গ্রাস করছে আমাদের? প্রশ্নটি তুলে দিয়েছে ওই একরত্তি পাঁচ বছরের মেয়েটি। ইতিমধ্যেই বিশ্বকাপে জয়ের মুখ দেখেছে আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেই খেলা আর দেখা হল না আলিনা ইসলাম আয়াতের। আর্জেন্টিনা, পেরুর সংবাদমাধ্যমও এই ঘটনায় শিহরিত। মেসির ফ্যানের এমন অবস্থা তারাও কল্পনা করতে পারেনি। এখন নীল-সাদা জার্সি পরিহিতা ফুটফুটে ছবিটাই কেবল সম্বল।              

More Articles